ভেজালের উৎস সন্ধান ও দূষণ থেকে সামাজিক পরিত্রাণ
ফকির ইলিয়াস
=======================
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দৈনিকগুলোতে নিয়মিত একটি কলাম আছে। সে কলামটি 'ডাইনিং আউট' বা 'বাইরে কোথায় খাবেন' এই সেকশনে ছাপা হয়। কলামটির শিরোনাম হচ্ছে, 'গত সপ্তাহে যেসব রেস্টুরেন্ট স্বাস্খ্য নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। ' এই সংবাদ কলামে সেসব রেস্টুরেন্টে নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর থাকে যারা যুক্তরাষ্ট্রের 'হেলথ কোড' ভঙ্গ করেছে। সে সঙ্গে বিবরণ থাকে কীভাবে তারা 'হেলথ কোড' ভঙ্গ করেছে।
যেমন তাদের রান্নাঘরে বাসি খাবার পাওয়া গেছে, রান্নাঘরে ছোট ইঁদুর কিংবা পোকার উপস্খিতি লক্ষ্য করা গেছে, কিংবা রেস্টুরেন্টের টয়লেট-ওয়াশরুম ময়লা ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষ করে কিচেনে পুরোনো-বাসি খাবার, পোকার উপস্খিতি প্রভৃতিই বেশি লক্ষ্য করা যায়। সিটি কর্তৃপক্ষের হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন্সপেক্টররা প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করে যে রিপোর্ট দেন, হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তা-ই সংবাদপত্রে সরবরাহ করে। সেসব ডকুমেন্টেশনের ভিত্তিতেই ছাপা হয় পত্রিকায় সংবাদ প্রতিবেদন।
পাঠক, অনুমান করুন যদি নিউইয়র্কের একটি সংবাদপত্রে একটি রেস্টুরেন্টে বাসি খাবার বিক্রির রিপোর্ট ছাপা হয়, তবে আর কোনো খদ্দের কি ঐ রেস্টুরেন্টের বারান্দায় গিয়ে পা ফেলবে? না, অবশ্যই ফেলবে না।
এমনও দেখা গেছে, হেলথ কোড ভঙ্গের রিপোর্ট ছাপা হওয়ার কারণে অনেক রেস্টুরেন্টে লালবাতি জ্বলে গেছে চিরদিনের জন্য। কারণ মার্কিনিরা খাবারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। গাঁটের ডলার খরচ করে তারা ফাঙ্গাসযুক্ত বাসি খাবার কিনে খাবেন কেন? তার ওপর কোনো রেস্টুরেন্টে বাসি খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে ঐ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার সুযোগ তো রয়েছেই। আমি একজন মার্কিনিকে জানি, যিনি একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে ফ্রাইড চিকেন খেয়েছিলেন। কিন্তু ঐ ফ্রাইড চিকেনের ভেতরের হাড় ভালোভাবে পরিষ্কার এবং ফ্রাইড না হওয়ায় হাড়ে জমাট রক্ত থেকে গিয়েছিল।
তিনি ঐ রক্তাক্ত হাড় চিবিয়ে গিলে ফেলায় তার মারাত্মক অসুস্খতা দেখা দেয়। তার শরীরের একাংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। চিকিৎসায় তার কারণ ধরা পড়ে। তিনি ঐ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করে তার ক্ষতিপূরণ পান দু'মিলিয়ন ডলার। একটি পত্রিকার রেস্টুরেন্ট রিভিউ, একটি রেস্তোরাঁকে যেমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা দিতে পারে, তেমনি অস্বাস্খ্যকর খাদ্য পরিবেশের কথা ছাপা হলে ঐ রেস্তোরাঁটির ব্যাপক আর্থিক ক্ষতিও হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে হেলথ ইন্সপেক্টররা যাতে কোনো রেস্টুরেন্ট মালিক কর্তৃক প্রভাবিত হতে না পারেন, তার জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্খা। যারা অনডিউটিতে থাকেন তাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য থাকে অন্য আরেকটি গোয়েন্দা দল। কারণ তারা কাজ ঠিকমতো করছেন কি না, কিংবা কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন কি না তা দেখার দায়িত্ব হলো ঐসব গোয়েন্দা কর্মকর্তার। মোট কথা হচ্ছে কোন ইন্সপেক্টর যাতে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে না পারেন, সেজন্যই এ ব্যবস্খা।
বাংলাদেশে প্রায়ই মোবাইল কোর্ট দ্বারা বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কেন্টিন, ফাস্টফুডের দোকানগুলো তল্লাশির খবর ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় বিদেশে।
'আমরা কী খাচ্ছি', 'রেস্টুরেন্টগুলোর সদর-অন্দর', প্রভৃতি শিরোনামের বিভিন্ন রিপোর্টগুলো আলোচনায় আসে প্রবাসী বাঙালিদের আলোচনায়, আড্ডায়। খাদ্য, পানীয় তো বটেই ফলমূলেও যে বিষ মিশ্রিত রঙের ব্যবহার করা হচ্ছে তা রোগগ্রস্ত করে তুলছে গোটা দেশবাসীকে, এই প্রজন্মকে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, যখন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্টগুলো বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুডের দোকানে তল্লাশি অভিযান চালায়, তখনি এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে 'রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সমিতি। ' কখনও তারা আহ্বান করেছে ধর্মঘট।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা কাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন? তারা কি চান এভাবে পচা এবং বাসি খাবার বিক্রি করা হবে? ক্রেতারা জানবেন না তারা জীবিত না মৃত মুরগির মাংস খাচ্ছেন রস্তোরাঁয়? রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সমিতির সব সময়ই উচিত , যারা দুর্নীতিবাজ, অস্বাস্খ্যকর পরিবেশে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্খা নেয়া ।
