আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার শান্তিনিকেতন

‘এখনও অঙ্কুর যাহা তারি পথপানে

প্রত্যহ প্রভাতে রবি আশীর্বাদ আনে। ’

লাল কাঁকর বিছানো, ছাতিম ফুলের গন্ধে ভরা উদাস পথ, চলে গিয়েছে হাতের বাঁয়ে। ডান দিকে রবীন্দ্র ভবন, তোরণের দেয়ালে উৎকীর্ণ এই চরণ দুটি। প্রতিদিন খুব ভোরে এই পথ দিয়ে পাঠভবনে যায় আমার ছয় বছরের মেয়ে তিয়া। পরনে গেরুয়া রঙের স্কার্ট, সাদা ব্লাউজ, কাঁধে বইয়ের ব্যাগ।

সম্ভবত বিশ্বভারতীর সেই কনিষ্ঠ বিদেশি ছাত্রী।

বাংলাদেশ থেকে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে এক বছরের কোর্সে ভর্তি হয়েছি, সঙ্গে আমার কন্যা, সে-ও ভর্তি হয়েছে আনন্দ পাঠশালায়। দীর্ঘ ছাতিমের পাশ দিয়ে, মন্দিরের সম্মুখ দিয়ে হাঁটাপথ পেরিয়ে পাঠভবনের ছায়াঘেরা বকুলবীথি আর আম্রকুঞ্জ। গাছের তলায় বাঁধানো চাতাল, সেখানেই ক্লাস বসে ছেলেমেয়েদের। একেকটি গাছের তলায় একেকটি ক্লাস।

ঘন সবুজের নরম ছায়ায় গেরুয়ার তন্ময়তা। মাথার ওপর ঝুরু ঝুরু পড়ে ভোরের বকুল—কার আশীর্বাদের মতো!

মনে পড়ে, প্রথম যেদিন এসে পৌঁছলাম শান্তিনিকেতনে। দিনটি ২৮ আগস্ট, ১৯৮৫। কলকাতা থেকে ভোরের ট্রেনে বোলপুর এসে নামলাম সকাল সাড়ে আটটায়। হাতে মিনু আপার (সন্জীদা খাতুন) ঘরের চাবি।

আপা তখন পোস্ট ডক্টোরাল রিসার্চ করছেন বিশ্বভারতীতে। আপাতত ঢাকায় গেছেন একটা কাজে। মনের ভেতর উৎকণ্ঠা, সেদিনই ভর্তির শেষ দিন, অবশ্য আগে একবার এসে পরিচয় হয়েছিল অনেকের সঙ্গেই। স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে রতনকুঠির স্কলার্স ব্লকে, মিনু আপার ঘরে স্যুটকেস রেখে সোজা কলা ভবনে। অধ্যক্ষ কাঞ্চন চক্রবর্তী হাসিমুখে বললেন, ‘অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? আমরা তো আছিই।

’ এই বরাভয়টুকু সব সময় পেয়েছি কাঞ্চনদার কাছ থেকে।

ভর্তির ব্যবস্থা হলো, স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। কলা ভবন থেকে গেলাম আনন্দ সদন হোস্টেলে—এখানে সংগীত ভবন ও কলা ভবনের মেয়েরা থাকে। দেখা হলো জাহানারা নিশির সঙ্গে। ও সংগীত ভবনের স্নাতকের ছাত্রী।

নিশি আমার উৎকণ্ঠার ভার অনেকখানিই কমিয়ে দিল ওর সাহচর্য দিয়ে, আন্তরিকতা দিয়ে। যত দিন শান্তিনিকেতনে ছিলাম, তিয়া আর আমি সর্বতোভাবে নির্ভরশীল ছিলাম নিশির ওপরে।

পরিচয় হলো কিশ্ওয়ার কামালের সঙ্গে। ও আমারি মতো এক বছরের কোর্সে এসেছে সংগীত ভবনে। খুবই গোছানো মেয়ে।

আলাপ হলো যোয়েল তুষার বিশ্বাস বলে বাংলাদেশের একটি ছেলের সঙ্গে। ও সংগীত ভবনের ছাত্র, এক বছরের কোর্সে। একটু একটু করে পরিচয়ের পরিধি ক্রমে বিস্তৃত হলো।

