আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকায় হাছন উত্সব



গান ছাড়া যার অস্তিত্ব কল্পনা করাও কঠিন তিনি হচ্ছেন মরমী সাধক, মরমী কবি হাছন রাজা। গত ২১ ডিসেম্বর ছিল হাছনের ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আয়োজন করা হয় জাতীয় হাছন উত্সবের। হাছন রাজা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গঠিত একটি আহ্বায়ক কমিটি এই উত্সব বাস্তবায়ন করে। গত সোমবার বিকালে জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে উত্সবের আয়োজন করা হয়।

প্রখ্যাত গবেষক ও শিক্ষাবিদ আবুল আহসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে উত্সবের আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। আলোচক ছিলেন অধ্যাপক কাজী নুসরাত সুলতানা, ড. গোলাম মোস্তফা ও হাছন রাজার প্রপৌত্র লে. কর্নেল দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা চৌধুরী। ‘হাছন রাজার দর্শন ও বাংলার জাতীয় উত্সব’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উত্সব আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব সৌমিত্র দেব। রাজধানীর বুকে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হাছন উত্সবে শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল লতিফকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। হাছন রাজাকে নিয়ে নানামাত্রিক কাজের জন্য বেশকিছু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে হাছন রাজা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রদান করা হয় স্বীকৃতিপত্র।

এই স্বীকৃতিপত্র লাভ করে যথাক্রমে—১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, দেওয়ান তালেবুর রাজা ট্রাস্ট, প্রকাশনা সংস্থা পাঠক সমাবেশ ও উত্স প্রকাশন, হাছন রাজা সঙ্গীত পরিষদ সুনামগঞ্জ, হাছন রাজা ভক্ত পরিষদ, দেওয়ান তালেবুর রাজা পাঠাগার, হাছন রাজা বাউল কল্যাণ ফেডারেশন, হাছন রাজা ফাউন্ডেশন ইউকে, মিউজিয়াম অব রাজার্স এবং উত্সব আয়োজনের সহযোগী রেডটাইমস বিডি ডটকম। উত্সবের সমাপনী পর্বে ছিল সঙ্গীতায়োজন। এই আয়োজনে হাছন রাজার গান পরিবেশন করে হলঘর উপচেপড়া শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন হাছন রাজার গানের প্রবীণ শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল লতিফ, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী জান্নাত-এ-ফেরদৌস এবং হাছন রাজা শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ। সঙ্গীতায়োজনের মূল আকর্ষণ ছিলেন শিল্পী মোহাম্মদ আবুল লতিফ। তিনি গেয়ে শোনান একে একে— মাটির পিঞ্জিরার মাঝে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ, প্রেমের আগুন লাগল রে, খোদা মিলে প্রেমিক হইলে, হাছন রাজা বড় আহাম্মক, প্রেমের মানুষ নয় যারা, একদিন তোর হইবো রে মরণ ইত্যাদি গান।

উত্সবের আলোচনা পর্বে মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হাছন রাজাকে একজন ভোগবাদী মানুষ হিসেবে তুলে ধরেন। মন্ত্রী বলেন, যদি ভোগ-উপভোগই না থাকে তাহলে জীবনের দর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি হাছন রাজা সম্পর্কে দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিকৃত বলে উড়িয়ে দেন। মন্ত্রী বলেন, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দর্শন দিয়ে হাছন রাজাকে বোঝা যাবে না, তাকে বুঝতে হবে ভোগের দর্শন দিয়ে। সভাপতির বক্তব্যে আবুল আহসান চৌধুরী মন্ত্রীর প্রায় বিপরীত তত্ত্ব তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, হাছন রাজার জীবনে একটি অদ্ভুত বৈপরিত্য ছিল। একদিকে জমিদার হিসেবে তার মধ্যে ছিল সামন্ত মানসিকতা, অন্যদিকে কবি হিসেবে তার মধ্যে ছিল মরমী, বৈরাগ্য চেতনা। আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, সামন্ত প্রভাবের কারণেই তার মধ্যে ভোগবাদের মানসিকতা ছিল। এই ভোগবাদী মানসিকতাকে এক সময় অতিক্রম করেছিলেন হাছন রাজা। তার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে মরমী ও ত্যাগী মানসিকতা।

সে কারণেই হাছন রাজার গান মানুষের জন্য সম্পদ হয়ে উঠেছে। ভোগবাদী চেতনা নয়, বরং হাছনের মরমী চেতনাই তাকে গণমানুষের কবি ও শিল্পীতে পরিণত করেছে। রাজধানীর বুকে হাছন উত্সবের আয়োজনকে আবুল আহসান চৌধুরী গ্রামীণ সংস্কৃতির নগর দখল উত্সব বলে অভিহিত করেন। যদিও উত্সবে বক্তাদের কেউ কেউ এই বলে প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই উত্সব কেন ঢাকায় আয়োজন করা হচ্ছে। তারা মনে করেন এ উত্সব সুনামগঞ্জে হলেই ভালো হয়।

তবে ধারণা করা যায়, হাছন রাজা উত্সবকে জাতীয় পর্যায়ের একটি উত্সবে পরিণত করার জন্যই আয়োজকরা এ আয়োজন করেছেন। নির্মিত হচ্ছে ‘আমাদের হাছন রাজা’ : হাছন উত্সবে তরুণ নাট্যনির্মাতা তারিকুল ইসলাম হাছন রাজার জীবন ও কর্মের তথ্যভাণ্ডার নিয়ে ‘আমাদের হাছন রাজা’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের ঘোষণা দেন। এই তথ্য চিত্রটি গবেষণা, গ্রন্থনা, পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা করবেন সাংবাদিক অভি মঈনুদ্দীন। তিনি জানান, এই তথ্যচিত্রে হাছন রাজার জন্ম, বেড়ে ওঠা, জমিদারি ও সঙ্গীত জীবনের নানা দিক উঠে আসবে। আজ থেকেই আমরা এই তথ্যচিত্রের কাজ শুরু করব।

নির্মাতা তারিকুল ইসলাম জানান, ‘কারিগর বাড়ি’র প্রযোজনায় তথ্যচিত্রটি নির্মিত হবে এবং এটি পরিবেশন করবে নন্দন অডিও ভিশন। : হাছনরত্ন হাছন রাজা উত্সবে প্রবীণ শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল লতিফকে ‘হাছনরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। হাছন রাজার গানের প্রকৃত সুর কণ্ঠে ধারণ করে সুদীর্ঘকাল লালন করার জন্যই তাকে এ উপাধি দেয়া হয়। হাছন রাজা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল লতিফ ১৯৩৫ সনে সুনামগঞ্জের আরপিন নগর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তার বাবা আবদুল জলিল হাছন রাজার গানের জলসায় গাইতেন। বাবার কাছেই তিনি হাছনের শুদ্ধসুর কণ্ঠস্থ করে নিতেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন আবদুল লতিফ। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম বেতারে হাছন রাজার পুত্র দেওয়ান একলিমুর রাজার লেখা ‘পাখি কইও বন্ধুয়ার লাগাল পাইলে’ গেয়ে তিনি শিল্পী জীবন শুরু করেন। আবদুল লতিফের গাওয়া হাছনের গান বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকা থেকেও প্রচার হয়েছে।

শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল লতিফ সোনালি রুপালিকে বলেন, যতদিন বেঁচে আছি হাছনের গানের চর্চা করে যেতে চাই এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছে তার শুদ্ধসুর তুলে দিয়ে যেতে চাই

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।