আমি সত্য জানতে চাই
‘এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে,
সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে’-
চিরায়ত নিয়মের এই মর্মবাণীটি যার কথায় এবং সুরে সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায় তিনি কবিয়াল বিজয় সরকার। তিনি গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও ঈশ্বর বন্দনায় মগ্ন একজন মানুষ। বিজয় সরকার ১৩০৯ বাংলা সালের ৬ ফাল্গুন তথা ১৯০৩ সালের ১৯ ফেব্রয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। আজ তাঁর জন্মদিন। চারণ কবির জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা
উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবিয়াল মরমী গানের গীতিকার, সুরকার, গায়ক, চারণ কবি বিজয় সরকারের জন্ম ১৩০৯ সালের ৬ ফাল্গুন (বাংলা), ইংরেজী ১৯০৩ সালের ১৯ ফেব্রয়ারি নড়াইল জেলার সদর উপজেলার ডুমদি গ্রামে।
তার পিতার নাম নবকৃষ্ণ আধিকারী, মা হিমালয় দেবী। দশ ভাইবোনের মধ্যে বিজয় ছিলেন সবার ছোট। বিজয় সরকারের প্রকৃত নাম বিজয় অধিকারী। যুগে যুগে যেসব ভাবুক কবি এসে আমাদের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে আলোকিত করেছেন, মানুষের মনের ভেতরের অন্ধকারকে দূর করে পবিত্র আলোর শিখা পৌঁছে দিয়েছেন, ঈশ্বর বন্দনায়, আধ্যাত্মিকতায় এই অসুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলেছিলেন-বিজয় সরকার ছিলেন তাঁদেরই একজন। তিনি ছিলেন আধ্যত্নিক চিন্তা-চেতনার প্রাণপুরুষ।
যেকোনো ধর্মের প্রতিও সহনশীল। কৈশোরে তিনি কবি পুলিন বিহারী ও পঞ্চানন মজুমদারের সহচর্যে আসেন ও পাচালী গানের দীক্ষা পান এবং পরবর্তিতে পাচালী গানে খ্যতি অর্জন করেন। সঙ্গীত সাধনার জন্য তিনি ‘সরকার’ উপাধি লাভ করেন। বিজয় সরকার তার ভক্ত ও স্থানীয়দের কাছে ‘পাগল বিজয়’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তার (বিজয়) আধ্যাত্মিক বিভিন্ন কর্মের জন্য ভক্তরা তাকে ‘পাগল বিজয়’ হিসেবে সম্বধন করেন।
নিজের লেখা গানেও নিজেকে পাগল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন বিজয় সরকার।
বিজয় সরকার স্থানীয় স্কুলে নবমশ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন। মতান্তরে মেট্রিক পর্যন্ত। তারপর ঐ স্কুলেই পড়ান কিছুকাল। পরে স্থানীয় জমিদারীর কাচারিতে নায়েবের চাকরি নেন।
অবসর সময়ে গান করতেন। ১৯২৯ সালে তিনি কবিগানের দল গঠন করেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বিজয় সরকারের গানের আসরে উপস্থিত ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসীমউদদীন, কবি গোলাম মোস্তফা, শিল্পী আব্বাস উদ্দিন, সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহার, ধীরেন সেন প্রমুখ। তারা তার গান শুনে মুগ্ধ হন। বিশ্ববরেন্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের সঙ্গেও তার গভীর বন্ধুত্ব ছিল।
সুলতান বার বার ছুটে যেতেন বিজয় সরকারের বাড়িতে ।
(নড়াইলে কবি বিজয় সরকারের বাড়ি)
কবিগানের উৎকর্ষ সাধনে তার অবদান অসামান্য। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রয়ারি কলকাতার ‘ভারতীয় ভাষা পরিষদ’ বিজয় সরকারকে সংবর্ধিত করে। ফকির লালন শাহ্ এর “বাড়ির কাছে আরশি নগর” এবং জসীমউদ্দিনের “নকশী কাঁথার মাঠ” নিয়ে ও তিনি গান লিখেছেন। তিনি ১ হাজার ৮০০ গান করেছেন বলে জানা যায়।
তবে মত পার্থক্য রয়েছে। তিনি একাধারে লিখেছেন আধ্যাত্মিক গান, ইসলামি গান প্রেমের গান, বর্ষার গান প্রভৃতি।
কবিয়াল বিজয়ের কয়েকটি অসম্ভব জনপ্রিয় গান হলো:
১. পোষাপাখি উড়ে যাবে সজনী একদিন ভাবি নাই মনে
২. এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে
৩. কালার প্রেমে এতো জ্বালা হারে আমি আগে জানি নাই
৪. আল্লাহ রসুল বল মোমিন আল্লাহ রসুল বল
৫. নকশি কাঁথার মাঠেরে আজও কাঁদে রূপাই মিয়ার বাঁশের বাঁশি
৬. শুধু পাষাণ নয় এই তাজমহলের পাথর
৭. আমি কৃঞ্চ বলিয়া ত্যাজিব পরাণ যমুনার তীরে
৮. আমায় পাগল পাগল করেছে কালার বাঁশিতে
৯. তুমি জানোনা'রে প্রিয়
১০. সুন্দর এই পৃথিবী
১১. কি সাপে কামড়াইলো
১২. জানিতে চাই দয়াল
১৩. পরবাসি হইয়া
জীবদ্দশার শেষ দিকে বিজয় সরকার খুলনা বেতারের নিয়মিত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুরস্রষ্টা, গীতিকার ও গায়ক চারন কবিয়াল বিজয় সরকার ১৯৮৫ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর পরে তাকে পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ার বাড়িতে সমাহিত করা হয়।
দেশ ও সমাজের জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্য শিল্পকলায় (মরণোত্তর) একুশে পদক ২০১৩ জন্য মনোনীত হয়েছেন বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী (চারন কবি বিজয় সরকার)। বাংলাদেশ সরকার সরকার ২০১৩ সালের একুশে পদকের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করেছেন তাকে । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মনোনীতদের আনুষ্ঠানিকভাবে এ পদক প্রদান করবেন। বাংলা লোকসংস্কৃতির এই অসামান্য স্বীকৃতির জন্য আমরা গর্বিত।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধারা কবি গানের উৎকর্ষ সাধনে আধ্যত্নিক চিন্তা-চেতনার প্রাণপুরুষ বিজয় সরকারের জন্মদিনে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।