আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিমুল বাশারের অপ্রকাশিত গল্প



শেষ করতে না পারা একটি গল্প শিমুল বাশার তারিখ: ২৩ শে ফেব্রুয়ারী, ২০০৮ খসে পড়া তারাদের স্মৃতি নিয়ে জেগে উঠছে ভোর। ফুল ফোটার গভীর কৌশলে আলোকিত হচ্ছে আমার চারপাশ। আমি জানবো না কিছুই, তবু নক্ষত্রের খসে পড়া থামবে না। পৃথিবীর আরো এক প্রান্তে ধীরে ধীরে নামবে আঁধার। রাতের তুমুল হাওয়ায় আকাশে ছুটে পড়া নক্ষত্রের দাগ নিয়ে জাহাজের ডেকে বসে থাকবো আমি।

ব্রেকফাস্ট দেয়া হয়েছে বুফেতে। বিদেশী জার্নালিস্টরা আমার পেছনে প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে। ডিম, মধু, দুধ, কলা, কর্নফ্লেক্স আর বিভিন্ন প্রকারের ফলের জুস, আছে কয়েক প্রকারের বোতলজাত জেলি, সাথে বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশ থেকে আসা চৌকানাকার ব্রেড। রুচি অনুযায়ী নাও। খাও।

আমার সামনেই আফরোজা। আফরোজা গল্প বলতে পছন্দ করে। এটা আমার অভিমত। বাটিতে দুধ ঢেলে কয়েক চামচ কর্নফ্লেক্স আর দু চা চামচ মধু নিলাম আমি। বৃটিশ ক্যাপ্টেন জেমস্ সেইলস বলে উঠলো, নাইস কম্বিনেশন! আমি মুচকি হেসে একটিবার তার নীলচে চোখে তাকালাম।

তারপর অনুসরণ করলাম, আফরোজার পথ। আফরোজাকে আমার ভালোলাগে, অন্তত: এই জল হাওয়ায় সারাক্ষন মাখামাখি হতে থাকা সময়টাতে। সবার সাথেই আমার তিনদিনের পরিচয়। যেন আমার বয়স ৩ দিন! আমি পৃথিবীর কোন কিছুর সাথে কোনদিনও যুক্ত ছিলাম না, এমনভাবে সময়টা কাটাবো-মনস্থির করেই এখানে এসেছি। তাই সবকিছুতেই মুগ্ধ হতে পারছি কিংবা আসলেই সবকিছু মুগ্ধ হবার মতো।

জাহাজের ডেকে খোলা হাওয়া। নদীপাড়ের সবুজ দিগন্ত, নীল আকাশ আর দুধ সাদা পদ্মার পানি। যেন বহুকাল ধরে আমরা শুধুই একে অপরকে দেখছি। কেউ কাউকে ছুঁতে পারছিনা। এমনকি ওই যে এগিয়ে আসা অন্তরঙ্গ আকাশের নীচে, সোনালী রোদ কিংবা পরিমিত ঘুম হবার পর, গোসল সেরে রোদে গা এলিয়ে দেয়া আফরোজা, তাকেও না।

অনেকটা মগ্ন শিশুদের মতো পায়ের এক নগ্ন পাতা অন্য পাতায় রেখে, খাচ্ছে চুল উড়িয়ে। আফরোজা! হায় আফরোজা! হাই! আফরোজা চোখ মুখ নাচিয়ে দ্রুতলয়ে কথা বলে। মনে হয় টেলিভিশন দেখছি। অনেক কালারফুল পিকচার...অনেক ...অনেক...ফটোগ্রাফ! আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। বেশিরভাগ সময়ই কথা শুনিনা, শুধু দেখি।

এক একটি কথার অসংখ্য হাত । আমাকে ডাকে। হাত ধরে কোথায় যেন নিয়ে যায়, অচেনা গায়ের দিগন্তহীন মাঠে। ধানক্ষেতে, গমক্ষেতে, আখক্ষেতে অথবা মরিচ ক্ষেতের লম্বা সরু লাইনের ভিতর, আমি আর আফরোজা পেকে যাওয়া মরিচ তুলছি। যেন ওই গাঁয়ে শুধু আমি আর আফরোজাই থাকি।

বাটির দুধ শেষ হয়ে গেছে। তলানীতে মধু। দুধ আর মধু মেশানোর আগেই কর্নফ্লেক্স মিশে গেছে। খাওয়াও শেষ। আমি উঠে দাড়ালাম।

