আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংসদীয় গণতন্ত্র ও জনগণের রাজনীতি

আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।

সংসদীয় গণতন্ত্র ও জনগণের রাজনীতিঃ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন। ১৪ দলের নেতৃত্বে দেশের জনগণের ২৩ দফা আর্থ-সামাজিক অসাম্প্রদায়িক ন্যূনতম কর্মসূচী ও ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, চরম রাজনৈতিক সংঘাত ও নৈরাজ্যকর এক পরিস্থিতিতে সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১/১১-এর প্রেক্ষাপট নানা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

কারণ সে সময় এর গ্রহণযোগ্য সাংবিধানিক এখতিয়ারাধীন যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত, সে পথে ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালিত হয় নি। তবে চারদলীয় জোটের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার মানসে সাজানো বাগান নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ড. ইয়াজুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক ভেঙে দেওয়া দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। ১/১১-এর পরিবর্তনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দীর্ঘ দুই বছর জনগণের অনুমোদন দেশ পরিচালনা ছিল অসাংবিধানিক। তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। ড. ফখরুদ্দীন সরকারের সময় বড় দলগুলোর রাজনৈতিক নেতাদের ওপর একটি বড় ধাক্কা আসে।

এ ধাক্কাটি ছিল স্বাভাবিক ছিল না। আমরা স্বীকার করি, বুর্জোয়া রাজনীতিক-আমলা-ব্যবসায়ীরা এতটাই দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল, যা দেশের মানুষের কাছে মোটেও কাম্য ছিল না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, দলীয় ও গোষ্ঠীস্বার্থে তারা দেশ-জাতি-জনগণের কথা ভুলে গিয়েছিল। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম, শোষণ-লুণ্ঠন, স্বেচ্ছাচারিতা, সামাজিক অনাচার, স্বজনপ্রীতি বুর্জোয়া রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থাকে কলুষিত করে তুলেছিল। জনগণ এ থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিল।

সেটা কী হয়েছে? হয় নি। রাজনীতিকরা এত বড় একটা ধাক্কার পরও পুরনো অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নবম জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পর দেশের মানুষ ভেবেছিল এবার হয়তো সংসদ স্বাভাবিক গতিতে চলবে। নতুন ধারার রাজনীতির স্লোগান দিয়ে শীর্ষ দলগুলো মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেও পুরনো খোলস থেকে তারা এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। দুর্নীতিবাজ হিসেবে থ্যাত ও চিহ্নিত রাজনীতিক-আমলা-ব্যবসায়ী লোকজনকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের একটি অশুভ তৎপরতা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাতম চারদিকে দৃশ্যমান। যে প্রত্যাশা নিয়ে জনগণ বিগত নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল সেখানেও আশাব্যঞ্জক নয়। বড় দলগুলোর বা বুর্জোয়া রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বড় দলগুলোর রাজনীতিকরা হিংসাত্মক রাজনীতির দিকেই ধাবমান। জনজীবনের সমস্যা-সংকট নিরসন ও সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনে জনগণের গণতান্ত্রিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বড় দলগুলো বড়ই উদাসীন।

তা অবস্থাদৃষ্টে অনুমান করা যায়। জনগণের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে নয়, শুধু শুধু সংসদ বর্জন সংসদীয় গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে স্বাভাবিক রীতি-নীতি হতে পারে না। অবশ্য সংসদ বর্জন দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। নব্বই-পরবর্তী যে ক'বার সংসদ গঠিত হয়েছে (বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারি '৯৬ ছাড়া) প্রতিবারই দেখা গেছে বিরোধী দলের সাংসদদের সংসদ বর্জনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সরকারি দলের সাংসদরাও বেশিরভাগ সময় সংসদে থেকেছেন অনুপস্থিত।

যে প্রত্যাশা নিয়ে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠায় সাংসদ হয়ে তারা সে দায়িত্ববোধের কথা ভুলে যান। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংসদ হওয়ার কথা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। অথচ দেখা যায় ধারাবাহিক বর্জনের মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রকে করা হয় অকার্যকর। আওয়ামী লীগও বিগত সংসদে বিরোধী দল হিসেবে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ ছিল না। ধারাবাহিক সংসদ বর্জনের মধ্য দিয়ে সে সময় তারাও তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথারীতি পালন করেননি।

তখন বিএনপি সরকারি দল হিসেবে সে সময় সংসদ পরিচালনায় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সদিচ্ছা ও নিষ্ঠার যথেষ্ট অভাব ছিল। কিন্তু বিগত সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনীতিকদের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল এবার যে সংসদ গঠিত হবে তা হয়তো হবে কার্যকর ও গঠনমূলক। কিন্তু সংসদ নির্বাচনের পর নবগঠিত সংসদের প্রথম অধিবেশনেই আমরা যা লক্ষ্য করলাম তা অত্যন্ত হতাশাজনক। একটুও বদলায়নি বুর্জোয়া রাজনীতিকদের মানসিকতা। বিরোধী দল প্রথম সারিতে আসন সংখ্যা কম দেওয়া হয়েছে বলে সংসদ বর্জন করে আর ফেরেনি।

