zahidmedia@gmail.com
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়, টালমাটাল বাংলাদেশ গঠনে এই সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য দেশবাসী বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি আজ বিএনপির পতাকার নিচে। দেশের প্রত্যেকটি দুঃসময়ে আমরা দেশবাসীর পাশে থেকেছি। দেশের স্বার্থ এবং গণতন্ত্রের উপর যখনই আঘাত এসেছে- সবার আগে এবং সবচেয়ে সাহসিকতা নিয়ে বিএনপি দাঁড়িয়েছে তা প্রতিহত করার জন্য।
এর জন্য মূল্যও আমাদের কম দিতে হয়নি। শহীদ জিয়া জীবন দিয়েছেন। আর আমাদেরকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক জুলুম-নির্যাতন। ১৬ বছর পর মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে বিএনপির দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেগম জিয়া এসব কথা বলেন।
সম্মেলনে আগতদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজ আপনারা এখানে, এই সম্মেলন কেন্দ্রে সমবেত হয়েছেন বিএনপি-র জাতীয় কাউন্সিলে।
আপনারা এসেছেন উত্তরে পঞ্চগড় থেকে, দেিণ কক্সবাজার থেকে, পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে, পূর্বে সিলেট থেকে। আপনারা এসেছেন উত্তরে ইউকে থেকে, দেিণ অস্ট্রেলিয়া থেকে, পশ্চিমে আমেরিকা থেকে, পূর্বে মালয়শিয়া থেকে। আজ এখানে ঘটেছে সর্ব¯Íরের, সর্বশ্রেণীর মানুষের এক মহা-সম্মিলন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আপনারা সবাই ঘটিয়েছেন এক অভূতপূর্ব বিশাল জনসমাবেশ। মহান বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিত জনগণের বিপুল সমর্থনধন্য দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল - বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ৫ম জাতীয় কাউন্সিলের এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি আপনাদের সকলকে স্বাগতঃ জানাচ্ছি।
মাত্র কিছুদিন আগেই আমরা আমাদের দলের ৩১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করেছি। দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় এই ৩১ বছর ধরে প্রত্য ও পরোভাবে আপনাদের যে সহযোগিতা ও সমর্থন আমরা পেয়েছি - সে জন্য আপনাদেরকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
তিনি বলেন, আজকের এই মহতী সম্মেলনের শুরুতেই আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অকাতরে জীবন উৎসর্গকারী দেশমাতৃকার বীর সন্তানদের। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি জাতীয় নেতা মরহুম শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক, আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবর রহমানকে। কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে।
শ্রদ্ধা জানাই দেশের সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং যারা বিভিন্নভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন, নানা নির্যাতন ও জুলুমের শিকার হয়েছেন - তাঁদের সকলের প্রতি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, গণতন্ত্র সুরার লড়াইয়ে যারা ত্যাগ শিকার করেছেন এবং জনগণের পে কাজ করতে গিয়ে আমাদের যেসব সাথী জীবন দিয়েছেন - আজ তাঁদের স্মৃতির প্রতিও জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, মাত্র পঁয়ত্রিশ মাস আগেও আজকের এই মহা-সম্মিলন ছিল কল্পনারও অতীত। আপনারা সবাই জানেন, প্রায় পঁয়ত্রিশ মাস আগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে কী ঘটেছিল! আপনারা জানেন, সেই দিনটির নাম চক্রান্তকারীরা দিয়েছে ইংরেজি ভাষায় ‘ওয়ান ইলেভেন’। এই নামটি তারা নকল করেছিল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর-এ আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে গেরিলা হামলার অনুকরণেÑ যার নাম হয়েছিল ‘নাইন-ইলেভেন’।
সেই নাইন-ইলেভেনের গেরিলা হামলা আমেরিকার হৃদপিন্ডে আঘাত করেছিল। আর ঠিক একইভাবে সেই ওয়ান-ইলেভেনের চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশের হৃদপিন্ডে আঘাত করেছিল। আপনারা জানেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। সেই নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে একটি মহল নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র শুরু করে। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতা নস্যাৎ করার এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় দেশী-বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহল।
সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে ঢাকার রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পৈশাচিক কায়দায় মানুষ খুন করা হয়। অব্যাহত অবরোধের মাধ্যমে জনগণকে জিম্মি এবং জাতীয় অর্থনীতির সীমাহীন তিসাধন করা হয়। এভাবেই অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক শাসন জারির ত্রে প্রস্তুত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশবাসীর উপর এক ভয়ঙ্কর দৈত্যের মতো চেপে বসে জরুরি অবস্থার আবরণে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি সমর্থিত একটি অসাংবিধানিক সরকার। দেশের সংবিধান এবং প্রচলিত সব রীতি-নীতি উপো করে দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলতে থাকে সেই অবৈধ সরকারের গণতন্ত্র-বিনাশী ও জনস্বার্থ বিরোধী অপশাসন।
তিনি বলেন, ওই অবৈধ সরকারের গণবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের টার্গেট ছিল একদিকে দেশের সর্ব অঞ্চলের সর্ব¯Íরের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এবং অন্যদিকে টার্গেট ছিল দেশের সর্ব অঞ্চলের সর্ব শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। তাদের শিকার হন রাজধানী ও মফস্বলের উঁচু ও নিচু পর্যায়ের সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। তাদের শিকার হন রাজধানী ও গ্রাম-গঞ্জের ছোটবড় সব ব্যবসায়ী। ভেঙে ফেলা হয় যুগ যুগ ধরে চলে আসা গ্রামগঞ্জের হাট-বাজার। ভেঙে ফেলা হয় শহরের ফুটপাথে হকারদের বাজার।
তাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে তৈরি করা হয় তামাশার মার্কেট Ñ হলিডে মার্কেট! ভেঙে ফেলা হয় শহরের বহু বাড়ি-ঘর। ভেঙে ফেলা হয় বহু ব¯িÍ ও উপশহর। সর্বনাশা ভাঙ্গনের সেই সরকার সৃষ্টি করতে পারেনি কিছুই। বরং তারা কর্মহীন, গৃহহীন করে ফেলে লাখ লাখ মানুষকে। অসহায় হয়ে পড়ে অসংখ্য পরিবার।
বেগম জিয়া আরও বলেন, অবৈধ সেই সরকার মানুষের গচ্ছিত সঞ্চয় ও পুঁজিতে হাত দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা দেয়ার নামে জবরদস্তি করে তারা শত শত কোটি টাকা চাঁদা তুলেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক তথ্য অনুযায়ী জোর করে আদায় করা সেই টাকার সামান্য অংশই রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা হয়েছিল। দুর্নীত দমনের নামে দুর্নীতির এই ব্যাপক ও অবাধ চর্চা মানুষকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। এটাকে প্রতিরোধের মতা নিরস্ত্র মানুষের ছিল না।
তাদের অনেকেই জেলবন্দী হন। অনেকে পালিয়ে যান বিদেশে। আর বেশির ভাগই আতংকে থাকেন নিজের দেশেই।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও ব্যবসায়ীদের রিমান্ডে নিয়ে, চরম নির্যাতন করে, ভূয়া স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তারা একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করতে থাকে। বস্তুত তাদের প্রশাসনিক কাজ তখন শুধু গ্রেফতার, রিমান্ড, টর্চার ও মামলা দায়েরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভীত পলিটিশিয়ান ও সন্ত্র¯Í বিজনেসম্যানদের পে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়ে। আর, তার ফলে চাল, ডাল, তেল, নুন, গুড়া দুধ, সব নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যায় বহু গুণ। ১১ জানুয়ারির হোতা মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনদের চক্রান্ত করার যোগ্যতা থাকলেওÑ দেশ চালানোর ন্যূনতম যোগ্যতা তাদের ছিল না। সকল েেত্র তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও হ¯Íপে এবং ষড়যন্ত্র ও ব্যর্থতা এক ভয়ঙ্কর অবস্থা ডেকে আনে দেশের জন্য।
তারা সংবিধান ভেঙ্গে তাদের মনের মানুষদের নিয়ে একটি অবৈধ সরকার গঠন করে। তারপর তারা তথাকথিত ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকর করতে এগিয়ে যায়। অর্থাৎ বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে, বিভিন্ন দল ভেঙে এবং দলছুটদের নিয়ে কিংস পার্টি গঠনের অপচেষ্টা করতে থাকে। অপরদিকে কিছু অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে পলিটিশিয়ানদের চরিত্র হনন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সেই সরকারের অতি বিপ্লবী ও অতি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যোগ দেয় নির্বাচন কমিশন ও বিশেষ আদালত।
অবৈধ সরকার, নির্বাচন কমিশন ও বিশেষ আদালতের এই ত্রিভুজ বা ট্রয়কা, বাংলাদেশের অতি কষ্টার্জিত এবং এর মাত্র পনের বছর আগে পুনঃঅর্জিত গণতন্ত্রকে ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করে।
