বাবরী মসজিদ ধ্বংসে রাষ্ট্রীয় মদদ ছিল
আদভানীদের সাথে কংগ্রেসের নরসীমাদের বিচার হতে হবে
ফতেহ আলী টিপু : ভারতের অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংসের দীর্ঘ ১৭ বছর পর লিবারহান তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি মিডিয়া ফাঁস করে দেয়ায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের রাজনীতিকরা বিপাকে পড়েছেন। এ তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী, এল কে আদভানী ও মুরলী মনোহর যোশীসহ সংঘ পরিবারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উস্কানীতে বাবরী মসজিদ মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় এবং ওই জায়গায় রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা শিলান্যাস করা হয়। লিবারহান রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঐতিহাসিক এই মসজিদটি ধ্বংসকান্ড ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। সংঘ পরিবারের অন্যতম উগ্রবাদী সংগঠন করসেবক সদস্যরা বাবরী মসজিদ ধ্বংসের আনুষ্ঠানিক রথযাত্রার অগ্রগামী থাকলেও এর নেতৃত্বে ছিলেন এলকে আদভানী, মুরলী মনোহর যোশি এবং গুজরাটের কসাই নরেন্দ্রী মোদীরা। তবে বিজেপি'র মধ্যে সবচেয়ে উদার বলে পরিচিত অটল বিহারী বাজপেয়ী উগ্রবাদী হিন্দুদের মসজিদ ধ্বংসের তান্ডব থেকে নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় এ অপরাধের দায় তাঁর ওপরও বর্তায়।
কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কংগ্রেস নেতা নরসীমা রাও প্রশাসন ও আইন-শৃক্মখলাবাহিনী ব্যবহার করে সংঘ পরিবারের মসজিদ ধ্বংসের রথযাত্রা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্য অপরাধের দায় তার ওপরও বর্তায়। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার সময় কার্যত কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার কোন আইনানুগ ব্যবস্থাই নেয়নি। অর্থাৎ উগ্রহিন্দুবাদী শক্তি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংসের আনুষ্ঠানিক জঙ্গিবাদী প্রস্তুতি গ্রহণ করে বিশাল ‘রথযাত্রা' নিয়ে হাজার হাজার সশস্ত্র কাপালিক-তান্ত্রিক-সাধু-সন্তদের নিয়ে কয়েকশ' বছর পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অযোধ্যার বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার যে অভিযান চালিয়েছে, নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার তা প্রতিরোধ না করে পরোক্ষভাবে হিন্দুত্ববাদী সেন্টিমেন্টের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন। যদিও কংগ্রেসের নীতি-আদর্শ হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা হয়ে থাকে এবং ভারতের মুসলমানদেরকে কংগ্রেস দীর্ঘকাল ধরে ‘ভোট ব্যাংক' হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে।
বাবরী মসজিদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আদালতে মামলা চলছিল এবং আদালত মসজিদের স্থিতাবস্থা বহাল রাখার নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও উগ্রহিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার তাদের ফ্যাসীবাদী জিঘাংসা বাস্তবায়ন করেছে বাবরী মসজিদের ওপর। নরসীমা রাও সরকার শান্তি রক্ষায় কয়েকশ' সেনা সদস্য নিয়োগ করলেও তারা অদূরেই দাঁড়িয়ে বাবরী মসজিদের ধ্বংস্তূপ অবলোকন করেছেন। কেননা, মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির নির্মাণ বন্ধ করার ক্ষেত্রে ভারতের সেনাবাহিনী বা পুলিশের গুলীবর্ষণের কোন হুকুম ছিল না। কংগ্রেস নেতা প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও হিন্দুত্বের স্পর্শকাতর সেন্টিমেন্টে আঘাত করে হিন্দুবলয়ের সমর্থক হারাতে চাননি। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পর অবশ্য নরসীমা রাও ভারতীয় মুসলমানদের যন্ত্রণায় নুনের ছিটা দিয়ে বলেছিলেন যে, একই স্থানে বাবরী মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করে দেয়া হবে।