আমার বকুলের কথা মনে পড়লো। ছোটবেলায় যার সাথে আমি সবচেয়ে বেশি খেলতাম। তারও বেশি খেলার কথা ভাবতাম। মা বলতেন এ গায়ের সবচেয়ে সুন্দরী আর প্রতিভাবান মেয়ে। বকুল... বকুল... বকুল...! মায়ের জায়নামাজের সেজদায় রাখা তসবি নিয়ে একবার আমি আল্লাহু, আল্লাহু না বলে তোর নাম বলেছিলাম।

মা রেগে বলে উঠলেন, গুনা অইবো বাবা এমুন কইরো না, পড়বার বহ। তুমি অনেক পড়লে, আমি বকুলরে নিয়া আহুম। আহ্লাদে মায়ের জায়নামাজ খুঁটতে খুঁটতে মাকে বললাম,মা মোল্লা বাড়ির সোহরাব আছে না? ওইযে..দেরিঙ্গি পোলাডা! ওই নাকি বকুলরে বিয়া করবো? বকুল আমারে কইলো, ওই পুলাডা বুলে ওর লগে প্রেম করবার চায়? ও একটুও পড়েনি মা! সারাদিন স্কুলের মাঠে গরু চড়াতো আর স্কুলের ছেলেদের মারতো। মা, মা, আমি আর বকুল একদিন সোহরাবকে গরুর লেজ সরিয়ে কি একটা যেন, করতে দেখেছিলাম! তাই দেখে, বকুল বিনা কারনেই কি সুন্দর ঘেমে উঠেছিল সেদিন। তারপর থেকে বকুল লিলি ফুলের মতো লম্বা আর গন্ধময় হয়ে উঠলো।

একটা বাড়তি কাপড় জড়াতে লাগলো বুকের চারপাশে। মা, সেই আলগা কাপড় ভেদ করে বকুলের হৃদয় আর ছুঁতে পারিনি আমি। বকুলও আর জোলাভাতি খেলেনি আমার সাথে। মা, মা, আমি অনেক পড়েছি। মা, মা, বকুল শুধু জ্যামিতি পড়েছিল।

তাই আমাকে খেলায় নেয়নি। আমি যে অনেক খাটো। কোনদিনও আমি ওর বানানো ঘরের ছাদ ছুঁতে পারিনি। তাছাড়া আমার জোলাভাতি খেলা ঘরে ঢুকতে গেলে, বকুলের যে মাথা হেঁট হয়ে যেত! আমি কত ডেকেছি, আমার সাথে কলাপাতার সেই ঘরে আর ঢুকেনি বকুল! কুড়িয়ে আনা মটরদানায় রাঁধা বৌভাত জুড়িয়ে গেছে কলাপাতায়! বকুলের সাথে জোলাভাতি খেলবো বলে কতদিন ওদের বাড়ির পাশের বাগিচায় দাড়িয়ে থেকেছি আমি। ওই বাগানে গোরা লেবুর একটি ঝাড় ছিল।

কত কুসি লেবু যে আমার চোখের মনি ফাঁকি দিয়েছে! তারপর চোখের আড়ালেই তরতাজা হতে হতে একদিন হলুদ হয়ে পেকে গেছে। ওমা কি চমৎকার গন্ধ! আমি নাক ছোঁয়াতেই বকুলের গায়ের গন্ধ পেলাম। লেবু ঝাড়ের ঠান্ডা হাওয়ায় কেবল বকুলের গন্ধ। আমি চমকে এদিক সেদিক তাকালাম। না, বকুল আসেনি, বকুলের মাকে আমি আপা বলতাম, কমলা আপা।

"বিবাল আইছো, বকুলতো নাইতে গেছে। " ও। মা, বকুল নদীর ঘাট থেকে ফিরে আসার আগেই আমার কলাপাতায় ছাওয়া ঘরের চালা ছিড়ে খেয়ে গেছে সোহরাবের গরু। আমার ভীষন জেদ হয়েছিল সেদিন। আমি ছুটে গিয়েছিলাম স্কুলের মাঠে।

সোহরাবকে মারতে না পারলেও ওর গরুটাকে দু ঘা দিয়ে আসবো। মা, মা, ওই গরু অথবা সোহরাব কাউকেই সেদিন আমি মারতে পারিনি। তার আগেই স্কুলের পরিত্যক্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছিল ভেজা বকুল। মা আমি বকুলকে দেখে গায়ের জামা খুলে দিয়েছিলাম, গা মুছতে। বকুল ভেজা গাটাও সেদিন মুছেনি।

