আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিডিয়া মনোপলি : পুঁজি রক্ষার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র

গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু

সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ার শক্তিমত্তা যে কী পরিমাণ ব্যাপক, তা একটু পর্যবেক্ষণেই দেখা যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তাকালে সমস্ত অধ্যায় জুড়ে মিডিয়ার প্রভাব স্পষ্ট হয়। দেখা যায়, বিছানা ছেড়ে বেড টি পানের সময় হকার দিনের সংবাদপত্র নিয়ে হাজির। অফিসে যাওয়ার জন্য পথে বেরুলে রাস্তার দু’পাশে সারি সারি বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড পণ্যের প্রলোভন নিয়ে চোখের সামনে স্বতস্ফূর্তভাবে বিরাজমান। অফিসে প্রবেশের পর দাপ্তরিক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার।

সারাদিন কাজ করে যখন বাসায় ফিরে আসা হয়, তখন কান্তিকর জীবনের অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে একটু লাবণ্য তো চাই। আর সেই লাবণ্যের সন্ধানে এবার টিভি’র সামনে বসে বিনোদনের সন্ধান করা। সংবাদপত্র, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড, ইন্টারনেট এবং টিভি-এ প্রত্যেকটি বস্তুই মিডিয়ার অংশ। আর এ মিডিয়া জগত ক্রমশ আমাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করছে ব্যাপকভাবে। কখনো হয়তো সচেতনভাবে আবার কখনো অবচেতনরূপে।

মিডিয়ার এ ভূমিকা সমাজ জীবনে কী রকম প্রভাব ফেলে তা আলোচনা করার উদ্দেশ্যেই এ প্রবন্ধের অবতারণা। প্রথমে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া সোয়াইন ফু নিয়ে আলোচনা করা যাক। ২৪ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সোয়াইন ফু সর্বত্র ছড়িয়ে যাওয়ার দরুণ সে দেশে ন্যাশনাল ইমারেজেন্সি ঘোষণা করে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৫০টি রাজ্যের মধ্যে ৪৬ রাজ্যে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা এক হাজার অতিক্রান্ত, তন্মধ্যে আবার ১ শ’ জন শিশু।

ফলে পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য কারণে মৃতের হার কেমন? এ বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক। এখানে, প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে গড়ে ৬ লাখের উপর, ক্যান্সারে ৫ লাখ ৫৯ হাজার, ডায়াবেটিসে ৭২ হাজার, স্ট্রোকে ১ লাখ ৩৭ হাজার, সাধারণ ফু’তে ৫৬ হাজার। এছাড়া গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট, এইডস, আত্মহত্যা বা খুনের মাধ্যমেও মৃতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রশ্ন উঠছে, প্রায় এক বছরে মাত্র সহস্রাধিক লোক মারা যাওয়ার কারণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ইমারেজেন্সি জারির মাধ্যমে কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে? ইতিমধ্যে সনোফি অ্যাভেন্টিসসহ অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানির নিকট থেকে সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ভ্যাকসিন ক্রয় করেছে।

সোয়াইন ফু ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে তা মোকাবেলা জন্য বাজেট ঘোষণা হয়েছিল ৪ শত কোটি ডলারের, বর্তমানে তা আরো বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই ৫০ মিলিয়ন ডোজ সোয়াইন ফু ভ্যাকসিন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে আরো ১৫০ মিলিয়ন ডোজের অর্ডার দেয়া হয়। সোয়াইন ফুতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তা পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজার হলেও মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৭০০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে শুধুমাত্র হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৭.২০ মিলিয়ন লোক, স্ট্রোক করে মারা যায় ৫.৭১ মিলিয়ন, শ্বাস কষ্টে ৪.১৮ মিলিয়ন, ডায়রিয়ায় ২.১৬ মিলিয়ন, যক্ষ্মায় ১.৪৬ মিলিয়ন, রোড অ্যাকসিডেন্টে ১.২৭ মিলিয়ন। ইতোমধ্যে কথিত এ রোগ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানি ব্যাপক মুনাফা আয় করে নিয়েছে।