কিন্তু তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার বা বর্তমান সময়ের কংগ্রেসে নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার দু'পর্বে সরকার গঠন করেও অবৈধ নির্মিত রামমন্দির ভেঙ্গে সেখানে বাবরী মসজিদের স্থাপত্য নির্মাণ করতে পারেনি। কার্যত কংগ্রেস বাবরী মসজিদ পুনর্নির্মাণের এজেন্ডা থেকে সরে এসেছে। বরং তারা বাবরী মসজিদ ধ্বংসের ওপর গঠিত লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট ব্যবহার করে বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা দিতে চাইছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কংগ্রেস বাবরী মসজিদ ইস্যুতে তার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট না করে একই অপরাধে বিজেপি নেতা ও সংঘ পরিবারের সদস্যদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে না।
ভারতের কংগ্রেস সরকারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, পন্ডিত নেহেরু থেকে শুরু করে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধী সরকার পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুর মীমাংসায় সরাসরি সামরিক শক্তি ব্যবহার করেছেন।
জম্মু ও কাশ্মীরকে সেখানকার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দখল করে রাখতে ভারত সরকার পন্ডিত নেহেরুর আমল থেকেই লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে, পাঞ্জাবের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীকে দমনে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে শিখদের ‘স্বর্ণমন্দির' সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালানো হয়। এছাড়া ভারত দেশীয় রাজ্য দখলেও নির্বিচার সেনা শক্তি ব্যবহার করেছে। আসামসহ উত্তর পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যের স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে ভারত এনকাউন্টার হত্যাযজ্ঞ চালাতে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে আসছে। ভারতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় চলমান মাওবাদী গেরিলাদের সশস্ত্র তৎপরতা নির্মূলে ও ভারত সরকার সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে ‘যৌথ' অভিযান চালাচ্ছে।
এই পটভূমিকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সমীক্ষকরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে আসছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী কংগ্রেস সরকার উগ্রজাঙ্গিবাদী হিন্দুত্বের দমনে কখনো সামরিক বা পুলিশী শক্তি ব্যবহার করেনি।
যদিও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ এ অঞ্চলের ‘ইসলামী জঙ্গিবাদ' নির্মূলে ভারত সরকার প্রতিবেশী দেশের সরকারগুলোকে সেনা অভিযান চালাতে উস্কানী দিচ্ছে। এমনকি এসব প্রতিবেশী দেশের কথিত জঙ্গি ঘাঁটি নির্মূলে ভারত নিজেও সরাসরি অথবা যৌথভাবে সামরিক অভিযান চালানোর কথা বলে থাকে।
বাবরী মসজিদ ধ্বংসের কর্মসূচি নেয়া এবং উগ্রবাদী সংঘ পরিবারের নেতৃত্বে তা বাস্তবায়ন চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত ভারতের বিশাল সেনাবাহিনী নরসীমা সরকারের নির্দেশ না পেয়ে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর স্থানুর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। একটি নির্বাচিত সরকারের অকার্যকরতার সুযোগে রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পদদলিত করে কোন উগ্রবাদী শক্তিই তাদের বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার মিশন সফল করতে পারতো না, যদি কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী হিন্দুত্ব তোষণের নীতি গ্রহণ করে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় মদদ না দিতেন।
সংঘ পরিবার বা বিজেপি হিন্দুত্বকে তাদের রাজনৈতিক শ্লোগান হিসেবে সরাসরি ব্যবহার করে আসছে।