প্রথম সারিতে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সংসদের একটি নিয়ম বা পদ্ধতি রয়েছে। বর্তমান বিরোধী দল একাধিকবার সংসদে সরকারি দল হিসেবে সংসদ পরিচালনা করেছে। সে সময় কী পদ্ধতিতে প্রথম সারিতে বিরোধী দলকে কয়টি আসন দেওয়া হয়েছিল তা নিশ্চয়ই তাদের জানা আছে। সে হিসাব করলেই তো সমস্যার সমাধান হওয়ার কথা। স্পিকার আবদুল হামিদ সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আসন বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এখন অবশ্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সব মামলা প্রত্যাহার, তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন, সংসদে প্রথম সারিতে আসন বৃদ্ধিসহ আরও কিছু দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, যা মানলে তারা সংসদে যাবে অন্যথায় নয়। রাজনীতিতে দরকষাকষি, কৌশল থাকতেই পারে। তবে তা অবশ্যই জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হতে হবে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জনজীবনের সমস্যা-সংকট নিরসন ও সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনে জনগণের গণতান্ত্রিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উত্থাপন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই একটি অংশ; কিন্তু সংসদে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে এ ধরনের দরকষাকষি অনভিপ্রেত। বিরোধী দল সংসদে গিয়ে তাদের দাবিগুলো সংসদে জোরালোভাবে উত্থাপন করবে, না মানলে ওয়াকআউটসহ বিভিন্ন পন্থা রয়েছে।

সরকারি দলের পক্ষ থেকে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করলে তারা জাতির সামনে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে। সংসদকেই করতে পারে দাবি আদায়ের ক্ষেত্র। সংসদীয় গণতন্ত্রকে যেখানে শক্তিশালী ও কার্যকর করা দরকার। কিন্তু তা না করে বিরোধী দলের ধারাবাহিক সংসদ বর্জন কোনো ইতিবাচক দিক হতে পারে না। স্পিকার আবদুল হামিদের সাম্প্রতিক অনুরোধের প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দলের চিফ হুইফ জয়নাল আবদিন ফারুক এমপি ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, শুধু আসন বণ্টনের জন্য বিরোধী দল সংসদ বর্জন করেনি।

তাহলে প্রমাণিত হয় শুরুতে আসন বণ্টন নিয়ে তাদের সংসদ বর্জন ছিল একটি অজুহাত মাত্র। বিগত নির্বাচনে বিএনপি জোট ধরাশায়ী হয়েছিল। অনেক বড় বড় নেতা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির গত স্থায়ী কমিটির কোনো সিনিয়র নেতাই নির্বাচিত হতে পারেননি। তারা চান না সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী হোক।

দলের ভেতর থেকে তারাই নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, যাতে সাংসদরা সংসদে যেতে না পারেন। সংসদে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে বিএনপির মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়। যে কারণে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে বিএনপি। রাজনীতিতে ওঠানামা আছে, আছে জয়-পরাজয়। নির্বাচনে প্রত্যাশিত আসন না পাওয়া বা কম আসন পাওয়া কোনো বিষয় নয়।

মূল বিষয় হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত্বে সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করা। স্বাধীনতার পর গণপরিষদ মাতিয়ে রেখেছিলেন বিরোধী পক্ষের মাত্র দু'জন সাংসদ, ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা) ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা)। '৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময় সংসদে ওয়ার্কার্স পার্টি ও আওয়ামী লীগের মাত্র ৩৯ জন সাংসদ সরকারি দলকে চাপিয়ে রাখতেন। মূলত বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চান কি-না তার ওপরই সংসদের কার্যকারিতা নির্ভর করে। সংবিধান অনুসারে সংসদের অনুমতি ছাড়া একাধিক্রমে নব্বই বৈঠক দিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে সংসদ সদস্যপদ শূন্য হয়।

নব্বই দিবস পূর্ণ হওয়ার আগেই হয়তো তারা একদিনের জন্য সংসদে এসে সদস্যপদ ঠিক রাখবেন। কিন্তু জনগণের কাছে এটি প্রত্যাশিত নয়। বিরোধী দলের সাংসদরা কার্যকর, গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভূমিকার মধ্য দিয়ে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন স্বাভাবিকভাবে দেশের জনগণের এমনটিই প্রত্যাশা। নিয়ম রক্ষা বা সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার জন্য সংসদে যাবেন অন্যথায় নয়। এটি সংসদীয় গণতন্ত্র ও রাজনীতির জন্য কোনো শুভ দিক হতে পারে না।

সরকার ও বিরোধী দল গঠনমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে দেশের উন্নয়নসহ জনজীবনের সমস্যা-সংকট সমাধানে বর্তমান সংসদকে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ও কার্যকর করবে বলে দেশের মানুষের প্রত্যাশা। গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনগণের সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে সংসদ। সেই সংসদকে কার্যকর ও গঠনমূলক করতে সব সাংসদেরই দায়িত্ব রয়েছে। পরিবর্তনের রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে দেখতে চায় দেশের মানুষ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.