মিনু আপার ঘরটি ছিল রতনকুঠির কোল ঘেঁষে, স্কলার্স ব্লকে। রতনকুঠি শান্তিনিকেতনের সবচেয়ে অভিজাত অতিথিশালা।

শান্তিনিকেতনের বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য ওটাই ছিল একমাত্র আবাস।

হালকা গেরুয়া রঙের পুরোনো ধাঁচের রাজকীয় বাড়িটি। লাল-চকচকে মেঝে, ভারী থামের বারান্দা, চওড়া সিঁড়ি। সামনে চলে গেছে লাল সুরকির পথ, দুই ধারে বিশাল কৃষ্ণচূড়া আর জাকারান্ডাগাছ—উঠে গেছে যেন আকাশ ফুঁড়ে। ঝুরু ঝুরু হলদে আর লাল ফুলে ছেয়ে থাকা পথ, সোনার রেণু ছড়ানো যেন।

মহুয়া আর ছাতিমের গন্ধে মাখামাখি, নেশা ধরানো। দু’ধারে গোলাপ বাগান, জুঁই, চামেলি আর মালতীলতার বেড়া।

মিনু আপা সেই সময় তাঁর পোস্ট ডক্টোরালের কাজ করছিলেন বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে। ওঁর সঙ্গে একই ঘরে থেকেছি আমি বাসা ভাড়া না পাওয়া পর্যন্ত। একসঙ্গে থাকতে গিয়ে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁকে।

যদিও প্রায় জন্মের পর থেকেই মীনু আপাকে জানা। মায়ের প্রিয় মানুষদের মধ্যে একজন। কাজের প্রতি তাঁর অপরিসীম নিষ্ঠা, দায়বদ্ধতা ও শৃঙ্খলা আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। ভোরবেলা চিৎপাত হয়ে বিছানায় শুয়েই টের পেতাম, ঘড়িতে কটা বাজছে। কারণ, মীনু আপা কটার সময় কী করবেন, সব আমার মুখস্ত।

চা বানানো, গলা সাধা, স্নান করে লিখতে বসা—সবই ঘড়ি ধরা। কেউ দেখা করতে এলেও দরজা খুলবেন না, জানালা দিয়ে কথা বলেই বিদায়। এরই ফাঁকে গবেষক শিল্পী কানাই সামন্ত মশায় রুমালে জড়ানো একমুঠো জুঁই রেখে যেতেন জানালার শিকের ফাঁকে।
তিয়াকে ভোর ছয়টায় স্কুলে পাঠিয়ে আমি তৈরি হতাম ক্লাসের জন্য। আপা হয় লিখতে বসতেন, নইলে কোনো কাজে বেরোতেন—দিনটা আমাদের কেটে যেত নানা ব্যস্ততায়।

সন্ধ্যার পর মুখ বুঝে থাকা ছোট ঘরটি হেসে উঠত আড্ডা আর গানে; নানা মানুষ, স্থানীয় বা বাইরের, সবার ভিড়ে। কথায়-গানে-আলোচনায় পার হতো একেকটি দিন। রাতে বিছানায় শুয়ে দুজনে গল্প করতাম—সুখ-দুঃখের বা জীবনের পাওয়া না-পাওয়ার। আমাদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ছাড়িয়ে যেত বয়সের সীমানা। কত রাত যে পার হয়ে যেত কথায় কথায়।


আলাপ হলো শান্তিনিকেতনের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে। মিনু আপা নিয়ে গেলেন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি—বোলপুরের প্রভাত সরণিতে। ওঁর দুই ছেলে ওখানে থাকতেন—বড় ছেলে সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, মেজো ছেলে দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায় ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস থেকে অবসর নিয়ে ওখানেই স্থিত হয়েছেন। স্ত্রী ক্ষমা মুখোপাধ্যায় অঙ্কে গোল্ড মেডেল পাওয়া, সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন।