খালেদা জিয়া বলেন, জরুরী অবস্থার আওতায় বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মীসহ অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাকে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়। বহুজনকে সাজানো মামলায় প্রহসনের বিচারে ২ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেয়া হয়। আমি দেশ ও দলের কথা বললাম। এবারে পরিবার ও ব্যক্তির কথা বিনীতভাবে বলতে চাই।
ওই সময়ে বিএনপির সংগ্রামী নেতা-কর্মীদের, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের অহেতুক গ্রেফতার করে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়। রিমান্ডের নামে নেতা-কর্মীদের ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। ভয়-হুমকি দেখানো হয় তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের। আমার পরিবারও হয় তাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার। আমার দুই ছেলেকেই গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারের পর আমার বড় ছেলে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব তারেক রহমানকে ভয়ঙ্কর নির্যাতন করে পঙ্গু করে ফেলা হয়। বানোয়াট মামলা রুজু করা হয় বিএনপি নেতা-কর্মী এবং আমার দুই ছেলে ও আমার বিরুদ্ধে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা বলেন, আমিই যে তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিলাম সেটা আপনারা জানেন। দেশকে বিরাজনীতিকরণের চক্রান্তের অংশ হিসাবে তারা মাইনাস টু ফর্মুলা প্রচার করেছিল। আসলে সেটা ছিল মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা- শুধু আমাকে মাইনাস করার ফর্মুলা।
তারা জানতো আমাদের প্রিয় দল বিএনপিকে খন্ড-বিখন্ড ও দুর্বল করার প্রক্রিয়া কখনোই সফল হবে না, যদি আমি অটল থাকি। সে কারণেই তারা আমার ছেলেদের জিম্মি করে আমাকে জোর করে কয়েকবার বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি তাদেরকে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেইÑ এদেশ আমার। এদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। আমার প্রিয় দেশ ও আমার দেশের অসহায় ও অধিকারবিহীন জনগণকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।
মরতে হলে এদেশের পবিত্র মাটিতেই মরবো। আমার এই দৃঢ়তা শুধু আমাকে বিদেশে পাঠানোর ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ করে দেয়নি, অন্য একটি দলের নেত্রীকেও দেশে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছিল। এখানে আমি সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০০৭ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরে পর্যন্ত আমি নিজের বাড়িতে অন্তরীণ ছিলাম। তারপর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি সাবজেলে বন্দী ছিলাম। পান্তরে অন্য একটি দলের নেত্রী জরুরী অবস্থা জারির পর বিদেশে চলে যান।
যাবার সময়ে তিনি ঢাকা এয়ারপোর্টে বলে গিয়েছিলেন, দেশে ফিরে এসে চক্রান্তকারীদের সব কাজের বৈধতা তিনি দিয়ে দেবেন। তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন কিন্তু তিনিও জেলবন্দী হন। পরে তাকে আবার বিদেশ চলে যাবার সুযোগ দেয়া হয়। একটানা দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে আমি জেলে থাকি। আমার আপোষহীনতাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়।
আমি ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে উচ্চ আদালতের রায়ে মুক্ত হই। আর তিনি ফিরে আসেন ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে।
জেল জীবন সম্পর্কে খালেদা জিয়া বলেন, অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেমন কেটেছে আমার একটানা নির্জন কারাবাস? সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় এখন নয়। তবে এটুকুই বলতে পারি যে, জেলে আমাকে শুধু একনজর দেখার জন্য আমার বৃদ্ধা মা দিনাজপুর থেকে কষ্ট করে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন, কিন্তু তাকে আমার সাথে দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। আমি বেঁচে আছি কিনা, বেঁচে থাকলেও কেমন আছি, এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তা ও শোকে মৃত্যুবরণ করেন আমার মা।
মাকে দেখার শেষ সুযোগও আমাকে দেয়া হয়নি। আমাকে দেখতে হয়েছে তার লাশ। শুধু মাকে নয়, কোনো নিকট আত্মীয়-স্বজনকেই আমার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এমনকি আমার মায়ের লাশ দেখার দিন আমার কারারুদ্ধ অসুস্থ ছেলেদের সাথে আমাকে দেখা করতে দেয়া হয়নি। আমার সাথে যাতে তাদের দেখা না হয় সে জন্য আমার দুই অসুস্থ ছেলেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল।