রোগের ভাইরাস যতটুকু প্রসারণ হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি মাত্রায় ছড়িয়েছে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। ওষুধ কোম্পানির সাথে গাঁটছড়ার মাধ্যমে মিডিয়া কোম্পানিগুলো এ পরিস্থিতি তৈরি করে। বাংলাদেশেও প্রথম দিকে কথিত সোয়াইন ফু নিয়ে তথ্য মাধ্যম ব্যাপক শোরগোল তোলে, যদিও তাদের সে আয়োজন শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পরে বাংলাদেশে যে চার জন সোয়াইন আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল, তাদের কেউ সুনির্দিষ্টভাবে সোয়াইন ফু’তে মারা যায়নি। বর্তমানে শুধু সোয়াইন ফু’র ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য বিষয়েও আলোচনা তৈরির মূল মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বহুজাতিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান।

যে কারণে আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে মিডিয়া গবেষক বেন বাগডিকিয়ান বলেছিলেন, “জনগণ কতটা জানবে,কতটা শুনবে তা এক সময় ঠিক করে দিত রাজা ও পুরোহিতবৃন্দ, এখন নির্ধারণ করে গণ মাধ্যম..............গণ মাধ্যম যা সম্প্রচার করে না জগতে তা সংঘটিত হয় না..............গণ মাধ্যম এখন শুধু বাস্তবের প্রতিফলন নয়, বরং বাস্তবের উৎস। ৮০ এবং ৯০’র দশকেও অনেকের চিন্তা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনায় বাগডিকিয়ানের এই ধারণার সমর্থন পাওয়া যায় এবং বাগডিকিয়ানের বক্তব্য নাকচ করে দেয়ার মত নয়। সংস্কৃতি ইচ্ছে মত নির্মাণ আমাদের সংস্কৃতি কী রকম হবে, তা এখন নির্ধারণ করছে গণমাধ্যম। সমসাময়িককালে সাধারণ মানুষের বাচন ভঙ্গি, পোষাক, চিন্তার ধরন প্রত্যেকটি বিষয়ে গণমাধ্যমের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। বহুজাতিকের মুনাফার প্রয়োজনে বিশ্বব্যাপী অভিন্ন সংস্কৃতি নির্মাণে গণমাধ্যমগুলো সক্রিয়।

১৯০০ সালের প্রথম দিকে গণমাধ্যম নির্মিত সংস্কৃতির ব্যাপকতা সর্বপ্রথম দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে শিল্পের অবাধ বিকাশের কারণে উদ্ভব হয় গণসমাজের। মূলত ১৯০০ থেকে ১৯২০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণসমাজের চূড়ান্ত বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। সংক্ষিপ্ত অর্থে গণসমাজের মানে হচ্ছে- মেট্রোপলিটন শহরে হাজার হাজার মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে নৈকট্য থাকলেও পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর কারণে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, তাকেই গণসমাজে প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান দুই মেট্রোপলিটন শহর ঢাকা এবং চট্টগামের বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।

এই শহরগুলোতে লাখ লাখ লোক বসবাস করছে। আকাশচুম্বি বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। বাস, পথে-ঘাটে অজস্র লোকের বিচরণ, বহুতল কর্পোরেট অফিসে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিন্তু এই মানুষেরা পরষ্পর থেকে অসম্ভব বিচ্ছিন্ন। পারষ্পরিক সুখ, দুঃখের ভাবনা বিনিময় এদের মধ্যে হয় না বললেই চলে।

হয়তো দেখা যায়, পাশের ফ্যাটের একজন সাত আট দিন যাবৎ মরে পড়ে আছে, কিন্তু এই খবর প্রতিবেশীর নিকট এসে পৌঁছায় না। যদি মৃতের শরীর থেকে দুগন্ধ বের না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যজন খোঁজও নিবে না আসল পরিস্থিতি কি। তাও বাসস্থানের পরিবেশ দূষিত করছে বলে সে এগিয়ে হবে। কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হল, সভ্যতার উষালগ্নে যখন ফ্র্যান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছিল তখন তো এই অবস্থা ছিল না। মিডিয়া গবেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামো যেমন দায়ী, তেমনি তার সহায়ক উপরিকাঠামো হিসেবে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করেছে।

