ডাইরী থেকে-
আজ রামপুরহাট থেকে শান্তিনিকেতন পৌছালাম। স্টেশনের ভোজনালয়েই পুর ১৯জনের দল মাছ-ভাত খেয়ে পেট পুজো সাঙ্গ করলাম। গাড়ি ঠিক করাই ছিল। বেলা একটায় আমি আবার শান্তিনিকেতন এলাম।
প্রথমেই মিউজিয়াম যাওয়া হল।
বেশি সময় ছিলনা তবু আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
সবচেয়ে ভাল লাগলো পুরান অদেখা ছবিগুলো। যেমন – তিনমেয়েকে নিয়ে মৃণালিনী দেবী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের দাড়ি কামানো মুখ, নিচের ঠোট থেকে অনেকটা যেন হেমন্তকুমারের মত লাগলো!
এছাড়া, কত সুন্দর সুন্দর সামগ্রী। জুতো, ছোট্ট কফি মেসিন, গাউন, কোন এক রাজার দেওয়া তানপুরা, জাপানী পাখা-এগুলোই এখন চট্ করে মাথায় আসছে। নোবেলটা চুরি গেছে তাই তার রেপ্লিকা দেখেই সন্তুষ্ট হতে হল।
ওখান থেকে বেরিয়ে পাশে যত্নে রাখা তার কালো গাড়িটা দেখলাম। যার সামনে আরো দুটো চাকা এমনিই লাগালো।
এরপর সেই বিখ্যাত পাঁচটি বাড়ি দেখতে চললাম।
‘উদয়ন’ বন্ধ ছিল।
‘কোণার্ক’ গেলাম।
ভেতরে ছোট্ট ছোট্ট ঠান্ডা ঠান্ডা ঘর। বাইরে বসার জায়গাটা কি সুন্দর করে দেশীয় আসবাবেই সাজান।
এরপর ‘শ্যামলী’-যেন মাটির বাড়ি- পরে শুনলাম শ্যামলীকেই যতটা সম্ভব আগের মত রাখার চেষ্টা হয়েছে। এটি নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে হয়। গান্ধীজী সস্ত্রীক শ্যামলীতে ছিলেন।
আমরা শীতকালে এলেও এখানে প্রচন্ড রোদের তাপ! কিন্তু বাড়িগুলোতে ঢুকে প্রাণ যেন শান্তিতে জুড়িয়ে যায়- এত ঠান্ডা! শ্যামলীতে ছোট ছোট অনেক ঘর ছিল। যেন আমার নিজের ঘর! একটাতে বসে আঁকা শেখাই, অন্যটাতে গান, তার পাশেরটাই নাচের ক্লাস হয়। খুব আপন।
এছাড়া ‘পুনশ্চ’ আর ‘উদীচী’ বন্ধ ছিল। ‘উদীচী’টা মনেহল বৃদ্ধাশ্রম।
কারণ, জানলা সব খোলা আর সামনে কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন।
সামনেই বিশাল গোলাপের বাগান। কিন্তু সবচেয়ে শান্তি এই ছড়ান বাড়িগুলোর মাঝে মাঝে ছোট ছোট গাছের বিশ্রামশালা। মানে লোহার আর্চ, মাঝে পাকা বসার স্থান-সবটাই গাছে ঢাকা। সকলেই একটু একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল।
রবীন্দ্রনাথও এসব স্থানে থাকতেন, ঘুরতেন ভেবে সবাই মনে মনে নিশ্চয়ই আনন্দিত হচ্ছিল আর আজ নিজ়েরাও ঘুরছে ভেবে গর্ববোধ করছিল। তাদের দলে আমিও ছিলাম।
এখান থেকে আমরা বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে গেলাম। সরকারী গাইড নেওয়া হল। তিনি বেশ মানুষ! গান গেয়ে গেয়ে খুব সুন্দর করে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে সব দেখালেন, বোঝালেন।
যতটা মনে পরছে বলছি।
প্রথমে ‘কলাভবন '। এখানে অনেক ছোট-বড় মূর্তি আছে। রামকিঙ্কর বেইজের ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘কলের ডাক’- ভাষ্কর্যগুলো দেখলাম। প্রথমে নাকি লোহার মডেল বা খাঁচা করে হালকা ভাবে প্রলেপ দিয়ে দুর থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে এগুলোর সৃষ্টি।
‘কালোবাড়ি’ দেখলাম। এটা মাটির তৈরি কিন্তু আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া। কালোবাড়ির গায়ে বিভিন্ন ভারতীয় কলার কাজ।
সত্যজিতের ‘ইনার আই’-এ বিনদবিহারীর তৈরি দেওয়ালের কাজও দেখেছি। এছাড়া মিউরাল বা মুরাল আর্ট।
নন্দলাল বসুর আঁকা দেওয়াল চিত্র, যেমন-চিত্রাঙ্গদা, শ্যামলী আরো কত! এখন গুলিয়ে যাচ্ছে।
যেগুলোর কথা ভোলার নয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লোহার কুমীর,কচ্ছপ-ভাষ্কর্য। একটা মাত্র পাথর কেটে পুংকেশর ও গর্ভকেশরের মিলন দৃশ্য। প্রচন্ড তাপে জলে সাঁতাররত মহিষের ভাষ্কর্য। শিল্পীর কল্পনায় মহিষের পেছনের পা’দুটি মাছের লেজের মত হয়ে গেছে।
এটি রামকিঙ্কর বেইজেরই করা!