ওঁদের একটি মাত্র ছেলে সায়ন, বিদেশে। ক্ষমা কাকিমার সঙ্গে গড়ে উঠল এক গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক। ওঁদের বাড়িটি ছিল তিয়া ও আমার নির্ভর আশ্রম। আমাকে ‘টুলু সোনা’ ডাকার মানুষ এই একজনই ছিলেন পৃথিবীতে।

ক্রমেই পরিচয় হলো শ্যামলী দাস্তগীরের সঙ্গে, বিখ্যাত ভাস্কর সুধীর দাস্তগীরের মেয়ে—শিল্পী ও সমাজকর্মী।

আলাপ হলো সুতপা ভট্টাচার্য্য, যিনি থাকতেন রতনকুঠির অন্যধারে, স্কলার্স ব্লকে, পাঠভবনের শিক্ষক। পরিচয় হলো মানস-গৌতম মণিদীপা, অনাথদার সঙ্গে; তাঁদের ছেলেমেয়ে টিট্টি আর বণি তিয়ার বন্ধু হয়ে গেল সহজেই। পরিচিত হলাম বিশ্বভারতীর গবেষণা প্রকাশন বিভাগের কর্মী সতীন্দ্র ভৌমিকের সঙ্গে, যিনি আবার শখের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকও।

আমাদের প্রাণের বন্ধু হলো হাসি আর তার মেয়ে মিষ্টুনি। মিষ্টু তিয়ারই বয়সী।

হাসি একসময় গান শিখত মিনু আপার কাছে। পরে সাংসারিক নানা ঝামেলায় সেটা আর এগোয়নি। মাঝেমধ্যে আসত টুকটাক গান বুঝে নিতে—সেভাবেই পরিচয়। শান্তিনিকেতনের থাকা-খাওয়া, মনের কষ্ট—সব দূর হয়ে যেত হাসির বাসায় ঢুকতেই। মিষ্টুনি ছিল তিয়ার প্রাণ।

একসঙ্গে নাচ, গান ও ছবি আঁকা। বৈতালিক বা দোলের অনুষ্ঠানে হলুদ শাড়ি পরে, গলায় পলাশ ফুলের মালা দুলিয়ে কাঠি হাতে ‘ওরে গৃহবাসী’ গানের সঙ্গে ছাতিমতলা প্রদক্ষিণ—সবই একসঙ্গে। কী ভালোই যে বাসত হাসি আমাদের।

এর মধ্যে আমরা এসে উঠলাম পঞ্চবটীর একটি বাসায়। জায়গাটা বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাস থেকে বেশ একটু দূরে।

পূর্বপল্লির খানিক উত্তর দিকে। গাছপালাঘেরা বিশাল এক আবাসিক এলাকায় পাঁচটি বাড়ি।

বিদেশি রিসার্চ স্কলার বা শিক্ষকদের জন্য তৈরি। আমি কোনোভাবেই ওই বাড়ির যোগ্য নই, কিন্তু ছোট্ট একটি মেয়েকে নিয়ে প্রাণপণ বাসা খোঁজার করুণ অবস্থা দেখে সাময়িকভাবে একটি বাড়ির ব্যবস্থা করেন জাস্টিস মাসুদ, তিনি সে সময় বিশ্বভারতী কর্মসভার কোষাধ্যক্ষ।

পঞ্চবটীর বাড়িগুলো একটা থেকে অন্যটা বেশ দূরে।

বাড়িগুলো ছোট্ট, সুন্দর ছিমছাম, আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। আমার বন্ধুদের তো চক্ষু চড়কগাছ। অনেক ভাগ্যে এ রকম ঘর মেলে। রোজই আড্ডা, গান-গল্প, খাওয়া-দাওয়া মহাফূর্তি। দিনগুলো যেন পাখা মেলে দিল।