গণমাধ্যম বর্তমানে কর্পোরেট বাণিজ্যের মুনাফা রক্ষার্থে বিশেষ সংস্কৃতি নির্মাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। আর এই সংস্কৃতির নাম হচ্ছে গণ সংস্কৃতি। বর্তমানে যা কর্পোরেট সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত বর্তমানে আমাদের দেশেসহ সারা বিশ্বব্যাপী এ সংস্কৃতির প্রসার দেখা যায়। এ সাংস্কৃতিক রূপটা কেমন? বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক- আলোচনার স্যাম্পেল হিসেবে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত যুব সমাজের দৈনন্দিন ভাবনা এবং আড্ডার জগতে প্রবেশ করা যাক। পোষাকে এবং চলনে এরা যথেষ্ট স্মার্ট।

এরা সংবাদপত্র পড়ে, একাধিক চ্যানেলে টিভি অনুষ্ঠান দেখে, বিভিন্ন সাহিত্যিক যেমন হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস পড়ে, বন্য ফুয়াদ বা মিলার গান শুনে, পণ্যায়িত লোকজ পোট্রেট সম্বলিত টিশার্টের সর্বশেষ সংস্করণের বিষয়ে আড্ডা দেয়। মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যার বিষয়েও কথা বলে। আবার সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি আলোচনার প্রধান বিবেচ্য হিসেবে স্থান পায় তা হচ্ছে প্রেম সম্পর্কিত আলোচনা। অর্থাৎ এই হচ্ছে তাদের সংস্কৃতির মূল কনটেন্ট। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বৃত্তের বাইরে কেন তাদের আড্ডা যেতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎ, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর, জ্যাক লন্ডন বা হাওয়ার্ড ফাস্ট কেন আড্ডার বিষয় বস্তু হতে পারে না? উত্তর-গণমাধ্যম। এই মাধ্যমই এখন সংগীতসহ অন্যান্য শিল্পের কাঠামো এবং জনপ্রিয়তা স্থির করে দিচ্ছে। সাহিত্য ও কবিতার বিষয় কি হবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। প্রসঙ্গানুক্রমে বলা যায়, তাতে সমস্যার কী হচ্ছে? আমরা যদি একটু এক্সপেরিমেন্টাল কেস হিসেব এসব অনুধাবন করি, তাহলে দেখা যায় এসব পড়তে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না। বিভূতিভূষণের আরণ্যক বা শরতের শ্রীকান্ত পড়তে যতটুকু পরিশ্রম করতে হয়, তার বিপরীতে হুমায়ুন আহমেদের মেঘ বলে যাবো যাবো উপন্যাস অনেক সহজে পড়া যায়।

ভারতীয় ক্যাসিক্যাল সঙ্গীত অনুধাবন করতে যে সাধনার প্রয়োজন হয়, অন্যদিকে মিলা বা বন্য ফুয়াদের গান শুনতে কোন পরিশ্রমই করতে হয় না। এসব সস্তা এবং সহজলভ্য সঙ্গীত বা উপন্যাসের কারণে মূল্যবান বিষয়গুলো মার খাওযা শুরু করল। মেলায় হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের বিক্রি ব্যাপক, কিন্তু ক্যাসিক্যাল উপন্যাস খুবই নগণ্য। মানুষের সংস্কৃতি হয়ে গেল সস্তা। যে সব সংস্কৃতি অর্জন করতে পরিশ্রম করতে হয়, নন্দনতাত্ত্বিক এবং শৈল্পিক মূল্য রয়েছে, তা পর্যদুস্ত হওয়া শুরু করল, সুন্দরকে গ্রহণ করার মানসিকতা ধীরে ধীরে হয়ে গেল নষ্ট।

