আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার প্রিয় ছবি : পথের পাঁচালী

গল্পের রাজত্বে বসবাস করছি আপাতত
মুক্তিকাল :১৯৫৫ দৈর্ঘ : ১১৫ মিনিট রঙ : রঙিন দেশ: ভারত ভাষা : বাংলা পরিচালনা : সত্যজিৎ রায় প্রযোজনা : পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকার চিত্রনাট্য : সত্যজিৎ রায়, মূল গল্প : বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় অভিনয় : সুবির ব্যানার্জি, কানু ব্যানার্জি, করুণা ব্যানার্জি, উমা দাশগুপ্ত, চুনিবালা দেবী সঙ্গীত : রবি শঙ্কর চিত্রগ্রহণ : সুব্রত মিত্র সম্পাদনা : দুলাল দত্ত শিল্প নির্দেশনা : বংশী চন্দ্রগুপ্ত কাহিনী সংক্ষেপ : নিশ্চিন্দিপুর নামের ছোট্ট এক গ্রামের এক সাধারণ দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের দৈনন্দিন সুখ দুঃখের গল্প নিয়ে পথের পাঁচালী কাহিনী কাঠামো নির্মিত। হরিহর রায়ের দ্বিতীয় সন্তান অপুর জš§ ও তার বেড়ে ওঠাই এ ছবির মূল উপজীব্য। পুরোহিত্য করে কোনভাবে হরিহরের দিন যায়, সে স্বপ্ন দেখে একদিন তার লেখা পালা গ্রামে গঞ্জে অভিনীত হবে। স্ত্রী সর্বজয়া সরল এই স্বামীর সংসারের হাল ধরতে হিমসিম খায়। মেয়ে দূর্গা আর ছেলে অপু সঙ্গে তাদের সঙ্গে বাস করে হরিহরের বিধবা দিদি ইন্দির ঠাকুর।

দূর্গা প্রায়শই পড়শির বাগান থেকে ফল চুরি করে অতি বৃদ্ধ মাসী ইন্দির ঠাকুরকে দেয়। অপু-দূর্গার শৈশব কেটে যায় মিষ্টিঅলার পেছনে গুরে, ভ্রাম্যমান বায়োস্কোপ দেখে, ট্রেনের পেছনে ছুটে। খেলতে খেলতেই তারা একদিন ঝোপের মধ্যে বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে যাওয়া মাসী ইন্দির ঠাকুরের মৃতদেহ আবিষ্কার করে। এদিকে আরও বেশি আয়ের আশায় হরিহরণ বেরিয়ে পড়ে গ্রামান্তরে। তার অনুপস্থিতি পরিবারটি ভয়াবহ অর্থ সংকটে ভোগে।

বৃষ্টিতে ভিজে দূর্গারজ্বর আসে। চিকিৎসার অভাবে তার অসুস্থত বাড়তে থাকে। এক ঝড়ো রাতে তার মৃত্যুও হয়। অবশেষে হরিহরণ ফিরে আসে। সে সোৎসাহে দেখাতে থাকে কার জন্যে কি কি এনেছে।

এ সময়ই সে জানতে পারে, তার একমাত্র কন্যাটি আর নেই। হরিহরণ সিদ্ধান্ত নেয় পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে যাবে। গোছগাছ করার সময় দূর্গার বাক্স থেকে অপু একটি চুরি করা হার উদ্ধার করে। সে পানিতে হারটি ফেলে দেয়। ছবির শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি, পরিবারটি তাদের নিজের গ্রাম ছেড়ে অজানা ভবিষ্যতের দিকে রওনা হয়েছে।