এমন নির্মম আচরণ করা হয়েছিল শুধু আমাকে দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করার জন্য। কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। এটাই ছিল আমার অপরাধ। আর সেই অপরাধের জন্যই মিথ্যা অভিযোগে দুই পুত্রসহ আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল দীর্ঘ জেল-জীবন। আমি জানি, আমার মতো দুঃখের অভিজ্ঞতা হয়েছে দলমত নির্বিশেষে বহু মা ও বোনের।
দেশের সেই দারুণ দুঃসময় মানুষকে সুদূর অতীতের বর্গীদের হামলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। মনে করিয়ে দিয়েছিল নিকট অতীতে একাত্তরে হানাদার বাহিনীর বর্বর হামলার কথা। আপনারা জানেন, একাত্তরেও আমাকে এক সময়ে খুবই অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়েছিল।
স্বামীর স্মৃতিচারন করে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে আমার স্বামী যখন মুক্তিযুদ্ধে চলে যান তখন আমি জানতাম না, তিনি আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা। তখন আমার দুই মাসুম বাচ্চাকে নিয়ে গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে রাতের পর রাত আমাকে কাটাতে হয়েছিল।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনকে হাজার শুকরিয়া, আমার স্বামী ফিরে আসেন বিজয়ী বীর রূপে। কিন্তু আপনারা জানেন এর প্রায় দশ বছর পরে ১৯৮১-তে আমার স্বামী শহীদ হন চট্টগ্রামে। তখন থেকেই আবার শুরু হয় আমার অনিশ্চিত জীবন। ভেবেছিলাম দুই ছেলেকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, আপনাদের কারণে।
বিএনপির কারণে। বিএনপির নেতা-কর্মীরাই আমাকে দলে টেনে নিয়ে আসেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৮২ সাল থেকে আমি আপনাদের সঙ্গে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করি। ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে আমি দলের চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব নিই। সেই দায়িত্ব আজও বহন করে চলেছি।
মাত্র কয়েকদিন আগে আমাকে আবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একই পদে নির্বাচিত করা হয়েছে। এর জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি এখন খুবই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। নির্জন কারাবাস থেকে সোয়া এক বছর আগে আদালতের রায়ে মুক্ত হলেও আমি এখনো আরেক ধরণের নির্জনতার দণ্ড ভোগ করছি। গুরুতর অসুস্থ আমার দুই পুত্রই এখন চিকিৎসার জন্য বিদেশে পড়ে আছে।
আমার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ও হিতৈষীদের, এমন কি আমার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের পর্যন্ত আমার বাসায় আসতে নানাভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে। পবিত্র ঈদের দিনেও লোকজনকে শুভেচ্ছা জানাতে আমার বাসায় আসতে দেয়া হয়না। আমাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের জন্যও চলছে বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্র। অর্থাৎ এক এগারোর শাসকরা বিদায় নিলেও আমাদের হেনস্তা করার প্রক্রিয়া এখনও থামেনি। দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর এক দারুণ দুঃসময়ে দেশ ও বিদেশে যেসব সহকর্মী অসীম সাহস ও অনড় আনুগত্য নিয়ে দলের কাজ করেছেন, দলের ঐক্য ও সংহতিকে ধরে রেখেছেনÑ আমি তাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন এবং অজস্র ধন্যবাদ।
আমি গর্বিত যে, ওই দুঃশাসনের দুই বছরের অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার দেশবাসী মেনে নেয়নি। এদেশের সচেতন ছাত্র, শিক, আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক এবং টিভি টকশোর বক্তারা তখন সত্য উচ্চারণ করেছিলেন নির্ভীক চিত্তে। আমি তাদেরও জানাই অভিনন্দন এবং স্বীকার করি কৃতজ্ঞতা। আপনাদের সবার দেশপ্রেম, গণতান্ত্রিক চেতনা ও দলের প্রতি ভালোবাসার ফসল হচ্ছে আজকের এই মহা-সম্মেলন।
খালেদা জিয়া আরও বলেন, জানুয়ারি ২০০৭-এ নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচন বন্ধ করে যে অবৈধ সরকার মতায় এসেছিল বেগতিক দেখে তারাই আবার এ ২০০৮-এর শেষ দিকে সাধারণ নির্বাচন দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে।
গণবিরোধী একটি অবৈধ সরকারের অধীনে এবং পপাতমূলক এক নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে নাÑ এটা আমরা জানতাম। কিন্তু দেশ ও জনগণের কতিপয় বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করে আমরা সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। আপনারা জানেন যে, একটি প্রধান দল এবং তার সহযোগীরা জরুরি অবস্থার মধ্যেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের দৃঢ়তার কারণে নির্বাচনের আগেই সরকার দেশ থেকে জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থাৎ এবারও আমরাই জনগণকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছি।