অনেকে বলেন, এ আমাদের সংস্কৃতি নয়, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। কিন্তু এসব পাশ্চাত্য সংস্কৃতিও নয়। এ সংস্কৃতি কর্পোরেট পণ্য এবং স্বার্থের তাগিদে গণমাধ্যমের কল্যাণে নির্মিত হয় । এ সংস্কৃতিকে জার্মান তাত্ত্বিকরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নামকরণ করেছিলেন ‘কালচারাল ইন্ড্রাস্টি বা সংস্কৃতি কারখানা’ হিসেবে। এসব বিশ্লেষণের জন্য উক্ত তাত্ত্বিকদের যথেষ্ট মূল্যও দিতে হয়েছিল।

জার্মান ফ্যাসীজমের তাড়া খেয়ে স্বদেশ ভূমি জার্মান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সে সময় ম্যাক্স হর্কহেইমার, থিওডর অ্যাডোর্নো, হার্বাট মারকুইসে, লিও লোয়েনথালসহ অন্যান্য তাত্ত্বিকেরা এই সংস্কৃতিকে বিশ্লেষণ করেছিলেন। বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কিছু মুখ্য উপাদানও তারা হাজির করে। ১। ভোক্তা সমাজের উত্থান (কনজিউমার) এবং গণসংযোগ ও গণসংস্কৃতির বিস্তার।

২। বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যমের সাংস্কৃতিক ক্ষমতার আবির্ভাব। ৩। রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কর্তৃক রেডিও’র তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার। ৪।

ওই পর্বে প্রতি সপ্তায় ৮৫ থেকে ১১০ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিকের টিকেট কেটে মুভি দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। তারা গণসংস্কৃতি টার্ম ব্যবহার না করে এর নামকরণ করেছিলেন কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি বা সংস্কৃতি কারখানা হিসেবে। অর্থাৎ কারখানায় যেমন পণ্য উৎপাদিত হয় তেমনি সংস্কৃতিও এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ায় এ্যাডার্নো এবং হর্কহেইমার দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন, কীভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থ গণসংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং কীভাবে ভোগবাদী সমাজেও গণমাধ্যমগুলিতে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির প্রতি আসক্তি বাড়ে। অন্যদিকে হার্বাট মারকিউসে, লোয়েনথাল ও অন্যরা ওয়াশিংটনে মার্কিন সরকারের যুদ্ধ তথ্য কার্যালয় এবং গোয়েন্দা সার্ভিসে কর্মরত অবস্থায় দেখেছেন-কীভাবে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা অস্ত্র হিসেবে গণযোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে।

এভাবে ওই তাত্ত্বিকেরা দেখেছেন, সংস্কৃতি ইন্ডাস্ট্রি হল পুনর্গঠিত আধুনিক পুঁজিবাদের একটি কেন্দ্রীয় অংশ, যা সংস্কৃতি, বিজ্ঞাপন, যোগাযোগ মাধ্যম ও সমাজ নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য বাহণ ব্যবহারের মাধ্যমে ভোগবাদী সমাজে নবতর ধরনের প্রতি সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করে। বর্তমান পরিস্থিতি বর্তমান পুঁজিবাজার অসম্ভব অস্থির। এর মধ্যে মহামন্দায় আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশে দেশে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফ্রেড্ডি ম্যাক, ফ্যানি মে, জেপি মরগ্যান, লেম্যান ব্রাদার্সসহ অনেক জায়ান্ট বহুজাতিক সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। দৈনিক পত্রিকার শেয়ার মার্কেটের গ্রাফটা লক্ষ করলে পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে বুঝা যায়।

এই দর বাড়ছে আবার অকস্মাৎ হয়তো পড়েছে। ছোট পুঁজিকে গ্রাস করছে বড় পুঁজি। সারা পৃথিবীর পণ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বর্তমানে ৩৫০ বহুজাতিক কোম্পানি। এই নিয়ন্ত্রণ যে কী ভয়ঙ্কর তা একটা উদাহরণ দিলেই বুঝা যায়-২০০৫ সালে নাইজেরিয়োর জিডিপি মূল্য ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার। আর ওই বছর নেসলে কোম্পানির বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলার।

