আজ আমার শান্তিনিকেতন ঘোরার গল্প বলবো।
প্রথম যেবার শান্তিনিকেতন যাই তখন খুবই ছোট ছিলাম। পাপার সাথে গেছিলাম। সঙ্গে পাপার বন্ধুও ছিলেন। কোন ভর্তির পরীক্ষা ছিল।
বিশাল হলঘরে অনেক অনেক ছেলে-মেয়ে মাটিতে বসে পরীক্ষা দিই। মায়ের উপর একটা রচনা দেয়। কি লিখব একজন টিচারকে জিজ্জেস করি। তিনি ব্যাস্ত ছিলেন। কিছু লিখতে হবেনা বলেন।
পাপা একজনকে প্রণাম করতে বলেন নাম বল্লেন-গোরাদা।
খুব সুন্দর কুটিরের মত কটেজ়ে ছিলাম। আমার একজন বন্ধুও হয়। বিকেলে সামনের নুড়িপাথরের রাস্তা দিয়ে হাত ধরে হেঁটে আমরা একটা বড় ভাঙা পাঁচিলের কাছে গেছিলাম। বন্ধুটি আমার একটু মুটকু–সুটকু ছিলেন।
গোল ফ্রক পরা। আমরা পাঁচিলের ফাটল দিয়ে ওপারে বড় ছেলেরা ফুটবল খেলছিল দেখছিলাম।
সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম গাছের নিচে ক্লাস হচ্ছে আর বড় দিদিরা শাড়ি পরে সাইকেল চালিয়ে হুস্ হুস্ করে যাচ্ছে দেখে।
এর বেশি সে স্মৃতিতে নেই।
এর বহু বছর পর হঠাৎ একটা বসন্ত উৎসবে -দোলের আগেরদিন রাতে পিসি ফোন করে বলে ‘কাল শান্তিনিকেতন যাবি?’ আমিও এককথায় রাজি!
ডাইরীর সে স্মৃতি তুলে দিচ্ছি-
ভোর চারটে উঠে শনিবার ৬টার ‘গণদেবতা’ ধরি, পাপা হাওড়ায় পৌঁছে দেয়।
ট্রেনে উঠে বসলাম। জানলার ধারে আমি, পাশে পিসিমণি। তারপাশে একজন –মনেহয় অবাঙালী-চোখদুটো সুন্দর, লম্বা-চুপচাপ। উল্টোদিকে মা, মেয়ে। পাশে একজন মাঝবয়সি।
ভীড় বেশ! তবু, যাওয়াটা ভালই লাগলো-অনেকদিন পর জমির পর জমি-কত গাছপালা!
শান্তিনিকেতন পৌছে প্রথমেই ফেরার টিকিট কাটা হল-কিন্তু রিজার্ভেসন হল না।
রিক্সায় উঠে হোটেল বা লজ্ যেতে বল্লে রিক্সাওয়ালা বল্লো আজ কিছুই পাওয়া যাবে না। সব বুকড! অনেক খুঁজে, বলে-কয়ে একজনদের বাড়ি থাকার ব্যবস্থা করা গেল। ছোট্ট ঘর।
তারপর আমরা বেরলাম শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে।
ততক্ষণে ১১টা বেজে গেছে! যেতে যেতে দেখছি সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা পুরুষ আর হলুদ শাড়ি-সবুজ পাড় নারী, আবীরে রাঙানো। সবাই আবীরে খেলেছে।
মেয়েদের মাথায় পলাশকুঁড়ির মালা। আবীরে রাঙানো হলুদ শাড়ি পরা মেয়েরা কি সুন্দর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। সবাইকেই খুব সুন্দর লাগছে।
মনে মনে ভাবছি-গিয়ে দেখবো সব ফাঁকা। যাক্, পৌছানো গেল! রাস্তায় দেখছিলাম সাধারণ মানুষজন এখানকার মতই বাঁদর রঙে রেঙে মদ খেয়ে গান করছে। সেটাও খারাপ লাগছিলো না।
তো, প্রপার রবীন্দ্রনাথের স্থানে যাওয়া হল। যেখানে খেলা হয়েছে সেটা বড় মাঠ মনে হল।
যাওয়ার পথে টিচারদের কোয়াটারের পাশ দিয়ে গেলাম। একটা ছোট্টছেলে, ৪-৫ বছর বয়স হবে- সবার দেখাদেখি তার হাতেও আবীরের প্যাকেট- আমাদের দেখে আদো আদো করে বলছে-‘রঙ দেবো, তোমাদের রঙ দেবো’। একটু আদর করে চলে এলাম।