বিশেষত্ব : প্রথম ছবি দিয়েই বিশ্ব চলচ্চিত্রে নিজের অবস্খান সুদৃঢ় করে নিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। আর একটি ছবি না-বানালেও বিশ্ব চলচ্চিত্রে অমর হয়ে থাকতেন তিনি। শুধু ভারতীয় চলচ্চিত্রেই নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রে এমন প্রতিভা নজিরহীন। মাত্র দেড় লাখ রূপি [সে সময়ের হিসাবে ৩০০০ মার্কিন ডলার] বাজেটে, অপেশাদার অভিনেতা, অনভিজ্ঞ কলাকুশলী নিয়ে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ও শিল্প সফল ছবি পথের পাাঁচালী নির্মাণে করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, স্রেফ মেধার জোরেই চলচ্চিত্র বানানো সম্ভব। ১৯৫৬ সালে কান ফিল্ম ফ্যাস্টিভালে ‘শ্রেষ্ঠ মানবতার দলিল’ হিসাবে চিহ্নিত হয়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূ-ভারতের চলচ্চিত্রকে সম্মানের সাথে তিনিই তুলে ধরেন। এছাড়া ১৯৫৫ সালে নয়াদিল্লীতে প্রেসিডেন্ট গোল্ড ও সিলভার মেডেল, ’৫৬ সালে এডিনবরা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফ্যাসটিভালে ডিপ্লোম অব মেরিট, রোমে ভ্যাটিকান, ম্যানিলাতে গোল্ডেন কার্বো, সান ফ্রান্সিসকো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফ্যাসটিভালে সেরা ছবি ও সেরা পরিচালনার জন্য গোল্ডেন গেট. ’৫৭ সালে বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা ছবির জন্য গোল্ডেন লরেল, ’৫৮ সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুবার ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা ছবি, স্টার্টফোর্ড ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা সমালোচক পুরস্কার পায় এবং ১৯৫৯ সালে নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভাল ও ন্যাশনাল বোর্ড অব রিভিউ এওয়ার্ড [নিউইয়র্ক]-এ সেরা বিদেশী ছবির পুরস্কার পায়। সাইট এণ্ড সাউণ্ড, রটেন টমেটো, ভিলেজ ভয়েজ, টাইম, নিউ ইয়র্ক টাইম, রলিং স্টোন এবং সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকালের একাধিক জরিপে এ ছবি বিশ্বের সেরা শত ছবির মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে। বিশেষ তথ্য : ১. পথের পাঁচালী ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিভূতিভূষণের এ উপন্যাসের সাথে সত্যজিৎ-এর প্রথম পরিচয় হয় ১৯৪৩ সালে।

পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু-এর জন্য অলঙ্করন করতে গিয়ে এ উপন্যাসের সাথে তা হৃদ্যতা বাড়ে। ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি এর চিত্রনাট্য তৈরি করেন। এ উপন্যাস বেছে নেয়ার কারণ হিসাবে তিনি জানান, ‘এর মানবতা, গীতলতা এবং সত্যের বলয় এটিকে একটি মহৎ গ্রন্থে রূপান্তরিত করেছে। ’ বিভূতিভূষণের স্ত্রী তাকে মৌখিকভাবে এ উপন্যাসকে চিত্রায়িত করার অনুমতি দেন। অবশ্য মূল উপন্যাসের আক্ষরিক অনুকরণ তিনি করেননি, বরং অনেক কিছুই বদলেছেন।

মূল উপন্যাসে ইন্দির ঠাকুরের মৃত্যু অনেক আগেই হয়, গ্রামের পূজা মণ্ডলে অন্যান্য বৃদ্ধদের সামনে তার মৃত্যু হয়, কিন্তু ছবিতে ইন্দির ঠাকুর মারা যায় অপু, দূর্গার সামনেই। অপু দূর্গার দৌঁড়ে ট্রেন দেখতে যাওয়া এ ছবির উল্লেখযোগ্য একটি দৃশ্য, মূল উপন্যাসে তারা কোন ট্রেনই দেখেনি। ছবির শেষে অপুর পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এই সমাপ্তিও মূল উপন্যাস থেকে ভিন্ন। ২. জ্যাঁ রেঁনোয় ১৯৪৯ সালে কলকাতায় রিভার ছবির শুটিং-এ এল সত্যজিৎ রায় তাকে লোকেশন খুঁজতে সাহায্য করেন।

সে সময়ই তিনি রেঁনোয়াকে পথের পাঁচালীর কথা বলেন। রেঁনোয়া তাকে উৎসাহ দেন। ১৯৫০ সালে ডি জে কিমারের হেডকোয়ার্টার লন্ডনে যান সত্যজিৎ। লন্ডনে ছয় মাসে তিনি ৯৯টি ছবি দেখেন। এর মধ্যে ডি সেকার বাইসাইকেল থিভস তাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করে।

হল থেকে বেরিয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছবি পরিচালনা করবেন। রেঁনোয়া, ডি সিকার বাইসাইকেল থিভসের পাশাপাশি কুরোশাওয়ার রসোমন এবং বিমল রায়ের দো বিঘা জমির আন্তর্জাতিক সাফল্য তাকে দ্রুত অনুপ্রাণিত করে। ৩. এ ছবির অনেক দৃশ্যই আলাদাভাবে আলোচনার দাবী রাখে। ট্রেন দেখতে কাশবনের মধ্যে অপু-দূর্গার ছুটে যাওয়া শৈশবের আগ্রহ, কৌতুহল আর দূরন্তপনার দূর্লভ উদাহরণ। দূর্গার চুরি করা হারটি অপু একটি পানা পুকুরে ফেলে দেয়।