আমরা বিশ্বাস করি, কোনো অনির্বাচিত ও জনগণের কাছে জবাবদিহি ছাড়া সরকারের চেয়ে একটি নির্বাচিত সরকার ভালো। কারণ, গণতান্ত্রিক পরিবেশে অন্তত জনগণ কথা বলতে পারে, প্রতিবাদ জানাতে পারে এবং প্রয়োজনে আন্দোলন করে সরকার বদলাতে পারে। এটাও ছিল আমাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার আরেকটি কারণ। আমাদের বিশ্বাস ছিল, নির্বাচন কমিশন যদি পপাতিত্ব ছেড়ে নিরপে অবস্থান নেয়, সরকার যদি সত্যিকারের দল-নিরপে ভূমিকা বজায় রাখে এবং জনগণ যদি নির্বিঘেœ তার ভোট দেওয়ার সুযোগ পান তাহলে অবশ্যই আমরা নির্বাচনে বিজয়ী হবো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি।
বরং এক সাজানো পাতানো নির্বাচনী প্রহসনে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়া হয়। ঘোষিত এই ফলাফল ছিল অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত। কারণ, এর আগে বিএনপির প্রতিটি সরকারের আমল দেশে-বিদেশে চিহ্নিত হয়েছিল সার্বিক উন্নতির আমল হিসাবে। এ প্রসঙ্গে আমি কয়েকটি বিষয় মাত্র উল্লেখ করতে চাই।
বেগম জিয়া আরও বলেন, ১৯৭৩ সালে গ্রাম এবং শহর অঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল যথাক্রমে মোট জনসংখ্যা ৮৩ এবং ৮১ শতাংশ।
শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তার জন্মলগ্ন থেকেই দেশ থেকে দারিদ্র্যের এই হার কমিয়ে আনার কার্যক্রম গ্রহণ করে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর স্বল্পকালীন শাসন আমলে গ্রাম এবং শহরে দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ৭৪ এবং ৬৬ শতাংশে কমিয়ে আনতে সম হন। সেই সময় আন্তর্জাতিক মহলে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নামে পরিচিত বাংলাদেশে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়ার কর্মকুশলতা এবং সততার সঙ্গে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার পরিশ্রম যুক্ত হওয়ার ফলে। প্রায় এক দশকের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে নব্বই-এর দশকের প্রারম্ভে একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে আমাদের আবার যাত্রা শুরু করতে হয়। আমরা উপলব্ধি করেছিলাম, দারিদ্রপীড়িত জনগণের উন্নতি সাধন করতে হলে একদিকে যেমন অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে, অন্যদিকে এমন একটি ইতিবাচক সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে দেশে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
জনগণের ভোটে এই দুই দফায় মোট দশ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ লাভ করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশকে ক্রমশ একটি মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত করার ল্েয ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল। ২০০১ সালে নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ার হামলার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি তিগ্র¯Í হওয়া সত্ত্বেও আমরা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে অব্যাহতভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছিলাম এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নতিকল্পে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম। সুদূরপ্রসারী এবং বা¯Íবমুখী অর্থনৈতিক দর্শনের জন্য আমাদের দুই দফায় দ্রুত হারে দারিদ্র কমানো সম্ভব হয়েছিল। ১৯৯১-৯২ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার ৫৯ শতাংশ থেকে ৪৯ শতাংশে নেমে আসে। এই হ্রাসের বার্ষিক হার ছিল প্রায় দুই শতাংশ।
২০০১ সালে বিএনপি পুনর্বার সরকার গঠনের পর দ্বিগুণেরও অধিক হারে দারিদ্র্য কমতে থাকে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ৪৯ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে নেমেছিল এবং এই সময়কালে দারিদ্র হ্রাসের যৌগিক হার ছিল বার্ষিক প্রায় ৪ শতাংশ। আমাদের দায়িত্ব পালনকালে শহর ও পল্লী উভয় এলাকাতেই দারিদ্র্যের গভীরতা ও তীব্রতা প্রায় সমভাবে কমানো সম্ভব হয়েছিল।
তিনি বলেন, অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেও ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সফল পর্যায় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনকালের শেষ বছর, অর্থাৎ ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩.৫১ শতাংশ।
অপরদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের সর্বশেষ অর্থবছর অর্থাৎ ২০০৫-০৬ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬৩ শতাংশ। দেড় দশকের মধ্যে জিডিপি-র প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি বিএনপি সরকারের দরিদ্র বান্ধব অর্থনৈতিক নীতিরই প্রতিফলন। শুধু তাই নয়, এই সময়ের মধ্যে আমরা শ্রমঘন ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প খাতে বিস্ময়কর ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হই। অথচ আওয়ামী লীগের বিগত মেয়াদের শাসনামলের ১৯৯৮-৯৯ অর্থ বছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩.১৯ শতাংশ। আমরা কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকেই মনোনিবেশ করি নাই, একই সঙ্গে মানব উন্নয়নের প্রতিও যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম।
বিশ্বের দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে ইউএনডিপি’র ২০০৬ সালের প্রকাশিত রিপোর্টে বিভিন্ন েেত্র বাংলাদেশের অর্জনের কথা বলা হয়েছে। েিধ, প্রাথমিক শিা, নারী-পুরুষ সমতা, শিশু মৃত্যুর হার এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা, মানব উন্নয়নের এই পাঁচটি সূচকের বিশ্লেষণমূলক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শিা েেত্র নারী-পুরুষ সমতা ল্যমাত্রা বাংলাদেশ ২০০৩ সালেই অর্জন করেছে। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসের তৎকালীন ধারা অব্যাহত থাকলে এই েেত্র জাতিসংঘের ল্যমাত্রা ২০১৫ সালের মধ্যে সহজেই অর্জন করা সম্ভব। সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মানব উন্নয়নে বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ল্য করে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা আমাদের মাতৃভূমিকে সেই সময় উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি বা ইমারজিং টাইগার রূপে অভিহিত করেছিল।
২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বের প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিন ‘রিবিল্ডিং বাংলাদেশ’ শিরোনামে দেশ পুনর্গঠনে আমাদের সাফল্যের কথা কভার স্টোরি আকারে তুলে ধরেছিল। এটাও বলা উচিত যে, সেই সময়ে তেলের দাম খুব বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমরা এসব সাফল্য অর্জন করেছিলাম। কিন্তু আপনারা জানেন যে পরবর্তীতে বাংলাদেশের অগ্রগতির সেই ধারাকে রুদ্ধ করা হয়েছে। এগারই জানুয়ারির তথাকথিত সংস্কারের নামে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান স্থবির এবং দারিদ্র্য হ্রাসের পরিবর্তে দেশে দারিদ্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
খালেদা বলেন, আমাদের সরকারের পাঁচ বছরে সরকারি সহায়তা এবং নিজ উদ্যোগে জনগণের যে অংশ দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে উঠতে সমর্থ হয়েছিল, সুপরিকল্পিতভাবে তাদেরকে আবারও দারিদ্র্য রেখার নিচে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
দেশের সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও আজ হুমকির মুখে পড়েছে। ভবিষ্যতে আবারও সরকার পরিচালনার সুযোগ লাভ করলে দেশের প্রবৃদ্ধি দুই অংকে অর্থাৎ দশ কিংবা তার বেশিতে উন্নীত করা এবং দারিদ্র্যকে শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনাই হবে আমাদের প্রধান ল্য। সেই ল্য অর্জনে আমাদের নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাই আমাদের ঘোষিত আদর্শ। জনগণ কিংবা রাষ্ট্রের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কখনো কোনো চুক্তি আমরা নিজেরা করিনি, করবোও না। অন্য কেউ জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি করার উদ্যোগ নিলে জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।
খালেদা জিয়া বলেন, প্রহসনের নির্বাচনে আমাদেরকে হারিয়ে দেয়া সত্বেও গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার স্বার্থে আমরা ঘোষিত ফলাফল মেনে নিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমরা যোগ দিয়েছি। প্রথম দিন থেকে সংসদ অধিবেশনেও বিএনপি অংশ নেয়। আমরা চেয়েছিলাম, দেশে গণতন্ত্রকে আবার গড়ে তোলার কাজে সর্বাত্মকভাবে সরকারকে সহযোগিতা করবো। কিন্তু কী দেখলাম আমরা? সংসদে সরকারি দল আমাদেরকে প্রথম দিন থেকেই সহ্য করতে পারেনি।