মাঠে ঢোকার সময় পিসিমণি শশা কিনলো। তাই খেতে খেতে চলেছি।
সবাই আবীর খেলছে-প্রথমটা মনেহল আমাদেরও দেবে। তারপর দেখলাম সবাই বেশ ভদ্র-দেখছে, তবে আগ্বারিয়ে আবীর দিচ্ছে না। একটু দুঃখ হল-মনে নিশ্চিন্তি-খেতে খেতে চলেছি।
পাশ থেকে হঠাৎ কে একজন একখাবলা আবীর মাথায় ঢেলে দিল। ব্যাস! হয়ে গেল! এবার দেখে কে! আরেকদল এগিয়ে এসে হোলীর শুভেচ্ছা যানালো।
আমিও তাদেরই আবীর তাদের মাখালাম- খুব ভাল লাগছিল। এবার শুধু এগিয়ে যাওয়া আর বিভিন্নদল তোমায় ঘিরে ধরবে, আবীর দেবে হাসিমুখে। একটা দল ঘিরে ধরে আছে-তাদের সাথেই চলেছি- পিসিমনি টেনে বের করে আনলো। আমার ভালই লাগছিলো। বেশ হত ওদের সাথে চলে গেলে.........
এরপর ছাতিমতলায় বাউলদের গান শুনলাম।
একটা বাচ্চা বহুরূপী হনুমান সেজে পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পরে ভয় দেখালো। বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জটলা- কোথাও কেউ নাচছে, কোথাও বাউলগান হচ্ছে। একটা পর্যন্ত সেখানে থেকে পিসি বললো কংকালীতলা ঘুরতে যাবে। পিসিমণির খুব উৎসাহ। থাকার জায়গাটা হয়েছিল বোলপুর কলেজের পাশে, বেশ গলিতে।
সেখানে ফেরার ইচ্ছে ছিলনা, রাতটুকু কেবল কাটানো।
রিক্সায় করে চললাম কংকালীতলা। অনেকটা পথ। প্রচন্ড রোদ-তেমনি হাওয়া! তবু, বেশ ভাল লাগছিলো-বুড়ো রিক্সাওয়ালা নিজের রিক্সা খুব ভালবাসে। এদিক ওদিক হাত দিলেই খিট্ খিট্ করছে।
তো, তার সাথে গল্প করতে করতে চললাম।
যেতে যেতে দেখছি, ধূ ধূ জমিগুলো একা, ন্যাড়া পরে আছে। দুর দুর, বহু দুর পর্যন্ত ন্যাড়া জমি- ধান কাটা হয়েগেছে। গোড়াগুলো শুকিয়ে গেছে। অনেক দুরে দুরে একটা করে তালগাছ।
এত রুক্ষ প্রকৃতি! কিন্তু এরও একটা সৌন্দর্য আছে। একা জমির কথা ভাবছিলাম, কোন গাছ নেই যে একটু ছায়া দেয়! রোদ-রোদের তাত - তাও খারাপ কি!
পথে যেতে যেতে অনেক বলদের পাল দেখলাম, গায়ে রঙ- রিক্সাওয়ালা বললো ওদের ওপারে বাঙলাদেশে নিয়ে যাওয়া হবে। পরে মাংস হয়ে পারি দেবে বিদেশে। ওরা কি তা জানে? একবার মনেহল নেমে ওদের কানে কানে বলে আসি। কিন্তু বলেই বা কি হবে-ওরা কিবা করবে! শুনে কষ্ট পাবে- হয়তোবা ওরাও যানে ওদের ভবিষ্যৎ! যারা ওদের হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে-তাদেরও ওদের মতই চোখ ঠেকরানো দশা।
খুবই গরিব! আমার মত বাজ়ে চিন্তার সময় নেই-খাঁ খাঁ রোদে একভাবে পাল পাল গরু নিয়ে দ্রুত চলেছে।
পথে সোনারতরী, মহুয়া, আরো অনেক বড় বড় লজ, হোটেল, রেস্টুরেন্ড পরলো-দেখলাম। অনেক সুন্দর সুন্দর বাড়ি- কিন্তু ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে সব স্তব্ধ। দেখে বোঝা গেলনা এদের প্রাণ স্পন্দিত হয় কিনা। শুনলাম মালিকরা বাইরে থাকে।