ধীরে ধীরে পুকুরের পানা যেন মৃত দূর্গার চুরি অপরাধ ঢেকে দেয়। কন্যার মৃত্যুর কথা আবিষ্কার করে হরিহরণ যেভাবে বসে পড়ে শোক ও বিহ্বলতার ভিন্নতর প্রকাশ পায় তাতে। ৪. অপুর চরিত্রের অভিনেতার জন্য সত্যজিৎ পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেন। ৫ থেকে ৭ বছরের বহু শিশুর সাক্ষাৎকার নেন তিনি, কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারেন না। অবশেষ তার স্ত্রী বিজয়া রায় পাশের বাড়িতে সুবির ব্যানার্জিকে আবিষ্কার করেন।

সুবির ব্যানার্জি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন অপুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। এক সময়ের মঞ্চ অভিনেত্রী চুনিবালাকে পতিতাপল্লী থেকে নিয়ে আসা হয় ইন্দির ঠাকুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে। কলকাতারা নিকটবর্তী বড়াল গ্রামের [শুটিং লোকেশন] বহু লোক এ ছবিতে অভিনয় করেছেন। ৫. এ ছবির চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্র জীবনে কখনো মুভি ক্যামেরা চালাননি। ২১ বছরের এই তরুণ রেঁনোয়ার রিভার ছবিতে স্টিল ফটোগ্রাফি করতেন।

সেই সময় থেকে সত্যজিৎ-এর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সত্যাজিৎ রায়ই তাকে পথের পাঁচালী’র চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব দেন। পরবর্তীতে সত্যজিৎ-এর বহু ছবির চিত্রগ্রাহক হিসাবে সুব্রত প্রচুর সম্মান ও পুরষ্কার অর্জন করেন। সুব্রত মিত্র এ ছবির আবহ সঙ্গীতে সেতারও বাজিয়েছেন। ৬. এ ছবির অর্থ জোগান দিতে সত্যজিৎ রায় গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ করেন, নিজের জীবন বীমার স্কিম বিক্রি করেন, প্রিয় এলপি রেকর্ডগুলো বিক্রি করেন, তার স্ত্রী বিজয়া রায় সব গয়না বন্দক রাখেন।

তবু অর্থভাবে প্রায় এক বছর শুটিং বন্ধ থাকে। সত্যজিৎ রায় পরে বলেছিলেন, এ দেরী তাকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছিলো এবং তিনটি অলৌকিক বিষয় তাকে রক্ষা করেছে :‘প্রথমত অপুর কণ্ঠ ভেঙে যায়নি, দূর্গা বাড়েনি এবং ইন্দির ঠাকুর মারা যাননি। ’ পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় এর হস্তক্ষেপে সরকারী অর্থ সাহায্যে এ ছবি শেষ হয়। ছবি শেষ হতে তিন বছর লেগেছিলো। ৭. ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট পথের পাঁচালী কলকাতার সিনেমা হলে মুক্তি পায়।

শুরুতে এ ছবি কলকাতার দর্শককে খুশি করতে পারেনি। সপ্তাহ দুয়েক পর কিছু দর্শক হলে আসতে থাকে। পরবর্তীতে আরেকটি হলে টাকা সাত সপ্তাহ এ ছবি চলে। বিধান চন্দ্র রায় ভারতে প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে দেখানোর জন্য কলকাতার একটি হলে এর আলাদা শো’র ব্যবস্থা করেন। তিনি ছবিটি পছন্দ করেন এবং তার কারণেই ছবিটি শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালের কান ফিল্ম ফ্যাস্টিভালে অংশ গ্রহণ করতে পারে।

এর আগে অনেকেই অভিযোগ করেন এ ছবি ভারতে দারিদ্র্যকে তুলে ধরছে, এতে করে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এমনকি এ ছবির সাফল্য যখন প্রমাণিত ১৯৮০ সালে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী [মাদার ইন্ডিয়া] ও সংসদ সদস্য নার্গিস দত্ত সংসদে বলেছিলেন, এ ছবির ভারতের দারিদ্র্যকে পূঁজি করছে। ফ্রান্সের চলচ্চিত্র পরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্র“ফো বলেছিলেন, ‘চাষারা তাদের হাত দিয়ে ভাত খাচ্ছে এমন ছবি আমি দেখতে চাই না। ’ অন্যদিকে জাপানের পরিচালক কুরোশাওয়া বলেছিলেন, ‘এ ছবির দেখার পর আমার মনে যে রোমাঞ্চ হয়েছিলো তা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। এরপর আমি বহুবার এ ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি এবং প্রতিবারই আপ্লত হয়েছি।

৮. এ ছবির পথ ধরেই ১৯৫৬ সালে অপরাজিত এবং ১৯৫৯ সালে অপুর সংসার নির্মিত হয়। এই তিনটি ছবি সারা বিশ্বে অপু ট্রিলজি বলে খ্যাত।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.