তারা কুৎসিত ও অসংসদীয় ভাষায় আমাদেরকে আক্রমণ করেছে। সামনের সারিতে বিরোধী দলের আসনগুলো তারা দখল করে নিয়েছে। আমাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান তারা রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে ব্ল্যাকআউট করেছে। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য প্রচার করতে দেয়নি। আমার বাসায় সংসদের কার্যসূচি পর্যন্ত দিতে দেওয়া হয়না।
দেশ ও জনগণের স্বার্থে আমাদের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য সংসদে অসংখ্য নোটিশ দিলেও তা গ্রাহ্য করা হয়না। মর্যাদা বজায় রেখে সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনকে তারা অসম্ভব করে তুলেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, যে সংসদে দেশ এবং জনগণের স্বার্থে কথা বলার সুযোগ নেই সেই সংসদ কতটা কার্যকর সে প্রশ্ন আজ সকলেই তুলছে। সরকারি দলই সংসদকে অকার্যকর করে ফেলেছে। ফলে তাদের দলের সদস্যরাও সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
আমরা আরো দেখলাম, বর্তমান সরকার মতায় আসার পর দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রার অতন্দ্র প্রহরী সেনাবাহিনীর অর্ধশতাধিক চৌকষ কর্মকর্তা, বেশ ক’জন বিডিআর সদস্য ও সাধারণ মানুষের নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে দেশের প্রতিরা ও সীমান্ত সুরা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়লো। বিভিন্ন অজুহাতে চাকরিচ্যুত করা হলো আরও বেশ কিছু সামরিক কর্মকর্তাকে। ফলে প্রতিরা ব্যবস্থা হলো আরো দুর্বল। এসব ঘটনায় বাইরের কারো লাভ হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের যে তি হয়েছেÑ তা অপূরণীয়।
দেশবাসী মনে করে দেশের এই বিরাট তির দায় বর্তমান সরকার এড়াতে পারে না। দেশবাসীর সাথে আমরাও এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের উপযুক্ত বিচার এবং প্রকৃত দোষীদের শা¯িÍ দাবি করছি। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার ল্েয তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারের নামে প্রহসনের অপচেষ্টা চলছে। জনগণ প্রকৃত ঘটনা এবং এই নির্মম হত্যাকান্ডের চক্রান্তকারীদের পরিচয় জানতে চায়।
পিলখানা হত্যাকান্ড সম্পর্কে খালেদা জিয়া বলেন, গত ২৫-২৬ ফেব্র“য়ারি পিলখানার মর্মবিদারক হত্যাযজ্ঞের জন্য আমরা ব্যথিত।
ঐ ঘটনায় সকল শহীদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। এ যাবতকাল প্রকাশিত বা আংশিক প্রকাশিত ২টি তদন্ত প্রতিবেদনেই নেপথ্যের কুশিলবদের চিহ্নিত করার জন্য ঘটনার অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে । কিন্তু তা করা হয়েছে বলে আমরা শুনিনি। আমরা রাজনীতির উর্দ্ধে থেকে পিলখানার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি করছি।
সহস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেক কষ্টে আমরা জাতীয় সশস্ত্রবাহিনীকে গড়ে তুলেছি।
স্বাধীনতার পর এই বাহিনী ছিল অবহেলা ও বৈষমের শিকার। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গঠিত আমাদের সশস্ত্রবাহিনী দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রায় অতন্দ্র প্রহরী। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে এক গৌরবজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে। আমরা আমাদের দায়িত্বকালীন সময়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি শক্তিশালী ও পেশাদার সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলার।
১৯৭৫ সালের নভেম্বর পূর্ববর্তী এবং আমাদের দায়িত্বকালীন সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন পরিসংখ্যানই বলে দেয় কোন অবস্থা থেকে কোথায় সশস্ত্রবাহিনীকে নেয়া হয়েছে। ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদকালে জাতিসংঘ মিশনে অধিকসংখ্যক সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদেরকে পাঠানোর কাজ আমরাই শুরু করি । সেই সূত্র ধরে বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘ শান্তিমিশনে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সৈন্য প্রেরণকারী দেশ।
এক-এগারো পরবর্তী সময়কালে কিছু কিছু সামরিক কর্মকর্তার কিছু কার্যক্রম বিতর্কিত হলেও তা সার্বিকভাবে সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করে তাদের উপর বিরূপ মনোভাব পোষণ করার সুযোগ নেই। আমরা অনেকের মতো অতীতমুখী এবং প্রতিহিংসায় বিশ্বাসী নই।