তারপর কত ছোট ছোট গ্রাম। যেমন- আদিত্যপুর, তার স্কুলের সামনে দিয়ে চলেছি। কালো কালো মেয়ে-কোলে কালোসোনা ছেলে। ওদের দেখে বিরাংকে মনে পরলো-এরাও ওর মত সেই নতুন সবুজ ডাটার মত সোজ়া-সতেজ।
অনেক পথ চললাম।
পাশ দিয়ে হুস্ হুস্ করে একটা দুটো গাড়ি চলে যাচ্ছে। পথে কত মাটির কুঁড়েঘর, বাছুর, ছাগল- তার ছানা, হাঁস, ভ্যাড়া, মুরগি! অনেকদিনপর ওদের একসাথে দেখে ছবির মতো মনে হলো।
শেষে কংকালীতলায় পৌছালাম। দেবীর কাঁকন এখানে পাওয়া যায়। ভেবেছিলাম অন্যস্থানের মতই মূর্তি পুজো হয়।
কিন্তু এখানে বাঁধানো পট বা ছবি পূজো হচ্ছে। পাশে সেই জলপাইগুড়ির লোটাকালীমন্দিরের মত -পুকুর। অনেকগুলো বাপ্পার মত ছেলে খুব ভক্তিভরে পূজো দিচ্ছে। একজন আবার দোলনা না কার নামে পূজো দিলো, অন্যরা তাকে খেপাচ্ছিলো।
আমরা কোপাই নদী দেখতে চললাম।
মন্দিরের পাশে অনেকগুলো উনুন মাটিতে কাটা। মন্দিরের পেছন দিয়ে বয়ে চলেছে কোপাই। খাঁড়া সিড়ি, নেমে গেলাম। একটা ছেলে খুব সাঁতার কাটছে। আরেকজন ফর্সা, গোলগাল-শহুরে ছেলে ঘাটেই স্নান করছে।
আমরা সিড়িতে বসলাম। নদীর জলে পা ডুবিয়ে খুব মনে মনে সাঁতার কেটে নিলাম। চারদিকে এত গরম! কিন্তু কোপাই-এর জল অদ্ভুত ঠান্ডা। শরীর জ়ুড়িয়ে গেল। মুখ-হাত-পা ধোয়া হল।
মাথায় তখনও আবীর ভর্তি! উঠে আস্তে পাশে একটা লোক জোরে জোরে গান ধরলো। শুনতে বেশ মজাই লাগছিল। ...
কংকালীতলা দেখে আবার ফিরে চললাম। এবার গন্তব্য ডিয়ার পার্ক।
পথে গ্রামের লোকরা ঢোল, খঞ্জনী নিয়ে, আবীর রঙ মেখে গান করতে করতে চলেছে।
একই পথ দিয়ে ফিরে শান্তিনিকেতনের প্রায় কাছাকাছি ‘ডিয়ার পার্ক’। ৩.১৫য় ঢুকলাম আর ৪টের ভেতর বেরতে হবে।
এই প্রথম এমন পার্ক দেখলাম। হরিণগুলো একটু দুরেই আপন মনে চরছে। প্রথমে দৌড়ে ধরতে ইচ্ছে করলেও-ওদের দেখে আমার আত্মীয়ই মনে হল।
ওরাও আমাদের কিছু বলছে না- আমরাও ওদের একহাত দুর থেকে দেখছি।
ডিয়ার পার্কটা খুব সুন্দর। বিশাল বড় বড় শালগাছ, তলায় শুকনো পাতার স্তুপ! তার উপর দিয়ে হাটতে কি যে মজা! কচর-মচর আওয়াজ হচ্ছে। ইচ্ছে করে আরো পা চালাচ্ছি। ঘাস নেই, জমি খুব শুকনো।
মাঝে মাঝে ক্ষয়ে গিয়ে খুব উঁচু-নিচু পথ করেছে, পাথুরেও মনে হল। কিছু গাছের শিকড় বেরিয়ে উঁচু হয়ে আছে। লোক খুবই কম। একটা হেলানো গাছে উঠে বসলাম। পিসি খুব গাছটা নাড়ালো-ছোটদের মত দোল খাওয়া হলো, মজা লাগলো।
তারপর ফেরার সময় দেখলাম পথ হারিয়ে ফেলেছি। অনেক ঘুরলাম। দুরে দু’জনকে দেখে তাদের পিছু পিছু বার হওয়া গেল।
পিসি একটু ঘাবড়ে গেছিলো। তাড়াতাড়ি উপর থেকে নামতে গিয়ে পরে হাত-পা ছড়ে গেল।
আমরা বের হতেই গেটটা বন্ধ করে দিল। যদি ভেতরে থেকে যেতাম, কি হত কে জানে!