এছাড়া দেখলাম সাঁচীর স্তুপের আদলে তৈরি স্থাপত্য, ছোট্ট চৈত্য।
চৈতে স্টুডেন্টদের সেরা কাজের মডেল রাখা হয়।
বিশাল ঘন্টাও লাগানো। স্কুলের কাজ়ে ব্যবহার হয়। পাশে একজন বাউল বসেছিলেন।
আমাদের দলটাকে দেখেই গান ধরলেন।
ইন্দিরা গান্ধী ছাত্রী অবস্থায় যে হোস্টেলে থাকতেন সেটাও দেখলাম, দুর থেকে।
রবীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের নামে পাঠাগারটা বড্ড চেনাচেনা লাগলো এখানেই মনে হল ছোটবেলা পরীক্ষা দিই, যদিও উৎরাতে পারিনি।
গৌড়প্রাঙ্গণ রাতে
ঘড়িবাড়ি
গৌড়প্রাঙ্গণ দেখলাম। এখানেই পিসির সাথে আসি।
ওপাশে লর্ড সিন্হার দেওয়া ঘড়িবাড়িটিও দেখা হল।
এবার এলাম ‘দেহলী'’। এখানে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে থাকতেন। যদিও মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর আর উনি এখানে থাকেন নি।
এরপর ‘আম্রকুঞ্জ’ ।
এখানে খোলা আকাশের নিচে খোলা নিচু মঞ্চে বড় বড় সব অনুষ্ঠান হয়।
তারপর ‘তিনপাহাড়’! এর কথা রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার আত্মকথায় আছে। দেবেন্দ্রনাথের উৎসাহে অসংখ্য পাথর কুড়িয়ে বুড়োবটের নিচে ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ জমিয়ে এই পাহাড় বানান- এখন বাঁধান হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ এখানে ধ্যান করতেন।
উপাসনা মন্দির -১৮৯১
এছাড়া কাঁচের ‘উপাসনা মন্দির’ও দেখা হল।
ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে প্রতি বুধবার এখানে উপাসনা হয়। এই উপাসনায় সকল ধর্মের মানুষ যোগ দিতে পারেন। এটি মহর্ষির জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজ়েন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন।
‘শান্তিনিকেতন বাড়ি’
‘অনির্বাণ শিখা’
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরি ‘শান্তিনিকেতন বাড়ি’ও দেখলাম। দেখেই ভক্তি হবে, বিশাল বাড়ি।
সামনে রামকিঙ্কর বেইজের মা ও শিশুর ‘অনির্বাণ শিখা’ মূর্তি। এর অর্থ, এক জননী শান্তিনিকেতনকে শিশুরূপে কোলে তুলে ঈশ্বরের কাছে তার মঙ্গল কামনা করছেন।
‘বকুলবীথি’ দূর থেকে দেখা হল। এখানে বকুলগাছের নিচে ক্লাস হয়। প্রতিটি গাছের নিচে বেদী করা।
সবশেষে ‘ছাতিমতলা’ গেলাম। যদিও পুরানো দুটো ছাতিমগাছই মারা গেছে। পরে ওই জায়গায় দুটি ছাতিমচারা রোপণ করা হয়।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পুর সম্পত্তি রায়পুরের জমিদারের কাছে কেনেন। প্রায় ২০বিঘে জমি।
জমিদারবাড়ি থেকে ফেরার পথে বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপর এই বিশাল ছাতিমগাছ দুটিকে দেখে তিনি অদ্ভূত আনন্দ ও শান্তি পান। গেটের মাথায় এখনও লেখা আছে, “তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি” । ।
-এভাবে আমার শান্তিনিকেতনের সাথে পরিচয়। আবার যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
এ এক অদ্ভূত অনুভূতি! কিছু বইএ পড়া, টিভিতে দেখা-সব সামনা সামনি দেখছি! এক বিশাল কর্মকান্ড, বিরাট হৃদয়ের মানুষজনের! আর সবচেয়ে বড় কথা রবীন্দ্রনাথ হয়ত, হয়ত কেন অবশ্যই এসবই নিজ়ে হাতে স্পর্ষ করে গেছেন। আজ আমি তা দেখলাম! অনেকটা অনুভব করলাম, কিছুটা হয়ত হৃদয়ঙ্গম হল। আনন্দে মন পূর্ণ হল।
শান্তির নিকেতন-“শান্তিনিকেতন” । ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।