আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘ভাটির পুরুষ’ শাকুর মজিদ নির্মিত তথ্যচিত্র

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
শাহ আবদুল করিম। গত ১২ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেছেন। তাঁর সেই চলে যাওয়াটি অবশ্যি দৈহিক, যেহেতু বলা হয় আমাদের শরীরটি তৈরি মাটির-আর আত্মা নাকি অমর।

আত্মা অমর না হলেও শাহ আবদুল করিম যে বাংলায় চিরকাল বেঁচে থাকবেন সে ব্যাপারে কারও কোনও সংশয় নেই । তার কারণ করিমের আন্তরিকতা। তার শিল্পে-যাকে আমরা বলি গান, সেই গানে কোনও রকম ফর্মালিটি নেই, কৃত্রিমতা নেই ...এইটেই করিমের অমরতা লাভের রহস্য বলে বোধ হয় ... শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে শাকুর মজিদ নির্মাণ করেছেন ‘ভাটির পুরুষ’ নামে একটি তথ্যচিত্র। তথ্যচিত্রটি দেখে অনেক অজানা তথ্য জানা গেল। জানা গেল শাহ আবদুল করিমের মুখেই- গানের ফাঁকে ফাঁকে তিনি নিজের কথা বলেছেন।

আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় তথ্যচিত্রটি নির্মানকালে অনেক সুস্থ্য ছিলেন করিম-কাজেই যা বলার স্পস্ট করেই বলেছেন। তথ্যচিত্রে সঞ্জীব চৌধুরিকে দেখে, তাঁর গান শুনে অনেকেই হয়তো বিষন্ন হয়ে পরবেন। শাকুর মজিদ অভিনব টেকনিক অ্যাপ্লাই করেছেন। বট গাছের নিচে বসে সঞ্জীব চৌধুরি গাইছেন ‘গাড়ি চলে না চলেনা। শাহ আবদুল করিমও গাইছেন ‘গাড়ি চলে না চলেনা।

’ যে কারণে একই গানের দুটি ভিন্ন প্রজন্মের সুরের পার্থক্যটি বোঝা যায়। তথ্যচিত্রটির একটি অন্যতম সংযোজন বলে আমার কাছে মনে হয়ে কলকাতার দোহার শিল্পীগোষ্ঠীর কালিকা প্রসাদের বক্তব্য। কলকাতায় করিমের সম্মান কেমন-সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কালিকা প্রসাদের বক্তব্যে এবং দোহার শিল্পীগোষ্ঠীর পারফরমেন্স দেখে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে। ‘ভাটির পুরুষ’- দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে তথ্যচিত্রটি দর্শককে সন্তুষ্ট করবে।

অনেক টুকরো টুকরো গান ছাড়াও করিমের জীবনের নানাদিক ফুটে উঠেছে। শাহ আবদুল করিমকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পিছনে যে নারী- আফতাবুন্নেছা (সরলা) তাঁর কথাও অনিবার্যভাবেই উল্লেখযোগ্য পরিমানেই রয়েছে। করিমের শিষ্য আর শিষ্যাদের অনুভূতির কথাও আছে: রনেশ ঠাকুর, জামালউদ্দীন হাসান বান্না, রুহি ঠাকুর, সেরাজুন নেছা-এরা প্রত্যেকেই গান শুনিয়েছেন, কথা বলেছেন। অদ্ভূত এক দৃশ্য আছে-কালিনী নদীর ধারে ...সন্ধ্যার পর ... সবাই করিমের পাশে বসে গান গাইছে। অল্প অল্প আলো, অনেকটাই অন্ধকার ...নারীপুরুষ আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।

সেরাজুন নেছার মুখটা অল্প অল্প বোঝা যায় ... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সংগীততত্ত্ব বিভাগের যশস্বী অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী বাউলদর্শন ব্যাখ্যা করেছেন, করিম ও সুনামগঞ্জের গানের ধারা নিয়ে নিজস্ব মতামত রেখেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীই প্রথম ১৯৯০/৯১ সালের দিকে শাহ আবদুল করিমকে ঢাকায় নিয়ে এসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বুদ্ধিজীবিমহলের সঙ্গে করিমের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে করিমের গান শুনে কবীর চৌধুরী থেকে তসলিমা নাসরীন বাকরুদ্ধ। তাদের একটাই কথা: ‘আমাদের আপনি ক্ষমা করুন। আমরা আপনাকে চিনতে পারিনি।