এ ব্যাপারে তাদের কোন লুকোচুরি নেই। সংঘ পরিবারের মুসলিম বিদ্বেষী উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের উদ্দেশ করে প্রকাশ্যে শ্লোগান দিচ্ছে- মুসলমানরা কুরআন না ছাড়লে তাদের ভারত ছাড়তে হবে। সম্প্রতি দেওবন্দের আলেম ও ফকীহ্রা এক সম্মেলনে ভারতের জাতীয় সংগীতকে ইসলামের তৌহিদবাদী চেতনা ও বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক বলে ওই সংগীত গাইবেন না বলে এক প্রস্তাব নিয়েছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেও সংঘ পরিবারের উগ্র হিন্দুরা ভারতীয় মুসলমানদের দেশপ্রেম নিয়ে আপত্তিকর ভাষায় কটাক্ষ করেছেন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাজনৈতিক আদর্শ ও কালচারের দিক দিয়ে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করে থাকে।
ভারতীয় মুসলমানদের সুরক্ষায় কংগ্রেসের শোচনীয় ব্যর্থতা সত্ত্বেও প্রধানত সেখানকার মুসলিম ভোটেই কংগ্রেস বার বার জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে থাকে। কিন্তু হিন্দুত্বের প্রতি কংগ্রেসের কপটাচারী সমর্থনের কারণে ভারতে মুসলমানরা বার বার উগ্রহিন্দুত্বের সহিংসতার বলি হয়েছে এবং হচ্ছে। কংগ্রেস সরকার বাবরী মসজিদ ধ্বংসের উগ্রতা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই বাজপেয়ী-আদভানী যোশীর শিষ্য নরেন্দ্রমোদীর নেতৃত্বে হাজার হাজার মুসলমানদের এথ্নিক ক্লিনজিং-এর শিকার হতে হয়েছে। কংগ্রেস সরকার আজ পর্যন্ত কসাই নরেন্দ্র মোদীর বিচার করতে পারেনি এবং ভয়-ভীতিহীন পরিবেশে গুজরাটের সুখী ও সম্পন্ন মুসলমানদের নিজ নিজ ঘর-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পুনর্বাসিত করতে পারেনি। উগ্র হিন্দুত্বের সাথে কংগ্রেসের গোপন আতাঁত রয়েছে বলেই গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদীরা বার বার ক্ষমতায় আসছে।
উগ্র হিন্দুবাদের প্রথম উত্থান ঘটেছে অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে। আর দ্বিতীয় উত্থান ঘটেছে দিল্লীতে সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক মুখপাত্র অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠান।
সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকায় লিবারহান কমিশনের রিপোর্ট ফাঁস হবার পর ভারতীয় পার্লামেন্ট ও রাজনৈতিক অংগনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে লিবারহান রিপোর্টে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার নেতৃত্বদানকারী যেসব উগ্রবাদী হিন্দু নেতাদের দায়ী করেছেন, তারা ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমেই তাদের অপরাধ ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন। গোটা ভারত ও বিশ্ববাসী দেখেছেন, সংঘ পরিবার ও বিজেপির কোন কোন শীর্ষ নেতা বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়িত করেছেন।
সম্প্রতি লিবারহান কমিশনের উদ্ধৃতি দিয়ে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রধান নাটের গুরু বাজপেয়ী, আদভানি ও যোশীর মুখোশ নতুন করে মিডিয়ায় উন্মোচিত হলে ভারতীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দল বিজেপি ও এর অঙ্গ সংগঠনসমূহের মাঝে হই চই পড়ে যায়। বিজেপি নেতারা ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে দায়ী করেছে এ কমিশনের এ রিপোর্ট ফাঁসের জন্য। তবে কংগ্রেস এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিজেপি নেতারা মনে করেন, রাজনৈতিক ফায়দা উসুলের জন্য কংগ্রেস মিডিয়ার কাছে এটা ফাঁস করে দিয়েছে। তবে যে বা যারাই এটা ফাঁস করে দিক না কেন, এতে ইতিহাসের ধামাচাপা দেয়া সত্য আর একবার উন্মোচিত হয়েছে।
তবে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা ও তার প্রতিরোধে ব্যর্থতা নিয়ে ক্ষমতাসীন ভারতীয় কংগ্রেস ও বিরোধী দল বিজেপি'র মধ্যে যে ব্লেইম গেম চলছে, তাতে ভারতীয় মুসলমানদের ক্ষতি ও বেদনার উপশমের কোন আশ্বাস নেই। ভবিষ্যতে ভারতীয় মুসলমানরা আবারও উগ্র হিন্দুবাদের নৃশংসতার শিকার হবে না, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। বরং কংগ্রেস ও বিজেপি'র রাজনৈতিক ডুব সাঁতারে আবারও মুসলমানদেরই নীরব দর্শক সাজতে হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।