যদি পারতাম দুঃখগুলো নিলামে বিক্রি করে দিতাম আগের দিন সন্ধ্যায়-ই ঠিক করে রেখেছিলাম পরের দিন সকালে শান্তিনিকেতনে যাব। এজন্য রাতে সাইবার ক্যাফেতে বসে শান্তিনিকেতনে যাবার ট্রেনের সময় সূচী জেনে নিলাম। হাওড়া এবং শিয়ালদাহ ষ্টেশন থেকে অনেকগুলো ট্রেন শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এর মধ্যে আমার কাছে মনে হল শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসটাই ভালো হবে। কারণ এই ট্রেনটা সকাল ১০.১০ মিনিটে ছাড়ে হাওড়া ষ্টেশন থেকে।
কাজেই সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে সঠিক সময়ে ষ্টেশনে পৌছা যাবে। এর মধ্যে কয়েকটি দোকানে যারা অনলাইনে ট্রেনের টিকেট সেল করে তাদের কাছে গেলাম টিকেটের জন্য । কিন্তু ৬৬ রুপির ভাড়া তাদের দিতে হবে ১১০ রুপি। মনে মনে ভাবলাম ব্যাটা আমি তো তোদের কাছ থেকে টিকেট নেব না, টিকেটের দাম কত তা তো আমি নেটেই জেনে আসছি। একটু দেখে নিলাম সস্তায় পাওয়া যায় কিনা।
সকাল আটটার দিকে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম। মির্জা গালিব মোড়ে চাঁদপুরের ঐ ভদ্রলোককেও ফোন করে নিয়ে আসলাম। যার সাথে আগের সন্ধ্যায় পরিচয় হয়ে ছিল। দুজন মিলে হাটা শুরু করলাম পার্ক স্ট্রীট মোড়ের দিকে। ওখান থেকেই আমাদের হাওড়া ষ্টেশনের লোকাল বাস ধরতে হবে।
মির্জা গালিব স্ট্রীট মোড় থেকে ট্যাক্সিতে হাওড়া ষ্টেশন গেলে কমপক্ষে ৮০ রুপি দিতে হবে। কে দেবে এত টাকা? রাস্তাঘাট তো আগের দিন ৬-৭ ঘন্টা হেটেই চিনে ফেলেছি। পার্ক স্ট্রীট মোড় থেকে ৬+৬=১২ রুপি দিয়ে চলে আসলাম হাওড়া ষ্টেশন। টিকেটের জন্য লাইনে দাড়ালাম। ৫ মিনিটের মধ্যে টিকেট পেয়ে গেলাম।
ভাড়া জনপ্রতি ৫৩ রুপি। টিকেট কাটা শেষ তখন বেলা পোনে নয়টা। কিছুক্ষণ ষ্টেশনের বিভিন্ন প্লাটফর্মে হাটাহাটি করলাম। হালকা নাস্তা পানি করলাম। ঠিক ১০.১০ মিনিটেই আমাদের শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে দিল বোলপুর শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে।
কলকাতাতে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম তাদের শত শত ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে কিংবা আসছে কোনো ট্রেনের সময়ের বিলম্ব হচ্ছে না। অথচ আমাদের দেশে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা ট্রেন তারপরও একটা প্রবাদ বাক্য চালু হয়ে গেছে "নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে?" তার উপর আছে টিকেট পাওয়ার বাড়তি বিড়ম্ভনা।
২৬১ কি. মি. রাস্তা আমরা পৌছে গেলাম প্রায় আড়াই ঘন্টার মধ্যেই। (শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস বাদে অন্যান্য ট্রেনে গেলে সময় লাগবে তিন থেকে সাড়ে চার ঘন্টা)। রবীন্দ্রনাথের মূল শান্তিনিকেতন, বোলপুর শান্তিনিকেতন ষ্টেশন থেকে প্রায় দ্বেড় কিলোমিটার দুরে।
নেমেই আমরা রিক্সা নিলাম শান্তিনিকেতনে যাবার জন্য ভাড়া ৪০ (চল্লিশ) রুপি। ষ্টেশন থেকে শান্তিনিকেতনে প্রবেশ মুখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সম্বলিত একটি তোরণ নির্মান করা আছে এই রাস্তা দিয়ে আপনাকে যেতে হবে শান্তিনিকেতনে। বোলপুর, ভীরবুম, ভূবনডাঙ্গা হয়ে আমাদের রিক্সা প্রবেশ করল শান্তিনিকেতনের আঙ্গিনায়। রিক্সার ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলল সামনে শান্তিনিকেতনের ক্যান্টিন আছে , খাওয়া দাওয়া করলে এখান থেকে খেয়ে নিতে পারেন। আমরাও ভাবলাম জার্নি করে এসেছি যখন যাই ক্যান্টিনে গিয়ে বসি একটু নাস্তা করি।
কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ পূজা এবং ঈদের জন্য ক্যান্টিন বন্ধ। কি আর করা। চলে শান্তিনিকেতন দেখতে এসেছি দেখেই যাই।