কিন্তু সন্ধ্যার পর সবাই চলে গেলে, তিয়া ঘুমিয়ে পড়লেই হতো মুশকিল। এত চুপচাপ, নিরিবিলি। কোথাও কোনো শব্দ নেই, মানুষ নেই। সবচেয়ে কাছের বাসাটাও কমপক্ষে আধমাইল দূর। অন্ধকারে লাইটপোস্টের আবছা আলো-আঁধারি, চেনা-অচেনা বুনোফুলের তীব্র গন্ধ আমাকে কোথায় যে নিয়ে যেত।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপরই একটা ট্রেন যেত খুব কাছ দিয়ে। বোলপুর থেকে প্রান্তিক। ট্রেনের লাইনটা ছিল দুটো টিলার মাঝে, একটু নিচুতে। যখন ট্রেন যেত, একটা গুম গুম করে শব্দ হতো মাটির নিচ থেকে, শব্দটা যেন বুকের ভেতর কোথায় গিয়ে লাগত। আবছা অন্ধকার, নির্জনতা আর ট্রেনের শব্দ আমাকে যেন পাগল করে ফেলত।

নিজের দেশ, মা-ভাইবোন, এত দিনের সংসার—সব যেন অলীক মনে হতো।

কলা ভবনে ডিজাইনের সার্টিফিকেট কোর্সে আমাদের বিভাগে ছিল তাঁত, বাটিক, টেম্পেরা, ছাপচিত্র, মৃৎশিল্প ইত্যাদি। আমি নিয়েছিলাম মণিপুরী তাঁত, বাটিক ও টেম্পেরা পেইন্টিং। তাঁতটায় জোর দিয়েছিলাম কারণ, অন্যান্য বিষয়গুলো দেশেও শেখা যায়। আর শান্তিনিকেতনের বাটিকের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, টেম্পেরাটাও একটা নতুন টেকনিক আমার কাছে।

আমাদের তাঁত শিখাতেন ননীদা। বাটিক ও অন্যান্য প্রবীরদা। তাঁত বসাতে গিয়ে হিমশিম, একেবারে অঙ্কে বাঁধা। হিসাব করে টানা দিতে হয়। আমার আবার যথেষ্ট অঙ্কভীতি আছে।

তবে গৌতম, মণিদীপার সাহায্যে উতরে গেলাম।

এই ফাঁকে আলাপ হলো মাণিদা (সুব্রামানিয়াম), শর্বরীদা (রায় চৌধুরী), সোমনাথ (হোর), মোহরদি (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়), বাচ্চুদি (নীলিমা সেন)—এঁদের সঙ্গে। দেখা করলাম বিশিষ্ট ছান্দসিক প্রবোধ চন্দ্র সেন মশায়ের সঙ্গে, মীনু আপাই নিয়ে গেলেন। কবি শঙ্খ ঘোষ, নন্দলাল বসুর দুই মেয়ে গৌরীদি-যমুনাদি, অমিতা সেন, আরতী সেন (বিনয় ভবনের শিক্ষক)—কত যে পরিশীলিত, শিল্পমনা মানুষ, যাঁদের এত দিন নামই শুনছি; দেখা হওয়ায় জীবন সমৃদ্ধ হলো।

মাস কয়েকের মধ্যে মিনু আপার রিসার্চের কাজ শেষ হয়ে গেলে আমরা আবার রতনকুঠিতে ফিরে আসি।

ঘর খালি থাকবে, তাই আমাকে বললেন চলে আসতে, আমিও মহা খুশি হয়ে চলে এলাম। দূরে, নির্জনে, পঞ্চবটীর ওই বাড়িটি কেমন যেন মন খারাপ করা। রতনকুঠি একেবারে ক্যাম্পাসের মাঝখানে। সারাক্ষণ গান-বাজনা, আবৃত্তি, ছবি, বেহালা, কীর্তন—সবকিছুর মধ্যে থাকা। ছাতা আর টর্চটা নিয়ে দৌড় দিলেই হলো।

পঞ্চবটী থাকতে এসব পেতাম না। কষ্ট হতো। বিশেষ করে বৈতালিকগুলো দোলাপূর্ণিমার আগের রাতে যেমন চাঁদের আলো-ছায়ায় মাখামাখি, গাছের ছায়া এত স্পষ্ট যে সত্যি বলে ভ্রম হয়। রাস্তাধুলো বসন্ত বাতাসে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়। চোখে দেখা যায় না, কিন্তু হাওয়ায় তার গন্ধ আসে।

আসে মহুয়ার, আসে ছাতিমের, বকুলের; হাতে হাত ধরে গান গেয়ে মন্দির, ছাতিমতলা, প্রদক্ষিণ—গানের সুর ভেসে বেড়ায় পথে পথে। কোথায় পাব এমন উৎসব?

