সংকলিত
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদের (সংবিধান সভা) ২য় অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহিত হয়।
প্রথম অধিবেশনে পার্বত্য চট্রগ্রামের প্রতিনিধি শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা তার দীর্ঘ বক্তৃতায় পার্বত্য উপজাতিদের স্বিকৃতীর দাবী উত্থাপন করেন।
খসড়া সংবিধান প্রনোয়ন কমিটির উত্থাপিত খসড়াটি নিয়ে মৃদু বিতর্ক সৃস্টি হলেও তার তেমন কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই হুবুহু গৃহিত হয়।
২য় অধিবেশনে যেখানে সংবিধান গৃহিত হয় তার প্রসিডিংস নীচে তুলে দিলাম:
জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া আপনার প্রস্তাব পেশ করুন।
জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া (ইন, ই. ১১৫: ঢাকা-১২): মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমি প্রস্তাব করছি যে,
" সংবিধান-বিলের ৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক;
"৬।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিক গণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন। "
জনাব স্পীকার: পরিষদের সন্মুখে জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া প্রস্তাব এনেছেন যে,
" সংবিধান-বিলের ৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক;
"৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিক গণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন। "
ড: কামাল হোসেন (আইন ও সংসদীয় বিষযাবলী এবং সংবিধান-প্রণয়ন মন্ত্রী): মাননীয় স্পীকার সাহেব, এই সংশোধনী গ্রহনযোগ্য বলে আমি মনে করি এবং এটা গ্রহণ করা যেতে পারে।
জনাব স্পীকার: শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পি. ই. -২৯৯: পার্বত্য চট্রগ্রাম-১): মাননীয় স্পীকার সাহেব, জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া সংশোধনী - প্রস্তাব এনেছেন যে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ 'বাঙালি' বলে পরিচিত হবেন।
মাননীয় স্পীকার সাহেব, এব্যাপারে আমার বক্তব্য হল, সংবিধান বিলে আছে, "বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে"; এর সংগে সুস্পষ্ট করে বাংলাদেশের নাগরিকগণকে 'বাঙালি' বলে পরিচিত করবার জন্য জনাব অ: রাজ্জাক ভূইয়ার প্রস্তাবে আমার একটু আপত্তি আছে যে, বাংলাদেশের নাগরিকত্বের যে সংগা, তাতে করে ভালভাবে বিবেচনা করে তা যথোপযুক্তভাবে গ্রহন করা উচিৎ বলে মনে করি।
আমি যে অন্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্রগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা বাঙালিদের সংগে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সংগে আমরা ওৎপ্রোতবাবে জড়িত।
সবদিক দিয়েই আমরা একসংগে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি।
আমার সদস্য-সদস্যা ভাই বোনদের কাছে আমার আবেদন, আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়...
জনাব স্পীকার: আপনি কি বাঙালি হতে চান না?
শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোন দিনই নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই।
আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশী বলে মনে করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।
জনাব স্পীকার: আপনি বসুন।
Please resume your seat.
শ্রী সুরন্জিৎ সেন গুপ্ত: মাননীয় স্পীকার সাহেব, এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হল, জনাব অ: রাজ্জাক ভুইয়া সাহেব যে সংশোধনী এনেছেন, ততে মনে এ প্রশ্ন জাগে যে বাংলাদেশী বাঙালি ছাড়া ভারতের কেউ বাস করেছে। আমি শুধু বলতে চাই যে, বাঙালি বলতে এইটুকু বোঝায় যে, যারা বাংলা ভাষা বলে তাদেরকে আমরা বাঙালি বলি।
জনাব স্পীকার: Please resume your seat. আপনি বসুন, আপনি বসুন। এখন পরিষদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে...........
(এবং বিপুল হ্যা ভোটের মাধ্যমে 'বাঙালি' প্রশ্নের সংশোধনিটি পাশ করা হোল)
শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পি. ই. -২৯৯: পার্বত্য চট্রগ্রাম-১): মাননীয় স্পীকার আমাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে খর্ব করে এই ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধিত আকারে গৃহীত হল। আমি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং প্রতিবাদস্বরূপ আমি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিষদের বৈঠক বর্জন করছি।
[অত:পর মাননীয় সদস্য পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে চলে যান। ]
সূত্র: পরিষদ বিতর্ক রিপোর্ট, ৩১ অক্টোবর ১৯৭২।
খন্ড ২, সংখ্যা ১৩, পৃ: ৪৫২-৪৫২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।