আবার এসব কোম্পানির বাজার নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় দায়িত্বের ভূমিকা পালন করে করে গণমাধ্যম। ফ্র্যাস্কফুর্ট স্কুলের সেদিনকার ‘কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি’ তত্ত্বের ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়, আজকের মিডিয়া পুঁজির বাজারেও। বর্তমান গণমাধ্যমের প্রবণতা হচ্ছে একই সুরে কথা এবং অভিন্ন কনটেন্ট নির্মাণ করা। অর্থাৎ সব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। আবার সাধারণ পুঁজিবাজারের মত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারও একই।

অর্থাৎ এখানেও অস্থিরতার অংশ হিসেবে মার্জারের প্রভাব পরিলক্ষিত। ফলাফল হিসেবে তৈরি হয়েছে মেগা মিডিয়া হাউস বা ট্রান্স ন্যাশনাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের। এসব মেগা প্রতিষ্ঠানের রয়েছে মাধ্যম জগতের সমস্ত অধ্যায়ে পদচারণা। সম্প্রচার, প্রকাশনা ,চলচ্চিত্র, খবর, সার্ভারসহ বিভিন্ন সেক্টরে এরা ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ খুবই পরিষ্কার, মুনাফা লুন্ঠনের মাধ্যমে মিডিয়া বাজারে আধিপত্য বিস্তার করা।

এক্ষেত্রে মিডিয়া গবেষক রবার্ট ম্যাকচেজনীর কমেন্ট উদ্ধৃতি করা যেতে পারে। তিনি ১৯৯৭ সালে বলেন, একটা ভুত এখন সারা পৃথিবীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে : “ক্ষুদ্র সংখ্যক মহা ক্ষমতাধর বহুজাতিক মিডিয়া কর্পোরেশনের আধিপত্যধীন, যা অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক, বৈশ্বিক বাণিজ্যিক মিডিয়া সিস্টেম। এটা এমন এক সিস্টেম যা বৈশ্বিক বাজার গড়ে তুলতে ও বাণিজ্যিক মূল্যবোধ প্রমোট করতে কাজ করে এবং একই সাথে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী কর্পোরেট স্বার্থের প্রতিকূল সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির অবনমন ঘটায়”। কথাগুলো ম্যাকচেজনী নিয়েছেন কমিউনিস্ট ইস্তেহারের প্রথম প্যারা থেকে। সেদিন মার্কস এবং এঙ্গেলস স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যবাদের।

তখন কমিউনিজমের ভুতে সমস্ত ইউরোপ ছিল কম্পমান। কসিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশের ১৬১ বছর পর দেখা যাচ্ছে, সেই ভুত হিসেবে মেগা মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আজ আত্মপ্রকাশ করেছে। ” স্বদেশী মোড়লিপনার জন্য সংবাদপত্রের দাসত্বগিরি সারা পৃথিবীর প্রিন্ট মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে এখন তিনটি প্রতিষ্ঠান, যথাক্রমে রয়টার্স (যুক্তরাজ্য), এপি-অ্যাসোসিয়েট প্রেস (যুক্তরাষ্ট্র) এবং এএফপি-এজেন্স ফ্রেঞ্চ প্রেস (ফ্রান্স)। এই মনোপলি সিস্টেম চলে আসছে অনেক বছর যাবৎ। ১৫০ বছর আগে ঔপনিবেশিক শোষণের স্বার্থে তথ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে তিনটা সংবাদ সংস্থা চালু হয়েছিল।

এরা ছিল যুক্তরাজ্যের রয়টাস, ফ্রান্সের হাভাস এবং জার্মানীর উলফ। উলফ এবং হাভাসের কর্তৃত্ব হ্রাস পেলেও রয়টার্সের অব্যাহত কর্তৃত্ব এখনো রয়ে গেছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা এবং সংবাদপত্রগুলো এদের উপর নির্ভরশীল। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রচারের অধিকার পেলেও নিজেদের সংবাদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচারের অধিকার পায় না। এই ব্যবস্থার খুব একটা বিরুদ্ধাচারণ জাতীয় সংবাদপত্রগুলো করেনি।