এরই মধ্যে মা (সুফিয়া কামাল) এলেন শান্তিনিকেতনে, আমাদের দেখতে। সঙ্গে লুলু (সুলতানা কামাল) রঞ্জু (সুপ্রিয়), দিয়া ও জাফর ভাবি (নার্গিস জাফর)। মায়ের ওবারই প্রথম শান্তিনিকেতনে যাওয়া। আনন্দপূর্ণ হয়ে গেল দিনগুলো।

বেড়ানো, গান শোনা, নানাজনের সঙ্গে দেখা করা—কোথা দিয়ে যে কেটে গেল দিন ক’খানা। মনে পড়ে, রবীন্দ্র ভবনের কিউরেটর নরেশ গুহ যখন ১৯২৯ ও ১৯৩৮ সালে মাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির কপিগুলো (যা মায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল) তুলে দিলেন মায়ের হাতে, তখন চোখের জল আর বাধা মানল না।

মীনু আপা মাকে নিয়ে গেলেন ডিয়ার পার্কে বেড়াতে। একের পর এক গান গাইছেন, ছোট পুকুরের পাড়ে বসে, মায়ের প্রিয় সব গান। দেখা গেল পার্কের হরিণগুলো যারা পানি খেতে এসেছিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে খুব কাছে—যেন তারাও শুনছে গান নির্ভয়ে।

দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষার সময় এগিয়ে এল। কোথা দিয়ে যে নয়টা মাস কেটে গেল, টেরও পেলাম না। বন্ধুরা সবাই বলতে থাকল, ‘এক বছরে কেউ শান্তিনিকেতন ছেড়ে যায় না। থেকে যাও। ’ আমার স্কলারশিপ ছিল।

তিয়াও পাঠভবনে খুবই ভালো করছিল। কিন্তু ওই সময়টায় মায়ের শরীর ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিল। আমাকে ফিরে আসতে হলো ঢাকায়।

আমার জন্য পড়ে রইল রতনকুঠির লাল কাঁকর বিছানো উদাস পথ, সোনাঝুরি গাছের সারি, হা হা করা খোয়াই, মহুয়ার গন্ধে মাতাল গেরুয়া বাতাস। লাল ধুলো, কোপাই।

আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকল রামকিংকরের ‘সাওতাল পরিবার’। রবীন্দ্র ভবন, কালো বাড়ি, আমার প্রিয় শ্যামলী বাড়ি। আম্রকানন, ঘণ্টাতলা, বুধবারের মন্দিরের রঙিন কাচের ঝিলিমিলি, ঝরে পড়া বকুল—সব। ফেলে এলাম কলা ভবনের বন্ধুদের সঙ্গে গুলতানি, মামার ক্যানটিনের শিঙাড়া আর চা, সংগীত ভবনের বারান্দায় বসে বাচ্চুদির সুধাভরা কণ্ঠের গান শোনা, মোহরদি গোরাদার সঙ্গে কুশলবিনিময়। গৌতমের সাইকেলে চড়ে তিয়ার শান্তিনিকেতন চক্কর।

বোলপুরের রিকশার কর্কশ ভেঁপু, সিনেমা বাজার-হল্লা—সব। কালোর দোকানের অপূর্ব রসগোল্লা, নতুন বইয়ের গন্ধে ভরা সুবর্ণরেখার বইঘর। পূর্বপল্লির ফুলে ফুলে ভরা সুন্দর বাড়িগুলো। রতনকুঠি গেস্ট হাউস থেকে দু শ টাকার মাস কাবারি খাবার আনা, অবিশ্বাস্য মনে হয়।

ঢাকায় ফিরে সেই আগের জীবন।

চাকরি, সংসার, সামাজিকতা—সেই টানাপোড়েন। মাঝখান থেকে কিছুটা সময় যেন কোথায় হারিয়ে এলাম—কোন খেলাঘরে, নাকি কোনো ভুলে যাওয়া স্বপ্নে।

হায়! কখনো কি শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।