আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেগম রোকেয়া - লাঞ্ছনা গঞ্জনাই ছিল যাঁর প্রাপ্তি

জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই
১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কোলকাতায় বেগম সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন বেগম রোকেয়া। মাত্র ৮ জন ছাত্রী ছিল সেই স্কুলের। এই স্কুল প্রতিষ্ঠাই তাঁর জন্য কাল হল। অশ্লীল গালাগালি, নিন্দা, বিদ্রুপ, অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁর বাকি জীবন। তাঁর যুগান্তকারী এই কাজের কোন স্বীকৃতি না পেয়েই অপমান, গঞ্জনা, অভিশাপ পেতেই পেতেই তিনি ১৯৩২ সালের ০৯ ডিসেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

গতকাল ছিল বেগম রোকেয়া দিবস। শুনলাম আলোচনা (ভালোচনা) অনুষ্ঠান। কেউ বলল না, তাঁর সংগ্রামের কথা, তাঁর লাঞ্ছনার কথা, তাঁর গঞ্জনার কথা। সবাই কেবল আহা উহু করল। বেগম রোকেয়া মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই ছিল তার তাঁর অপরাধ।

সামাজিক বিরোধিতা, বিদ্রুপ, নিন্দা প্রভৃতির জন্য তিনি সব সময় তটস্থ থাকতেন। এক সময় সমাজে তার সম্পর্কে প্রচারিত হয়েছিল - ‍যুবতী-বিধবা স্কুল স্থাপন করিয়া নিজেই রূপ যৌবনের বিজ্ঞাপন প্রচার করিতেছেন। এই প্রচারণা যে ডাহা মিথ্যা তা তার স্কুল বাসের বর্ণনা শুনলেই বোঝা যায়। বেপর্দার ভয়ে যে বাসে ছাত্রীরা আসত সেটাকে চারদিক থেকে বন্ধ করে এয়ার টাইট করা হয়েছিল। ফলে প্রায়ই সংবাদ আসত - গাড়ি বড্ড গরম হয়, মেয়েরা বাড়ি যাবার পথে অস্থির হয়।

কেহ কেহ বমি করে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে। রোকেয়ার এক বান্ধবী একদিন এসে বললেন, আপনাদের মোটর বাস তো বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে, আলমারি যাচ্ছে নাকি - চারদিকে বন্ধ তাই বড় আলমারি বলে ভ্রম হয়। তাঁর স্কুলের ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য কোন শিক্ষয়িত্রী খুঁজে পাওয়া যেত না।

উপরের শ্রেণীর ছাত্রীরাই নিচের শ্রেণীগুলোতে শিক্ষয়িত্রীর কাজ করত। অর্থের অভাব ও স্কুলের আসবাবপত্রের অভাব সব সময়ই ছিল। জীবনের সুদীর্ঘকাল তিনি এই একটি স্কুলের জন্য কঠোর সংগ্রাম করেছেন এবং তার জীবদ্দশায় তার কাজের কোন স্বীকৃতি তো পানই নাই, উল্টো নোংরা অপমানই পেয়ে গেছেন। কিন্তু এই অপমান লাঞ্ছনা তাঁকে তাঁর মহান কর্মক্ষেত্র থেকে সরাতে পারে নি। তিনি বলেছেন, যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা, গ্লানি, উপেক্ষা, অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে।

রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। তাঁর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তাঁর বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি, তাদেরকে ঘরে আরবী ও উর্দু শেখানো হয়।

তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিকমনস্ক ছিলেন। তিনি রোকেয়া ও করিমুননেসাকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজী শেখান। কিন্তু এই গোপনে বাংলা ইংরেজি শিক্ষার কথা আর গোপন থাকে না। এ জন্য তার পরিবার পরিজনের কম বিদ্রুপ রোকেয়াকে সহ্য করতে হয় নি। ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে।

বিয়ের পর তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে পরিচিত হন। তাঁর স্বামী মুক্তমনা মানুষ ছিলেন, রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন এবং একটি স্কুল তৈরীর জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেন। রোকেয়া সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যজগতে পা রাখেন। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন।