কারণ, এদের মাধ্যমেই জাতীয় সংবাপত্র স্বদেশী মোড়লিপনার অধিকার পায়। অর্থাৎ নিজের দেশে তারা হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব সংবাদের একমাত্র পরিবেশক। যদি কোন কারণে দেশীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বার্থের সংঘাত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সংবাদের স্বদেশী মোড়লিপনা এরা হারিয়ে ফেলে। প্রধান তিন সংবাদ সংস্থার পুঁজিও বিশাল। উপনিবেশিক সময়কাল থেকেই তথ্য সাম্রাজ্যের সিংহ ভাগের মালিক রয়টার্স ইউরোপের ১০০ টি শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে মধ্যে এর অবস্থান বিদ্যমান।

মার্জার : পুঁজি বাজারে অস্তিত্ব রক্ষার মূল উপায় বড় পুঁজি এবং ছোট পুঁজির দ্বন্দ্ব মিডিয়া মার্কেটে সাম্প্রতিক দশকে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ১৯৮৯ সালে টাইম এবং ওয়ার্নার কমিউনিকেশনের মার্জারের ফলে টাইমওয়ার্নারের আবির্ভাব হয়। এই টাইমওয়ার্নারের সাথে আবার ২০০০ সালে আরেক মেগা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান অনলাইনের মার্জার ইতিহাসের আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারণ, এওল ইতোমধ্যেই আমেরিকার বৃহত্তম ইন্টারনেট কোম্পানি ছিল, ইউরোপের বিশাল বাজারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে, ফ্রান্সের ভিভেন্দি মিডিয়া কোম্পানি কিনে নিয়েছে আমেরিকার ইউনিভার্সেলকে।

বেন বাগডিকিয়ান ১৯৮৩ সালে ‘মিডিয়া মনোপলি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ৫০টি মিডিয়া কর্পোরেশন বিশ্বের সকল জাতীয় মাধ্যম প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে। বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে, তখন ৫০ থেকে মিডিয়া কর্পোরেশনের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৯টি। এভাবে মিডিয়্ ামনোপলি গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণে (১৯৯০) মেগা মিডিয়ার সংখ্যা হয় ২৩টি। চতুর্থ সংস্করণে (১৯৯২) কমে দাঁড়ায় ১৭টি, পঞ্চম সংস্বরণে (১৯৯৭) ১০টি। ২০০০ সালে উক্ত গ্রন্থের ৬ষ্ঠ সংস্করণে বাগডিকিয়ান দেখান, সারা পৃথিবীর তথ্য ব্যবস্থাকে এখন মাত্র ৬টি মিডিযা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে।

তারা হচ্ছে যথাক্রমে আমেরিকান অনলাইন টাইমওয়ার্নার, ভায়াকম, দ্যা ওয়ার্ল্ড ডিজনী, বার্টেলসম্যান, ভিভেন্দি এবং নিউজ কর্পোরেশন। বর্তমানে তা আরো সংকুচিত হয়েছে। এখন তিন থেকে চারটি বহুজাতিক মিডিয়া হাউস বিশ্বের তথ্য মাধ্যমের উপর আধিপত্য বিস্তার করে চলছে। মিডিয়ার মূল নিয়ন্ত্রণকারী কেন্দ্র এই শতকের প্রথমেই সংঘটিত হয়ে গেল দুটি দেশ দখলের ঘটনা। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরপর জায়নবাদী ইহুদীরা প্যালেস্টাইন দখলের পর থেকে অসংখ্য আঞ্চলিক যুদ্ধের ঘটনা ঘটলেও দেশ দখলের মত ঘটনা সৃষ্টি হয়নি।