বিশ্ব ভারতীয় ক্যান্টিন, চীনা ভবন, বিদ্যা ভবন, পাঠ ভবন, শান্তিনিকেতন আশ্রম, শান্তিনিকেতনের সুবিশাল খেলার মাঠ, বেনু কুঞ্জ, মাধবী ছাত্রী নিবাস, ছাতিমতলা (ছাতিমতলার একটি ফলকে লেখা আছে "মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উপাসনা বেদি,আনুমানিক ১২৬৮ বঙ্গাঁব্দের চৈত্র মাসে (ইং ১৮৬২, মার্চ) এই স্থানে তাঁর প্রথম আগমন। পরবর্তীকালে এই বেদি নির্মিত হয়"।
) ইত্যাদি দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এক সময় গেলাম যাদুঘরের সামনে কিন্তু ভাগ্যে নেই, পূজা এবং ঈদের জন্য সব বন্ধ। এই জন্য মনে হয় পুরো শান্তিনিকেতন কেমন যেনো নিরব নিরব লাগছিল। কিছু পর্যটক আর নিরাপত্তার লোকজন ছাড়া শান্তিনিকেতনে কাউকেই চোখে পড়ছিলনা। কত শুনেছি শান্তিনিকেতনে সবসময় কবি সাহিত্যিকদের আনাগোনা থাকে।
কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ। তারপর মনকে শান্তনা দিলাম অনন্ত শান্তিনিকেতন তো দেখে যেথে পেরেছি। এখন আমাদের কলকাতায় ফেরার ট্রেন ধরতে হবে। শান্তিনিকেতনের প্রবেশ মুখ থেকে আবার রিক্সা নিলাম ষ্টেশনে যাবার জন্য এখন ভাড়া ৫০ রুপি। ষ্টেশনে পৌছতে পৌছতে একটা ট্রেন ছেড়ে গেল।
সমস্যা নেই এখানে প্রতি ৩০ মিনিট পর পর ট্রেন পাওয়া যায়। পরবর্তী ট্রেন মাতারা এক্সপ্রেস। এটা যাবে শিয়ালদাহ। মনে মনে ভাবলাম ভালোই হলো আসলাম হাওড়া থেকে যাবো শিয়ালদহ হয়ে দুটি ষ্টেশনেই ভালোভাবে দেখা হবে (যদিও ষ্টেশন দুটি এবং ষ্টেশনে সহজে যাওয়া আসার সহজ পদ্ধতি আগের দিনই ঘুরে ঘুরে জেনে এসেছি)। টিকেটের জন্য লাইনে দাড়ালাম।
শত শত লোক ট্রেনের যাত্রী অথচ টিকেট পেতে পাঁচ মিনিটও দেরি হল না। এবার বোলপুর শান্তিনিকেতন থেকে শিয়ালদহ'র ভাড়ার ৪৩ রুপি। টিকেট কেটে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করলাম। ঠিক ৩.৩০ মিনিটে মাতারা এক্সপ্রেস বোলপুর শান্তিনিকেতন ষ্টেশনে এসে পৌছল। হুড়াহুড়ি করে ট্রেনে উঠলাম।
কিন্তু কপাল খারাপ এবার আর সীট পেলাম না। দাঁড়িয়ে যেথে হবে। মাতারা এক্সসপ্রেস রামপুরঘাট থেকে ছেড়ে আসে বলে বোলপুর শান্তিনিকেতন জংশন থেকে সব সময় সীট পাওয়া যায় না। ষ্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে একটি গানের সুর শুনতে ফেলাম। যে সুরটি আমি হাওড়া থেকে শান্তিনিকেতন আসার সময়ও ট্রেনে শুনেছি।
প্রথম যখন শুনি তখন ভাবছিলাম হয়তো ট্রেনে মনে হয় কোনো ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজছে। না এক সময় দেখি প্রায় অন্ধ একটি ছেলে বুকে একটি স্পীকার ঝুলিয়ে মাউথস্পীকারে গান করছে। কোনো বাদ্য যন্ত্রন ছাড়া এত সাবলীল কণ্ঠে গান গেয়ে যাচ্ছে ছেলেটিকে না দেখলে বুঝার উপায় নাই বাস্তবে গান গায় নাকি ক্যাসেট প্লেয়ার চলছে। "রইব না আর সে যে আমার নানা রংয়ের দিনগুলি"। ছেলেটিকে ১০ রুপি দিয়ে আরেকটি গান রেকর্ড করে নিলাম (গানের ভিডিও লিঙ্ক )।
গান শেষ হতে না হতেই আরেক অবাক করা কান্ড সুরেশ শর্মা নামে একলোক চলন্ত ট্রেনে যে শারিরীক কসরত দেখাল, তা যেকোনো প্রশিক্ষিত সার্কেশকেও হার মানায়।
এসব দেখতে দেখতে এক সময় ট্রেন শিয়ালদহ ষ্টেশনে পৌছল। রাতের শিয়ালদহ ষ্টেশন সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ষ্টেশন থেকে বের হয়ে পার্ক স্ট্রীটের বাস ধরলাম ভাড়া ৬ রুপি। আটটার দিকে হোটেল রুমে এসে উপস্থিত।
মনের মধ্যে গেথে রইল শান্তিনিতেনের সুখ স্মৃতি, মন বলে একবার নয় বার বার যাই শান্তিনিকেতনে। ।
আগামী পর্বে থাকবে মেট্রো রেলে টালিগঞ্জ মহানায়ক উত্তম কুমার ফিল্ম সিটিতে যাবার ভ্রমণ কাহিনী এবং পরের পর্বে থাকবে কম টাকায় কলকাতা ভ্রমণের ট্রিপস সাথে আরো অনেক কিছু। সঙ্গেই থাকুন।
১ম পর্ব যারা মিস করেছেন, তারা এই লিঙ্ক থেকে পড়ে নিতে পারেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।