বেগম রোকেয়া তার স্বামীর মৃতু্যর পর ৫০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন, সেই টাকা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ভোগ বিলাসে ব্যয় না করে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করেছিলেন। তাঁর স্বামীর মৃতু্যর পাঁচ মাস পর রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নামে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ভাগলপুরে। বেগম রোকেয়া ছিলেন তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর স্বামীর মৃত প্রথম স্ত্রীর কন্যা ও জামাতা সম্পত্তি নিয়ে রোকেয়া সঙ্গে নানারকম দুর্ব্যবহার করে। ফলে ১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার ফলে স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে যান।

এখানে ১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল পুনরায় চালু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় ছাত্রী ছিল ৮ জন। চার বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪-তে। ১৯৩০ সালের মাঝে এটি হাই স্কুলে পরিণত হয়। বেগম রোকেয়া তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল নিয়ে ব্যাপক সংগ্রাম করেন।

স্কুলটির আঠারো বছর পূর্তির সময় তিনি লেখেন - এই আঠারো বছর ধরিয়া এই গরীব স্কুলকে জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখিবার জন্য কেবল সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। দেশের বড় বড় লোক যাঁহাদের নাম উচ্চারণ করিতে রসনা গৌরব বোধ করে, তাঁহারাও প্রাণপণে শত্রুতা সাধন করিয়াছেন। স্কুলের বিরুদ্ধে কত দিকে কত প্রকার ষড়যন্ত্র চলিতেছে, তাহা একমাত্র আল্লাহ জানেন, আর কিছু কিছু এই দীনতম সেবিকাও সময় সময় শুনিতে পায়। একমাত্র ধর্মই আমাদিগকে বরাবরই রক্ষা করিয়া আসিতেছে। স্কুলের অনিষ্ট করিতে কতকগুলি লোক বদ্ধপরিকর আছেন।

কোন কারণে আমার প্রতি কেহ বিরক্ত হইলে তিনি আমার অনিষ্ট কামনা এই স্কুলেরও অনিষ্ট করিয়া বসেন। আমি নিজে এমনই নির্বাণ মুক্তিলাভ করিয়াছি যে আমার অনিষ্ট কেহ করিতে পারে না। কারণ ন্যাংটার নাই বাটপারের ভয়। লোকে আমার কী করিবে ? আমার মেয়ের বিবাহ পণ্ড করিবে ? আমার ছেলের বিবাহে ভাংচি দিবে ? আমার নিজের পার্থিব কী আছে যাহা কেহ নষ্ট করিবে ? বরং স্কুলের পতন হইলে সংসারে যেটুকু মায়ার বন্ধন আছে, আমি তাহা হইতেও মুক্তিলাভ করিব। বলিয়াছি, একমাত্র ধর্মই আমাদিগকে রক্ষা করিয়া আসিয়াছে।

আমি জীবনের শেষ দিনে এই ভাবিয়া শান্তির নিঃশ্বাস ফেলিতে পারিব যে, এই স্কুল পরিচালনার ব্যাপারে আমি নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্য একটি মিথ্যা কথা বলি নাই এবং স্কুলের একটি পয়সাও নিজে ভোগ করি নাই। রোকেয়ার কোন জীবিত সন্তান ছিল না। জন্মের পরই তার সব সবগুলো সন্তান মারা যায়। কিন্তু সন্তানহীনা হলেও তাঁর স্নেহ মায়ার অমৃত ধারা নিজের মধ্যে আবদ্ধ রাখেন নি। স্কুলের মেয়েদেরই তিনি নিজের সন্তানের মতো মনে করতেন।

তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্কুলের মেয়েরা তার স্নেহ বঞ্চিত হয় নি। অথচ এই স্নেহ মায়ার প্রতিদানে তিনি কী পেলেন ? তিনি বলে গিয়েছেন - আমি কারসিয়াং ও মধুপুরে বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি, উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগর তীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিচিত্র আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনের পঁচিশ বছর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠ-মোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াছি। এই মহিয়সী নারীর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং তাঁর সঙ্গে করা সকল অমানবিক আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তথ্য সূত্র : ০১) বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংগ্রাম ও সাধনা লেখক : মোহাম্মদ বজলুল হক।

০২) বাংলা উইকিপিডিয়া ছবি সূত্র : বাংলা উইকিপিডিয়া। উইকি লিংক
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।