কিন্তু বাজার সংকট এবং খনিজ সম্পদের উপর একচেঠিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ইরাক ও আফগানিস্তান যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দোসররা দখল করে নেয়। আফগানিস্তানে হামলার ক্ষেত্রে অজুহাত ছিল, আল কায়েদা ওযার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা এবং নিরপরাধ ৫ হাজার মার্কিনিকে হত্যা করেছে। ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তারা মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্রের নির্মাতা, যা মানব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্র প্রেরিত এসব তথ্যের সত্যতা প্রমাণের দায়িত্ব কাঁধে নেয় মিডিয়া। আফগানিস্তানে হামলার সময় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধ্বংসস্তুপের ইমেজ বারবার মার্কিন নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে প্রচারিত হচ্ছিল।

স্বজন হারানো আমেরিকানদের কান্নার বিপরীতে সাধারণ আফগানদের দেখানো হচ্ছিল বর্বর, দস্যু হিসেবে। বলা হচ্ছিল- এরা সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদের মূল হোতা। হাজার হাজার আফগানকে হত্যার পাশাপাশি পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য করে আমেরিকান সৈন্যরা। ইরানী চলচ্চিত্রকার মোহসেন মাখমলবাফের কান্দাহার সিনেমাটি দেখলে আমেরিকানদের বর্বরতা ভয়ঙ্করভাবে স্পষ্ট হয়। সে সময় সিএনএন প্রধান ওয়াল্টার আইজ্যাকশন স্পষ্ট নির্দেশ দেন, বিধ্বস্থ আফগানিস্তানকে দেখানো সময় যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয়, এই দেশে এমন সন্ত্রাসীদের পালন করা হচ্ছে যারা ৫ হাজার নির্দোষ আমেরিকানকে হত্যা করেছে।

একই সময় ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে ডেকে নিয়ে আসা হয় সংবাদ মাধ্যমের পরিচালকদের। বলে দেয়া হয়, কোনভাবেই ওসামা বিন লাদেনের বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। সম্প্রচার করা যাবে না আহত এবং নিহত আফগানদের ছবি। ১৯৮৫ সালে উইলিয়াম সি. অ্যাডাসের সম্পাদিত গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যান্য দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মার্কিন টিভি সংবাদ নেটওয়ার্কের প্রচারের অনুপাত হচ্ছে : একজন পশ্চিম ইউরোপীয় মানুষের মৃত্যু, তিন জন পূর্ব ইউরোপীয়, নয়জন ল্যাটিন আমেরিকান, এগার জন মধ্য প্রাচ্যের এবং ১২ জন এশীয় মানুষের মৃত্যুর সমান। গণমাধ্যমের বহুজাতিক কোম্পানির প্রতি আনুগত্যের ধরন যে কি পরিমাণ তা এ ঘটনাটি দ্বারা স্পষ্ট হয়, নিউজ কর্পোরেশন মালিকানাধীন ফক্স টেলিভিশনের ফোরিডায় কর্মরত দু’জন সাংবাদিক জেইন আর্ক এবং স্টিভ উইলসন ‘মনসান্তো’র (জিএম বীজ, বিষ্পোরক এবং কীটনাশক উৎপাদিত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান) বিষয়ে একটি অনুসন্ধানি প্রতিবেদনের জন্য চাকরিচ্যুত হন।

সে সময় ফক্স টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার তাদের বলেন, “এই টেলিভিশন স্টেশনের জন্য তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছি, আমরা সিদ্ধান্ত নেব কোনটা খবর। খবর সেটাই যেটা আমরা তোমাদের বলবো। ” উপরোক্ত উদাহরণে স্পষ্ট হয়, বহুজাতিক পুঁজির অবাধ বাজার রক্ষাই হচ্ছে এসব মিডিয়া হাউসের মূল লক্ষ। ইতোপূর্বে ইরাক কিম্বা আফগান আগ্রাসনে তা আরো স্পষ্ট হয়েছে। ইরাকের বহুল কথিত মারাত্মক মারণাস্ত্রের হদিস তারা এখনো পায়নি।

