কতো কী করার আছে বাকি..................
দাদার দোকানে আমাদের যাবার সময়টা নির্দিষ্ট নয়। অথচ আমরা প্রতিদিন প্রায় একই সময়ে সেই দোকানে গিয়ে উপস্থিত হই। আমাদের হাতে কোন ঘড়ি থাকে না। কারণ আমাদের জন্য কেবল দিন আর রাত আছে। চব্বিশ ঘন্টায় একদিনের শিক্ষা আমাদের জন্য পুরাতন হয়ে পড়ে আছে বাল্যের কোন এক বইয়ের পাতায়।
দাদার দোকানে আমাদের কথা বলার বিষয়বস্তুও আমরা ঠিক করে রাখি না। অথচ মাস শেষে হাতের করে গুনে আমরা কিছুতেই দশ বারোটার বেশি বিষয় খুঁজে পাই না। আমাদের মাস অবশ্য ত্রিশ দিনে বাড়ে না। আমরা কোন ঘটনা অথবা উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে মাসের আবর্তন ঘটাই। ফলত বারো মাসের হিসাব আমাদের খেয়াল থাকে না।
আমরা কেবল আকাশে মেঘ অথবা দাদার দোকানের সামনের কদম গাছটায় ফুল আসলে অথবা তার পাশেই ঢাকাইয়া বরই গাছে ফল আসলে কিংবা জল কাদা কুয়াশা আমাদেরকে ঋতুচক্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু সমস্ত চক্রের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাদার দোকান আমাদের পৃথিবীর শেষপ্রান্ত হয়ে ওঠে। এর কারণ আমাদের যাবার মতো কোন জায়গা আমরা এই ছোট্ট মফস্বল শহরে খুঁজে পাই না। আমরা কেমন যেন সব কিছুর পিঠপিছন দিয়ে দাঁড়াই। আমরা আমাদের সমসময়কে পেছনে রেখে দাদার দোকানে প্রবেশ করি।
সেখানে দাদার দোকানের পাঁচটা টেবিল আর সতেরোটা চেয়ার, ছায়া ছায়া আড়াল, সন্ধ্যা নামলে দাদার একশো পাওয়ারের ফিলিপস বাতি, খদ্দেরদের নানা কিসিমের আলাপ, আর আমাদের দীর্ঘশ্বাস কিংবা উচ্ছ্বাস, গাম্ভীর্য্য, স্থৈর্য্য, বিবমিষা- সব মিলিয়েই আমাদের দিন কাটে। আমরা আসলে এক ঘরে হয়ে থাকি।
আমাদের দাদার কাঠ কাঠ শরীরের ওপর ভারি চোয়াল আর মুখে সদা সর্বদা একটা বিরক্তি খসখসে চামড়ার আভরন নিয়ে বসে থাকে। সেই বিরক্তির নীচে কোথাও হয়তো দরদ নামের শব্দটা লুকিয়ে থাকে, নইলে আমাদের অত্যাচার সহ্য করবার মতো লোক যে তিনি নন এটা হলপ করে গোটা কলেজ পাড়াই বলতে পারবে। গত পঁয়ত্রিশ বছরে কতো ঝড় বর্ষা এলো গেলো, কতো হাঙ্গামা, একাত্তর-নব্বই, আমাদের ইতিহাস, সব দাদার দোকানের কড়ি বরগায় ঝুল কালি হয়ে জমে আছে।
সেই ইতিহাসের স্মৃতিরেখা হয়তো দাদার কপালে বিরক্তি হয়ে বসে থাকে, সমকালকে সে দেখে। আমরাও তাই ভাবি আবারো একটা ইতিহাস হয়তো দাদার মুখ থেকেই নেমে আসবে কোন এক আট-ই ফাল্গুনে। আমরা এরকম কোন আশায় যে সেখানে বসে থাকি বিষয়টা এমন না। আমরা আসলে সেখানে বসে থাকবার একটা উছিলা খুঁজি মাত্র। তাতে দাদাকে মহিমান্বিত না করলে আমাদের উপায় থাকে না-যৌক্তকিতাও থাকে না।
আমরা আমাদের ভেতরে নিজেদের চাওয়াগুলোকে পাওয়ার ছলনায় এমন কতো কি করি তা কেবল আমরাই হয়তো জানি। অথবা আমরা আসলে নিয়ম পালন করি কেবল, এই বয়েসে এমন অনেকেই একই রকম এমন কিছু করে গেছে। আমাদের দায়িত্ব কেবল ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। তাই আমরা কলেজে আসি না আসি কলেজ এলাকায়। আমাদের হাতে কখনোই ক্লাসের বই-খাতা থাকে না।
খাতা না থাকলে কলম থাকাও যে বাহুল্য এটা আমরা বুঝি। আমরা আরো বুঝি যে আমরা যা বুঝি তা আসলে অন্যরা বুঝে না, তারা যে আমাদের বুঝতে পারে না এটাও তারা বুঝতে পারে না। ফলে আমরা কোণঠাসা হয়ে থাকি এবং কলেজের কোণায় দাদার দোকানে বসে থাকি।