আবার ৫টা নাগাদ শান্তিনিকেতন পৌছলাম। STDবুথ থেকে বাড়িতে পিসি ফোন করছে আর আমি দেখছি পাশেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। গান, কবিতা পাঠ হচ্ছে। পিসি কথা বলেই যাচ্ছে, আর আমি দেখছি বিকেলে সবাই কি সুন্দর আরো সেজেগুজ়ে এসেছে।
আমি বুথের কাঁচের দরজ়ায় নিজ়েকে দেখলাম। ভাল লাগলো না, ঝোড়োকাক লাগছে। সেই কখন কোপাইএ মুখ ধুয়েছিলাম। এখনও সেই আবীরের সাজ।
একটু খাওয়া–দাওয়া করে পাশের মেলা ঘুরে মাটির বিশাল মালা-দুল কিনে টপাটপ চাপিয়ে নিলাম।
চুলটাও আচড়ে নিলাম।
তারপর আবার সেই সকালে যেখানে আবীর খেলা হয়েছিল, সেখানে গেলাম। স্টেজে আলো। নিচে অসংখ্য মানুষ বসে। ভিড়ে আমরাও বসে পরলাম।
বসে আছি, বসে আছি-৭টায় অনুষ্ঠান শুরু হল- ‘মায়ার খেলা’।
এদিকে পিসি খুবই ক্লান্ত। মাটিতেও বসতে পারেনা। আমার বেশ ভাল লাগছিল, এদের মঞ্চে কোন আড়ম্বর নেই। যারা নাচছে তাদের ভঙ্গিমাও অদ্ভুত কোমল! কিন্তু পিসি আর বসে থাকতে পারছে না।
ফিরতেই হল।
পথে অনেকগুলি মেয়ে হাই-হ্যালো করলো, পরে ভুল বুঝতে পেরে হেসে ফেললো-আমিও ওদের সাথে হাসলাম।
ভাত খেয়ে, কয়েল কিনে ৮.৩০এ সেই বাড়িতে এলাম। এসেই ঘুম।
ভোর ৫টায় উঠে আবার ট্রেনের জন্য স্টেশন।
যেতেই গয়া এক্সপ্রেস পেলাম। কেউ তেমন উঠলো না, আমরা উঠে বসলাম। এরকম ট্রেনে কখনও উঠিনি। আর কখনও ওঠার ইচ্ছেও নেই। পুরো প্রায় ফাঁকা! প্রথমটা উঠে মজা লাগলো।
অন্য কামরাগুলো একা ঘুরে দেখতে গিয়ে দিনেও গাটা কেমন ছম্ছম্ করে উঠল। আবার পিসির পাশে এসে বসলাম।
সে সময় আবার খুব বৃষ্টি শুরু হল। জানলা বন্ধ করতে হল। উল্টোদিকে ক’টা ছেলে আমাদের সাথেই উঠেছে।
তারা গল্প করছে, হাসছে। মোটেও ভাল লাগছিল না। বৃষ্টি একটু ধরতেই আবার জানলা খুলে বাইরে চোখ রেখে বসে আছি।
কিন্তু বর্ধমানে ওরা নেমে যেতে আরো খারাপ লাগলো। পুর বগিটা ফাঁকা।
আমি আর পিসি। আর ওদিকে একটা লোক। যাওয়ার সময় প্রচন্ড ভিড় ছিল, ফিরতে এত্ত ফাঁকা! আবার একটু ঘুরে এলাম, দরজার কাছে দাড়ালাম। সত্যি মানুষ ছাড়া থাকাই যায় না! আপন মনে ডায়রীর সাথেই কথা বলছিলাম হয়তো। এক সময় ঘুমিয়েও হয়ত পরেছিলাম।
হাওড়ায় ট্রেন ঢুকতে পিসি ডাকলো। তারপর বাস ধরে বাড়ি।
এরপরও একটা বিশাল ফ্যামেলি ট্রিপ হয়। পুর বোলপুরের বিভিন্ন স্থান ঘোরা হয় বেশ কিছুদিন ধরে। শেষদিনটি নির্দিষ্ট থাকে ‘শান্তিনিকেতন’-এর জন্য।
সেদিনের স্মৃতিও দেবো - ডায়রী থেকেই!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।