তালেবান অজুহাতের বিষয়টি বিশ্ব বিবেকের নিকটও ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তা হচ্ছে, কাস্পিয়ান বেসিনে অবস্থিত ১.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলের রিজার্ভ সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। ইতহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালেবান সৃষ্টির নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা ছিল আমেরিকানদের। বিকল্পের সন্ধানে মেইনস্ট্রিমের বিরুদ্ধে বিকল্পের কন্ঠস্বর ধীরে ধীরে আরারো জেগে উঠছে। নোম চমেস্কী, বেন বাগডিকিয়ান, এডওয়ার্ড এস হারম্যান, রবার্ট ম্যাকচেজনী, মাইকেট প্যারেন্টিসহ আজ অনেকেই বিকল্পের স্বপ্ন জনমানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন।

অতীতে দেখা গেছে, বিকল্পের শ্লোগান নিয়ে ১৯৮০ সালে ম্যাকব্রাইড কমিশনের (ইউনেস্কো কর্তৃক গঠিত) রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এর আগে ১৯৭৫ সালে গঠিত হয়, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যামের সংবাদ সংস্থা ন্যানা। ৯০ পরবর্তী এক মেরুকরণ বিশ্বে পৃথিবী পুনরায় ফিরে যাওয়ায় তাদের সে উদ্যোগ হয়তো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু বিকল্পের শ্লোগান অব্যাহত রয়েছে। মেইনস্ট্রিমের বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট বিকল্পের ভাবনাধারী অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলেরেডোর ডেনভারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফ্রি স্পিচ টিভি।

অলাভজনকভাবে চালু এ টিভি বহুলভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৩০ লক্ষ মার্কিন নাগরিকের বাড়িতে এ টিভি পৌঁছে গেছে। বিকল্প মিডিয়ার আরেকটি প্রতিষ্ঠান অলটারনেট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে। বর্তমানে অলটারনেটের গ্রাহক সংখ্যা তিন মিলিয়ন। এছাড়াও আমেরিকায় রয়েছে আরো একাধিক বিকল্প মিডিয়া সংগঠন।

তন্মধ্যে আমেরিকান নিউজ প্রজেক্ট, ডেমোক্রেচি নাউ, দ্যা রিয়েল নিউজ, প্রগ্রেসিভ টক রেডিও, এয়ার আমেরিকান রেডিও, প্যাসিফিক রেডিও, নোভা এম রেডিও ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিকল্প মিডিয়ার রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। কর্পোরেট বা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় যে সব খবর আসেনা বা ইচ্ছা প্রণোদিতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয় তা বিকল্প মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এখানকার উল্লেখযোগ্য প্রিন্ট মিডিয়ার কয়েকটি হচ্ছে ভার্সিটি, একাল, নিউ এরা, ভুলা ইত্যাদি। রেডিও এবং টিভির মধ্যে রয়েছে ক্যাসেট, বুশ রেডিও, ইউজে এফএম, মিডিয়া ওয়ার্ক পাবলিশিং ইত্যাদি।

শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, সারা বিশ্বজুড়েই বিকল্প মিডিয়া শক্তিশালী হচ্ছে। ভারত, ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর হিসেবে বিকল্প মাধ্যম ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। বিকল্পের আন্দোলন এখন শুধুমাত্র মিডিয়ায় নয়, পরিবেশ দূষণ, ডব্লিউটিও’র মুক্ত বাজার, বহুজাতিক পুঁজির মনোপলি, বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস, সেক্টরে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তা ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বহুজাতিক মিডিয়ার বিরুদ্ধে অতীত সংগ্রাম ব্যর্থ হলেও একে চুড়ান্ত পরিণতি হিসেবে কখনোই মূল্যায়ন করা যাবে না। কণ্ঠস্বর থাকবেই, হয়তো কখনো তা ম্লান হয়ে, কখনো আবার বিষ্ফোরণের অবয়ব নিয়ে।

মানুষের ইতিহাস অনুযায়ী, চুড়ান্ত পরাজয় সে কখনো বরণ করেনি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.