উপর থেকে আদেশ- সকাল নটা থেকে বিকাল পাচটা, এই সময়ে অফিসে থাকতে হবে, কাজ থাকুক আর না থাকুক, ছুটি নেয়া বন্ধ। রাফিও বাধ্য ছেলের মত যায়-আসে। প্রতিদিন অফিস থেকে এসে তার ছোট্ট বাবুটার সাথে কিছুক্ষণ বিছানায় খেলাধুলা করে । তারপর একটু বিকেল-ঘুম দিয়ে সন্ধ্যা শুরু করে রাতের অপেক্ষায়। এটাই রাফির গত দু মাসের রুটিন।
যেমন এই সন্ধ্যাটা। ক্লান্ত রাফি আজ অফিসের কাপড় না খুলেই ঘুমিয়ে পরেছিল। রোকসানা তার বাহু ধরে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। বিদ্যৎ নেই, মোমের আলোতে রাফি তার স্ত্রীর দিকে তাকায়। অপরিচিত লাগে, তার পাঁচ বছরের চেনা এই মুখটা কেন যেন ইদানিং চিনতে কষ্ট হয়, রাজ্যের অন্তহীন নিস্পন্দ চোখ তার।
রাফি বিছানায় উঠে বসে, ভাবে আজ রাতে তার ডিউটিতে যাবার কথা। রাফির এই রাতের কাজে কোন ঠিক-ঠিকানা নেই, কখন ডাক আসবে, আগে-ভাগে তা জানার উপায়ও নেই। তবুও রাফি তীর্থের কাকের মত প্রতি সন্ধ্যায় অপেক্ষায় থাকে, যদি ডাক আসে।
'ছোটু কোথায়' রাফি তাকায় রুনার দিকে। বিয়ের পর থেকে রাফি তার স্ত্রীকে রুনা বলে ডাকে ।
'রুমী তো বাসায় নেই'। কেন যেন রাফির ভেতরটা কেঁপে উঠে কিন্তু বুঝতে দেয় না। ছোটু আজকাল খুবই ধী-স্থির,চুপচাপ। কাউকে কিছু বলে না। রাফি অনেকবার রুমীকে বলেছে সন্ধ্যায় বেরুলে যেন তাকে বলে যায়।
কিন্তু প্রতিবারই রুমী তাকে না বলে যায়- হয়তোবা এমনটাই নিয়ম।
বাথরুমে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে রাফি। বেড রুমের জানালাটার পাশে এসে দাঁড়ায়। আকাশ পূর্ণিমার আলোতে ভরে গেছে। রাফির দৃষ্টি চলে যায় দুরের ফ্যাক্টরির দানব চিমনিটার দিকে।
কত দিন ঐ চিমনির মুখ দিয়ে লকলকিয়ে ধোঁয়া বেরোয় না। নাইট শিফটের সাইরেনটা আর জ্বালাতন করে না। 'কখন বেরিয়েছে ছোটু' রাফি ডাকে রুনাকে। দেখিনি, ও চিরকুটেতে লিখে গেছে 'আসতে দেরি হতে পারে'।
শহরটা খুব বেশি শান্ত আজ, অপেক্ষা করছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে বেশ বড় একটা আয়োজনের।
দূরে গলির মুখে একটা মাদি কুত্তা ঘেউ ঘেউ করছে- কেউ নেই যে সেটাকে থামাবে। রুনা এসে দাঁড়ায় রাফির পাশে। শীতল এক টুকরো বাতাস এসে দুজনকে যেন একটু কাছাকাছি এনে দেয়।
'আচ্ছা এমন একটা পূর্ণিমা রাতে আমার জন্য তুমি আগের মত কবিতা লিখবে, সেই কবিতায় থাকব শুধু তুমি, আমি আর চাঁদটা' হঠাৎ করেই যেন বালিকা হয়ে যায় রুনা। এই রুনাকে রাফি অনেকদিন আগে দেখেছিল।
রাফি রুনাকে ঠিক বুঝতে পারে না। যেমন রাফি না বুঝেই বলে 'এরকম চাঁদ কি আবার আসবে আমদের কাছে ?' দুজনে থেমে যায়-এর উত্তর তাদের জানা নেই সম্ভবত।
এলোপায়ে রাফি ঘরের মাঝে এসে দাঁড়ায়। শহরের নীরবতা তাদের স্বপ্নে ভরা এই রুমটাতে ঢুকে পরে। জানালার পাশে রুনার ঘন চুলে চাঁদের আলো ঢেউ তোলে।