’ ওই একই সময়ে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শাহ আবদুল করিমকে ঢাকায় এনে করিমের একটি ইন্টারভিয়্যূ ও গান রেকর্ডিং করেছিলেন এবং কেন একুশে পদকটি ভাটি অঞ্চলের এই সুরসাধককে দেওয়া হচ্ছে না তা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন, পরে করিমকে একুশে পদকে ভূষিত করা হলে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। করিম প্রধানত বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কবি। তবে একুশ শতকের প্রারম্ভে করিম ও শহুরে জনগোষ্ঠীর সম্পর্কটি নতুন এক স্তরে উপনীত হয়। তরুণ প্রজন্মের প্রবাসী সংগীতশিল্পীরা যেসব গান শুনছিল তাতে তারা ঠিক পুরোপুরি তৃপ্তি পাচ্ছিল না মনে হয়। তারা বুঝতে পেরেছিল- একমাত্র মিডিয়া দখলে থাকায় অনেক সাবষ্ট্যার্ন্ডাড শিল্পীই বিশ্বজুড়ে তুমুল প্রচার পাচ্ছিল।

তরুণ প্রজন্মকে বাংলার নিজস্ব সুরসম্পদের আশ্রয় নিতেই হল। হাবীব-লন্ডনপ্রবাসী একজন প্রতিভাব সংগীতশিল্পী শাহ আবদুল করিমের গান সংগ্রহ করে রিমিক্স করে। পরে অ্যালবামটি বাংলাদেশে রিলিজ করা হলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে দেওয়ানা বানাইছে ... গানের ভিতরে আন্তরিকতা ও সহজাত সুরের সমন্বয়ে শহরবাসী নবীন ও প্রবীন উভয় প্রজন্মই চমকে ওঠে। শহরের মোড়ে মোড়ে ক্যাসেট-সিডির দোকানে শোনা যায় ...কী যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইল ... প্রবীন শহরবাসী ও নবীন প্রজন্ম চমকে ওঠে এই কারণে যে এই জায়গার (কী যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইল ) সুরটি ঠিক গ্রামীণ নয়, যারা দীর্ঘদিন সংগীতসাধনা করছেন তারা জানেন, কী যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইল-র সুরটি অতি উচ্চাঙ্গের- রাগ মন্দ বলে একটি রাগ আছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ...তারই ছায়া পাওয়া যায়।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে কে এই আবদুল করিম। জানা গেল ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে এক কৃষকপরিবারে শাহ আবদুল করিমের জন্ম। শিক্ষাবঞ্চিত শৈশব কেটেছে রাখালজীবনে যে কারণে বালকটি লাভ করেছিল নির্মল মেষপালকের হৃদয় । আর বালকের কলবের ভিতরে ছিল মখলুকাতের আতশী আয়না। আর সে জন্যই বোধহয় পরবর্তীকালে রাখালের জীবনসঙ্গীনি আবতাবুনেচ্ছা হয়ে উঠেছিলেন ঠিক স্ত্রী নয়-মুর্শিদ (আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক)।

জায়গাজমি নিয়ে লোকে খুনখারাপি করে-আর করিম পৈত্রিক সম্পদ বেচে নিজের লেখা বই ছাপিয়েছেন, আফতাবসংগীত, কালিনীর ঢেউ ...ইত্যাদি । সে বইয়ে চরণের গভীরে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে - কে হবে মেম্বার কে-বা গ্রাম সরকার আমরা কি তার খবর লইতাম ভাইরে ... এরপর থেকে করিম চর্চা অব্যাহত রয়েছে। থাকবে। এরই ধারাবাহিকতায় শাকুর মজিদ এর ‘ভাটির পুরুষ। ’ শ্রম স্বীকারের জন্য শাকুর মজিদ কে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা।

অনেক যত্নে তথ্যচিত্রটি নির্মান করেছেন তিনি, বাংলার ভাটি অঞ্চলের এক সংগীতসাধককে দিয়েছেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান। তথ্যচিত্রটার শুরুটাও অতি আবেগঘন- বাংলাদেশের একটি চমৎকার মানচিত্র, (লেখায় বা তথ্যচিত্রে এই রকম মানচিত্রময় ইনট্রো আমারও খুব পছন্দ) তারপর বাঁশীর সুর, প্লেনের জানালায় বাংলার চিরায়ত দৃশ্য, দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে ...ইউক্যালিপটাস গাছ, টিলা, টিলার ওপর চা বাগান, শহর সিলেট, হযরত শাহ জালাল-এর দরগার তোরণদ্বার ...এসব কারণেই অ-সিলেটিদের কাছেও সিলেট এত গভীর আবেগের নাম ... ভিসিডিটি বাজারজাত করেছে লেজার ভিশন। বাউল গানের গভীর আকর্ষনের কারণে বিশ্বব্যাপী ক্রমশ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকবেন শাহ আবদুল করিম, বাংলার ভাটি অঞ্চলের মেষপালকের হৃদয়ের সঙ্গে সমকালীন বিশ্বের সাধুসমাজের জানাশোনা হবে, চিন-পরিচয় হবে -এসব কারণে না হলেও ভিসিডিটি নিজস্ব সংগ্রহে রাখা বাঙালির একান্ত দায় বলেই মনে করি।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।