একটি দেশ, একটি জাতি কি এভাবে পদে পদে জিম্মি থাকতে পারে? না পারে না। কিন্তু দৃঢ় চেতনা বাণী নিয়ে কে এগিয়ে আসবে? কে বলবে, আমরা সব ভেজালের উৎস বন্ধ করতে চাই। আমরা সব দুর্নীতির বিনাশ চাই।
কিছু কিছু রেস্তোরাঁর মালিক যারা সরকারি মদদপুষ্ট তারা আগেভাগেই নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিয়ে থাকেন , যাতে তাদের রেস্তোরাঁয় মোবাইল কোর্ট না যায়। অথচ এ কথাটি সত্য যে, খাদ্য গ্রহণে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজেন না কোন ক্রেতা।
তারা খোঁজেন না তারা আওয়ামী মালিকের রেস্টুরেন্টে খাচ্ছেন না বিএনপি মালিকের রেস্টেুরেন্টে খাচ্ছেন! বিষয়টি গণস্বার্থ, গণস্বাস্খ্য সংশ্লিষ্ট। কিন্তু দলীয় রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে সব গণস্বার্থই আজ হয়ে পড়েছে হীন দলীয় স্বার্থ। সব মানবিক আকুতিই আজ হয়ে পড়েছে অরণ্যে রোদন।
দুই
এরপর বলা যায় মিডিয়ায় পণ্যের প্রচার বিষয়ে। একটি এ্যাডভার্টাইজমেন্ট মিডিয়ায় যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে মাঝে
মাঝে এমন সব অদ্ভুত এ্যাড দেখা যায় , যা অনেকটা ভৌতিক
বলেই মনে হতে পারে। এগুলো নিছক লোক ঠকানো কি না,
তা ও ভেবে দেখা দরকার।
আমরা যারা প্রবাসী, তারা স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে সৃজনশীল মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা হবে। ১৪ কোটি মানুষের দেশে ১৫/২০টি টিভি চ্যানেল থাকা দোষের কিছু নয়। দোষের বিষয় হচ্ছে সংবাদ মাধ্যম, টিভি চ্যানেলগুলোকে সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা না দেয়া।
অনেক সময় ক্ষমতাসীনদের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা যখন বলেন, 'সংবাদ এই সব সর্বনাশের মূল' কিংবা 'সংবাদপত্র মিথ্যা বলার স্বাধীনতা ভোগ করছে' তখন সেসব নেতাদের নিজের আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখার অনুরোধ না করে উপায় থাকে না।
একটি দেশে রাষ্ট্রীয় ভেজাল, দুর্নীতি যখন হাইকমান্ড থেকে প্রশ্রয় পায় তখন চুনোপুঁটি দুর্নীতিবাজরা সাহস পায়। উল্লাস প্রকাশ করে। আজকের বাংলাদেশে খাদ্য, পানীয়, ফলমূল, শাকসবজি এমনকি মাছ-মাংস নিয়ে যে ভেজাল শুরু হয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণেই। নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণেই।
মোবাইল কিংবা সেলুলার ফোন এ সময়ে গোটা বিশ্বে একটি প্রধান টেলি-বাণিজ্য। কিন্তু মোবাইল ফোন ব্যবহারে নির্দিষ্ট অনেকগুলো নীতিমালাও বিভিন্ন দেশে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলার দণ্ড হিসেবে ১০০ থেকে ৫০০ ডলার জরিমানার রেওয়াজ রয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার সময় শিক্ষকদের সেল ফোন বন্ধ রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তেমনি হাসপাতাল, শিশু সদন কেন্দ্র, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রসহ বেশকিছু স্খানে সেলুলার ফোনের অবাধ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা থাকে।
শুধু শব্দ দূষণই নয়, মোবাইল ফোনের কার্যবিধি একটি হাসপাতালের বিভিন্ন ইকুইপমেন্টে আঘাত হানতে পারে এমন কথাও বলেছেন বিজ্ঞানীরা। যত্রতত্র মোবাইল টাওয়ার লাগানোর ওপর বিশেষ কড়াকড়িও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশেও এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন সময়ের জরুরি দাবি।
ভেজাল খাদ্য, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ, বৃক্ষ নিধন প্রভৃতি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রথম এবং প্রধান কাজটি হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ বিনির্মাণ কিংবা পুনরুদ্ধার। আমাদের বাঙালি সমাজ তো একটি সুসভ্য জাতিসত্তা হিসেবেই বিশ্বে বিবেচিত ছিল।
ছিল আমাদের হাজার বছরের গৌরবের সামাজিক সম্প্রীতি। এই বাংলার পুকুরের জিয়ল মাছ, ওলানভরা গাভীর দুধ, মাঠের সবুজ সতেজ শাকসবজি, ফলমূল আশিষ জোগাতো আমাদের প্রপিতামহদের। আমরা কি আমাদের প্রজন্মকে সেই উজ্জ্বল অতীতটি ফিরিয়ে দিয়ে যেতে পারি না? হ্যাঁ, পারি এবং পারবো যদি সবাই সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হই। আর এই প্রশ্নে রাজনীতির হীনস্বার্থকে পদদলিত করার কোনো বিকল্প
নাই । #
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক উত্তরপূর্ব ।
সিলেট। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৯ শনিবার প্রকাশিত
ছবি- এগনেস ভার্নাগি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।