হেমন্তের মৃদু বাতাস এসে ফেঁনিয়ে তোলে সে কালো ঢেউকে। রুনাকে কাছে ডাকে। দুজনে মুখোমুখি, কিছু একটা আকড়ে ধরতে চায় দু জোড়া চোঁখ। রাফির হাত চলে যায় রুনার তলপেটে, আলতো করে হাত ঘুরে বেড়ায়, অনুভব করে তাদের আরেকটি সন্তানের বেড়ে উঠার কম্পন। কিছু ব্যাকুলতা, কিছু বন্ধন জেগে উঠে, রাফি কি একটু আবেগপ্রবণ হয়? হয়তো বা।
রুনা এক ঝটকায় রাফির হাত সরিয়ে দেয় । রেগে যায় 'সরে দাঁড়াও, তোমাকে এভাবে মানায় না। তোমাকে আমি চিনি না, তুমি আমার প্রেমিক নও, স্বামী নও, কেউ নও, তুমি আমি শুধুই দুজন নারী পুরুষ, তোমার সামনে যে নারী কে দেখছ সে শুধুই একজন মা, এর বেশি ভেবো না এই মূহুর্তে '। চাপাস্বরে এক নিঃশ্বাসে বলে রুনা থামে।
আবার কে যেন নীরবতায় ঠুসে দেয় রুমটা, দেয়ালে দেয়ালে কি যেন ফিস ফিস করে।
রাফি-রুনা তাই শোনার ভান ধরে। রিষ্ট-ওয়াচের রেডিয়াম ডায়ালটা দেখে । সময়টা ট্রাফিক জ্যামে আট্কে আছে আজ। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে বলে রুনা ডাইনিং রুমে চলে যায়। খাবার টেবিলে মুখোমুখি বসে দু জনে একটু ভাত ডলে, একটু খায়, চামচ-বাটি টুংটাং শব্দ তোলে, দুটা একটা কথা বলে, সবই অপ্রয়োজনীয় সাংসারিক আলাপ।
আচমকা দরজায় একটা টোকা পরে। রাফি-রুনা থেমে যায়, শব্দের উৎসের দিকে সব ইন্দ্রিয়গুলো ছুটে চলে। টোকা পরে আবার, আবারও। 'ওরা' রুনার চোখে প্রশ্ন। আঙুলের ইশারায় চুপ করতে বলে রাফি।
একে একে বিশটা মিনিট চলে যায়। 'তারা' নিচুস্বরে নিশ্চিত করে রাফি।
খাবার টেবিল থেকে উঠে রাফি বেডরুমে ঢুকে, মোমের আলোতে তার ঘুমন্ত বাবুটার দিকে তাকায়, মনে মনে হয়তো তার কাছ থেকেও বিদায় নেয়। একটা মাফলার গলায় জড়িয়ে সন্তপর্নে দরজা খোলে রাফি। 'যাই' বলে একবার তাকায় রুনার দিকে।
রুনা পাথরের মূর্তির মত খাবার টেবিলে বসেই থাকে, একটুও নড়ে না, শুধু মুখে বলে 'যাই না, বল আসি'।
রুনা এভাবেই বসে থাকে ঠায় অথবা বুকের কাছে তার ছোট বাবুটাকে নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকে নির্ঘুম। চার-দেয়ালের এই ঘরে থেকেই অনুভব করার চেষ্টা করে রাফি-রুমীদের রাতের অন্ধকারের নি:শব্দ ছোটাছুটি। হয়তো দুরে কোথাও বিকট শব্দে ফেটে চৌচর করে ফেলে শহরের নিস্তব্ধতা কিংবা ট্যাঁ-ট্যাঁ করে গুঙিয়ে ওঠে মানুষ মারার যন্ত্রগুলো। রাফি-রুনার উপন্যাসে শুরু হয় নভেম্বরের আরেকটি প্রলম্বিত রাত।
শুরু হয় অপেক্ষার, রুনা অপেক্ষায় থাকে, রাফি-রুমিরা ভোর রাতে ফিরে অথবা হারিয়ে যায়, কখনই ফিরে আসে না। হয়তো স্মৃতি হয়ে থাকে তাদের ঘরে ফেরার 'গল্প' পরিচিতজনের মনে, হয়তো অক্ষরে ছাপা হয় তাদের চলে যাবার 'গল্প' কোন এক উপন্যাসের-একাত্তর অধ্যয়ে। কিংবা রুনাদের অপেক্ষার রাত্রিগুলো হারিয়ে যায়, কেউ জানতেও পারে না.........................
০৯,১২,০৫
৩০৫,ব্যলকনি।
ছবিসুত্র: গুগল
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।