খালেদা বলেন, সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ড, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, সমুদ্রে তেল-গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়া, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ, এশিয়ান হাইওয়ের ছদ্ম আবরণে ভারতকে করিডোর দেয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের একলা চলার নীতি, জনগণকে এসব বিষয়ে দেশের স্বার্থ রায় সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দিহান করে তুলেছে। প্রতিনিয়ত সীমান্তে বাংলাদেশী মানুষ খুনের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা তো দূরের কথাÑ সরকার এ ব্যাপারে শক্ত প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাতে পারেনি। অন্যদিকে এশিয়ান হাইওয়ের নামে ভারতকে করিডোর দেয়ার পে সরকারের মন্ত্রিদের বক্তব্য এবং টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশ বরং উপকৃত হবেÑ সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের এমন বক্তব্য দেশবাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছে। দেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো এবং শিল্প উন্নয়নের জন্য আমাদের তেল, গ্যাস ও কয়লাসহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান ও আহরণের বিকল্প নেই। প্রয়োজনে বিদেশীদের সহায়তাও নিতে হবে।
কিন্তু তা করতে হবে স্বচ্ছতা ও জাতীয় স্বার্থ বজায় রেখে। এসব সম্পদের মালিক দেশের জনগণ। কাজেই এসব বিষয়ে দেশের জনগণের সবকিছু জানার অধিকার আছে বলে বিএনপি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
তিনি বলেন, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে দেশের উত্তর, মধ্য ও দণিাঞ্চল দারুণভাবে তিগ্র¯Í হয়েছে। টিপাইমুখে বাঁধ হলে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলও বিপুল তির শিার হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বাড়ছে এবং তার ফলে দেশের গোটা দণিাঞ্চল বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে। এসব মাথায় রেখেই দেশ ও জনগণের স্বার্থে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবো। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে বিএনপি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক রার নীতিতে বিশ্বাস করে। আমরা মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার ল্েয বিশ্বের সব মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের নীতিতে অটল থাকবো। পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখবো বিশ্বের সব দেশের সাথে।
কমনওয়েলথ, জোট নিরপে আন্দোলন এবং ওআইসি-র সাথে আমাদের দৃঢ় সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার ল্েয সার্ককে আরও কার্যকর করার চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাবো। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রায় জাতিসংঘ ও তার সহযোগী সংস্থাসমূহের ভূমিকা পালনে আমরা আগের মতোই সমর্থন জানাবো।
জিলবায়ুর বিরূপর প্রভাব সম্পর্কে খালেদা বলেন, বিশ্ব জলবায়ূ পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের অনিবার্য হুমকি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক প্রয়াসে আমরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেব। কোপেন হেগেনে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন চলছে।
আমরা আশা করি, সম্ভাব্য এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত ও বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহ এই সমস্যা মোকাবেলার মূল দায়িত্ব গ্রহণ করবে। স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে অনিবার্য দুর্যোগ ও সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও কারিগরী সহযোগিতা দেয়ার নৈতিক দায়িত্বও তাদের নেয়া উচিত।
তিনি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের বিশেষ সুবিধাসহ অবাধে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করণ জরুরি বলে আমরা মনে করি। আমরা এটাও চাইÑ অর্থ, প্রযুক্তি এবং পণ্যের মতোই শ্রম বাজারও উন্মুক্ত করা হোক। ফিলি¯িÍনে জনগণসহ সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের ন্যায় সঙ্গত আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে।
গণতন্ত্রে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী বিএনপি সব ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। আর তাই, দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সন্ত্রাস নির্মূলের ল্েয বিএনপি আগের মতোই দেশে সক্রিয় ও আন্তর্জাতিক েেত্র সহযোগীর ভূমিকা পালন করবে।
খালেদা বলেন, ইতিহাস সাী, আমরাই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছি; সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেছি। আমরাই সংবাদপ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।