মান্দার অথবা শিরিষের অথবা আমের চেলা কাঠ জ্বেলে, ভোরে বাজারে গিয়ে নিয়ে আসা গাই গরুর দুধ মিশিয়ে, জল আর তাতে সেদ্ধ চা পাতায় চিনি গুলিয়ে চিনামাটির সাদা কাপে আমাদের জন্য চা তৈরি হয়। মাঝে মাঝে সকালের লুচি সব্জি বা হালুয়া নাস্তা সেরে আমরা দাদার দোকানেই বসে থাকি, দাদার কাঁচের গ্লাসের ঘোলা পানি পান করি।
দিনের মধ্যে কয় কাপ চা আমরা খাই তার হিসাব কেউ রাখে না, দাদাও না। দাদার দোকানের মেঝে মাটির, বাঁশের চাটাই আর পলিথিনে ঢাকা ছাউনি গলে কখনোই রোদ আসে না, আসে কেবল রোদের রেখা, ক্ষীণ। সেই রোদ খাড়া হলে আমরা বাসায় যাই দুপুরের ভাত খেতে। ভাত খাওয়া শেষে আবারো দাদার দোকান। শেষ রাতের চা খুব দারুণ হতো।
তখণ গাঢ় লিকার, ঘন দুধ, দাদাও তখন আমাদের সাথে বসে চা খেতেন। আমরা সেই দোকানে বিগত দশক ভাজি, আমাদের শব্দ কথায় পুর্নজ্জিবীত হয় অতীত। আমরা কবিতা পড়ি-
কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।
আমরা পুষ্প বৃক্ষ আর বিহঙ্গ পুরান খুঁজি।
অথবা আমরা আমাদের সময়কে পড়তে পছন্দ করি। দাদার দোকানে তা-ই আমাদের আড্ডার বিষয় হয়ে ওঠে কখনো কখনো। প্রাচ্য নাটকের সয়ফর আসে একদিন। আমাদের অনেক কথা শুনায়ে যায় সে-
আমাগো আবার বাঁচন কিয়ের রে দাদী। আমাগো বাঁচন কালনাগিনের ডংশন।
শ্যাষ জমি বন্দক দিয়া যে বিয়া করে তা কিনে আইজল মিয়া। শ্যাষ জমি বন্ধক দিয়া যে বউ ঘরে আনে তারে মারে সাপে। যে সুড়ঙ্গ খুঁড়ি এই ইন্দুরের নাগাল তাতে হাপ ঢুইকা পড়ে। এইভাবে ছুবল মারে।
আমার দাদার দোকানের শূন্য চালায় ভেলা ভাসাই।
তাতে জলের শব্দ জাগে না, পাল হয়তো থাকে কখনো কখনো। আমার সেই পালে স্বপ্ন ভাসাই কি। বুঝতে পারি না। দাদার খ্যাঁচ খ্যাঁচে মুখাবয়ব আমাদের দোরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা অনেক সময় বের হতে গিয়েও আবার ফিরে আসি।
আমাদের কথা বলার ভঙ্গি-বিষয়-পাল্টা জবাব সবই এক হয়ে উঠতে থাকে। আমরা ভাবি আমরা জমজ হয়ে গেছি। দাদা আমাদের তাই হয়তো কখনোই চিনতে পারেন না। কাকে কি নামে ডাকেন তা তিনি কখনোই বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি কেবল আমাদের হাঁটা চলা আর কথা বলা দেখে বুঝতে পারেন আমরা এসেছি তার দোকানে।
আমাদের কার বাসা কোথায় বাপ চাচার কি নাম এগুলো নিয়ে দাদার আগ্রহ কখনই ছিল না। অথচ বাইরের মানুষেরা আমাদের ঠিক ঠিক চেনে। আমাদের ঠিকুজির সব তাদের জানা-আমাদের হাঁড়ির খবর হয়তো তাদের পত্রিকায় ছাপানো হয়। আমরা জানি না। আমাদের ঝোঁক অন্য কোথাও।
আমরা অনু হয়ে উঠি-
পরদিন অনু দুপুরের উদ্দেশে নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ হলো।
আমদের নিরুদ্দিষ্ট ঠিকানাই হচ্ছে দাদার দোকান। একবার দাদার দোকানের পানির ড্রামে তিন ইঞ্চি গাদ পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম আমরা। সেদিন দাদার সে কি রাগ। দোকান বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আমরা যেচে পরিষ্কার করবার জন্য নয় তার দোকানে ময়লা জমে আছে এই বিষয়টা মেনে নিতে পারছিলেন না দাদা। পরদিন আবার তার একই রকম ভাব গম্ভীর মুখ আমরা দেখি, ভয়ে ভয়ে চা চাই। কিন্তু তিনি আগের মতোই। আগের মতোই কতো কতো ইতিহাসকে নিজের মুখের রেখায় জমিয়ে রাখেন। আমাদের কেন যেন আবু ইব্রাহিমকে মনে পড়ে।
বাস্টার্ড আবু ইব্রাহিম। এভরিবডি ইজ ম্যানেজেবল অ্যান্ড এভরিবডি কুডবি পারচেজড, কেবল আবু ইব্রাহিম ছাড়া। আমাদের শির দাঁড়ায় শিরশিরানি জাগে, আবু ইব্রাহিমের কথা মনে হবার পরদিন থেকেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।