পিছনের পায়ের ছাপের রেখাটা র্দীঘ আর অস্পষ্ট হয়ে আসছে... ক্রমশঃ...
ছোটবেলা থেকেই ছিলেম প্রচন্ড ডানপিটে। এমন দিন খুব কমই ছিলো যেদিন বকুনি বা মার খাইনি। স্কুল পালানো, ঘুড়ি উড়ানো, ব্যাঙ কিংবা মাছ ধরা ছিলো সবচেয়ে প্রিয় কাজ। খুব মনে পরে সেইদিনটির কথা… একটুকরো প্লাষ্টিকের কাগজে ঝাড়ুর শলাকা বেধে উড়ানোর জন্য সেকি প্রচেষ্টা…। কিছুতেই উড়াতে পারছিলাম না, সুতো বেধে উল্টা হয়ে দৌড় দৌড়… আর ঘুড়ি ঘুরছিলো পাগলা লাটিমের মতো।
হঠাৎ করে মাটিতে পরতেই একটুকরো খড় বেধে গেলো শলাকার সাথে। কি এক জাদুবলে ঘুড়ি সোজা উঠে গেলো আকাশে। আমার বিস্ময়, সেই ঘুড়ি আজো মনের কোনে পরশ বুলায়।
স্বাভাবিকের চেয়ে রোগাপটকা ছিলাম দেখতে, ছোট্টখাট্টো। বন্ধুরা কত্ত খেপিয়েছে।
অনেকের সাথে কথা বলাও ছেড়ে দিয়েছিলাম খেপানোর জন্য। মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। একবার বর্ষার সন্ধ্যায় আকাশ জুড়ে নামলো গাঢ় কালো মেঘ, আর সেকি বাতাস। সাথে গুড় গুড়, গুড় গুড় শব্দ। মাঝে মাঝে বিজলীর আলোর ঝলকানি মুছে দিচ্ছিলো আধাঁরটুকু।
সেই ঝলকানির আলোকে হঠাৎই দেখলাম কি যেন লাফালাফি করছে বাড়ির উঠোনে। ব্যাঙ ভেবে যেই ধরতে গিয়েছি, ওমনি দেখি এতো মাছ। গায়ে চকচকে নীলাভ দ্যূতি ছড়ানো মাছ। আম্মা, মাছ…। সেই প্রথম আমার কৈ মাছ চেনা।
সেবার ১৩টা কৈ মাছ ধরেছিলাম উঠোন থেকে।
বৃষ্টির প্রতি একটা ভালোলাগা ছিলো ছোটবেলা থেকেই। বাসায় আব্বা না থাকলে আমার বৃষ্টিতে ভেজা কেউ আটকাতে পারতো না। এমনই এক বৃষ্টির বিকেলেই আব্বা আমাকে রেখে ফিরে গিয়েছিলেন ঢাকাতে। সেই প্রথম স্বাধীনতার স্বাধ… নিজের পরিচিত গন্ডির বাহিরে আসা… সম্পূর্ণ একা।
আপনারা যারা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন, তারা নিশ্চই বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবের পাশ দিয়ে শেষ মোড়ের দিকে চলে যাওয়া সোজা রাস্তাটির কথা জানেন। জানি না রাস্তাটি এখন কেমন হয়েছে, কিন্তু গত দু’বছর আগেও যখন শেষ গিয়েছিলাম, দু’ধারে ছিলো নানা জাতের গাছের সমাহার। সেই রাস্তাটিরই মাঝামাঝি এক জায়গায় এসে পিতা-পুত্রের গন্তব্য ছিলো দু’দিকে। রাস্তায় ছিলো একটিই রিকসা। তাতে আব্বাকে ঢাকার বাস কাউন্টারের দিকে পাঠিয়ে, উল্টোদিকে হেটে হেটে ফিরছিলাম হলে।
মাঝরাস্তাতেই মুষলধারের বৃষ্টিটুকু ধুয়ে নিয়ে গিয়েছিলো চোখের লোনাজল। পরিবারের প্রতি নাড়ীর টান সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম গভীরভাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর চেয়ে রাতগুলো ছিলো বেশী প্রিয়। সন্ধ্যার পর পরই নদীর ধারের আড্ডা, লেকের পাড়ের গান আজো মনকে উদাসী করে। ভালো ছাত্র বলতে যা বোঝায়, সেরকম ছিলামনা খুব একটা।
কিন্তু কেন যেন মনে হলো বদলে দেবো সবকিছু। হয়তো বদলাতে পেরেছিলামও কিছুটা। অনেকটা পরিশ্রম করতে হয়েছিলো সেজন্য। প্রথম বর্ষের রেজাল্ট শেষে শিক্ষকদের নজরে পরা শুরু করেছিলাম। অনেক চড়াই উৎড়াই পার হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রথম কয়েকজনের মাঝে নিজের স্থানটুকুও করে নিতে পেরেছিলাম।
খুব অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়েছিলো তখন। মনে হয়েছিলো, আমি পারবোই। অনার্স শেষে একবুক আশাও ছিলো, হয়তো নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই পরবর্তী জীবনের কর্মসংস্থানটুকু হবে। বড় বড় রাঘববোয়ালের খেলায় তা আর সম্ভব হয়নি। পেয়েছিলাম জীবনের সবচেয়ে বড় আশাভঙ্গের বেদনা।
সুদীর্ঘ ৭ টি বছরের স্বপ্ন মাত্র কয়েকটি মিনিটেই ভেঙ্গে গিয়েছিলো।
হাসপাতালের মেঝেতে বসে, বারান্দার লাইটের আলোতে লিখেছিলাম মাষ্টারর্স-এর থিসিস পেপার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি – বাবা, হার্টের ব্লকের কারণে তিনটি দিন আই.সি.ইউ-তে, অতঃপর অর্থাভাবে অপারেশন করাতে না পারায় সাধারণ বেডে। বুঝতে পারছিলাম, ছেলের চাকুরী না পাওয়া, ব্যাংক লোন পরিশোধের চাপ, পরিবারের ব্যায়ভার বহনের অসার্মথ্যতাটুকুই উনাকে সেই অবস্থায় পৌছুতে সাহায্য করেছিলো। খুব জেদ ধরে গিয়েছিলো মনে, যেভাবেই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী পেতেই হবে।
অনেক সাধনায় পেয়েওছিলাম, নিজের চেনাজানা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সম্পূর্ণ অপরিচিত, অজানা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাহিরে। এই পরবাসে সারাটাদিনের ক্লান্তিকর মুহুর্ত্বগুলো শেষে যখন দেশে ফোন করি, কথা বলি আব্বা-আম্মা, ভাগনির সঙ্গে, মনে হয় এইতো আমার সুখ, এইতো আমার শান্তি। সৃষ্টিকর্তার কাছে লক্ষ-কোটি শুকরিয়া…
সবাই ভালো থাকবেন...
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট
অন্যান্যঃ ফারুক হাসান-এর ব্লগে প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।