মা সেদিন সোহরাব ওই স্কুলঘরেই ছিল! ওকে মারার বদলে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, বকুলের ভেজা গা দেখে। ভেজা কাপড়ে কি এতক্ষন থাকতে হয়? বলো মা? জাহাজের ভোর কেটে গেছে। আমার ঘোর তখনো কাটেনি। আপনি কি কফি খাবেন ? হঠাৎ প্রশ্নে চমকে তাকালাম আফরোজার দিকে। দু:খিত! আমি গোরা লেবুর রস মেশানো চা খেতে চাই।

এখানে কি গোরা লেবু পাওয়া সম্ভব? দেখতে হবে এই বলে, আফরোজা সিড়ি বেয়ে নেমে গেল। আমি আবারও আমার ভেতরে তলিয়ে গেলাম। রসনা আপা এসেছে। রসনা আপা এলে আমাদের বাড়ির চেহারা পাল্টে যেত। আদর আর স্নেহে ভরে যেত উঠোনের বাতাশ।

রসনা আপা পরীর দেশে থাকে। আমার খালাতো বোন। শীত এলেই ছেলে মেয়ে নিয়ে বেড়াতে আসতো আমাদের বাড়িতে। মা ওদের খুব ভালোবাসতো। ছেলে মেয়েগুলো কি যে অদ্ভুত! সকালে খায়না।

সারাদিনে একবারও নায় না। ওরা বাড়িতেই গা ধোয় বালতির পানিতে। মা বলতেন গোসল করে, পানি আইন্না দেও তোমার মামারে। ওরাও খেজুরের রস খেত, তবে মুড়ি দিয়ে নয়, শো-কেসে জমিয়ে রাখা কাঁচের গ্লাসে করে। মাঝে মাঝে মনে হোত, ওদের জন্যই হয়তো এই গ্লাসগুলো এত আদর পেত।

আমরা ভাই বোনেরা সারাবছর শুধু এই গ্লাসগুলো দেখতাম। ওরা যেখানে থাকতো সেখান থেকেই কিসব যে নিয়ে আসতো তাই খেত সকালে, কি সুন্দর ঘ্রান ছিল ওসব খাবারের! সারাদিন সেই গন্ধে ঘরটা একটা ফুল হয়ে থাকতো । চুলাপড়ে মা ওদের জন্য রস দিয়ে কি একটা জিনিস তৈরী করছেন। সেদিন সারাটিক্ষন মায়ের আঁচল ধরে চুপটি করে বসে থাকলাম। রসনা আপা চুলার পাড়ে বসে মাকে বোঝাচ্ছেন, কি করে চা বানাতে হয়।

মা কত কিছু রান্না করতে পারে অথচ আজ শীতের মধ্যেও ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠলো। সেই চা মা আমাকে খেতে দেয়নি। ওসব শহরের মানুষ খায়। আমাদের ওসব খেলে মুখ নাকি পুড়ে যাবে। মা, মা, বকুলকে সারাজীবন সেই চা খাওয়াতে চেয়েছিলাম।

সেই চা খেতেও বকুলের আগ্রহ হয়নি। সেই বকুল সোহরাবকেই বিয়ে করেছে একদিন। আমি শুধু পড়েছি। পড়ে পড়ে এত বড় হয়েছি তারপর অজান্তেই পড়ে গেছি, নিজের হাত থেকে। আফরোজা একটি মগ হাতে উঠে এসেছে।

চোখে মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। জাহাজের যাত্রীদের অবগতির জন্য ক্যাপ্টেন জেমস সেইলসের ঘোষনা এলো তখনি। আমি আর আফরোজা এগিয়ে গেলাম নেটওয়ার্ক রুমের দিকে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে এরইমধ্যে...। জাহাজ যত দ্রুত সম্ভব উত্তরে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন জেমস।

বিবিসির আবহাওয়া পুর্বাভাস বলছে, সাইক্লোন ‘সিডর’ দু একদিনের মধ্যে আঘাত হানবে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে। জাহাজ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে পদ্মার একটি চরে আমি নেমে পড়লাম। আফরোজা রয়ে গেছে জাহাজেই। --------------------------------------------------------------------------


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।