আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাকুর মজিদের ভাটির পুরুষ-কথন

'রতনে রতন চেনে'- এই কথাটি শাকুর মজিদের বেলায় হবে, বাউলে বাউল চেনে। কে বাউল কে তারে চেনে? বাংলার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে কত কিসিমের বাউল, কে কারে চেনে? শাকুর মজিদ একজন বাউল- এই কথাটি রাজধানী ঢাকায় বসে বললে অনেকে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু করবেন। অনেকে এটার পক্ষে-বিপক্ষে নানান যুক্তি খাঁড়া কবাবেন। অনেকে নানাভাবে নাক শিটকাবেন। কিন্তু বাউল মন মনরে আমার, আমি জানি শাকুর মজিদও একজন বাউল।

শহরের আধুনিক বাউল, নগর-বাউল। বাউল মন নিয়ে তিনি গোটা বিশ্বের নানান প্রান্তে নানান কিসিমের বিষয়ের প্রতি মনযোগী হয়ে একজন আধুনিক বাউলের মত ঘুরে বেড়ান। শুধু কী ঘুরে বেড়ান? নানাভাবে খুঁড়ে আনেন অনেক বাউলের হাঁড়ির খবর।
শাকুর মজিদ গল্প, নাটক, ভ্রমণ-কাহিনী লেখেন। টেলিভিশনে নাটক বানান।

প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। টেলিফিল্ম নির্মাণ করেন। নাটকের সকল শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। মঞ্চ-নাটক লেখেন। ঘুরে ঘুরে ইচ্ছেমত ছবি তোলেন।

স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ লেখেন। স্থাপত্য ও আলোকচিত্র বিষয়েও লেখেন। পেশায় একজন স্থপতি হলেও বাউলের মন নিয়ে শুধু পেশার সীমানার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেন নি শাকুর মজিদ। তাই বাউল শাকুর মজিদের শিল্প-সাহিত্য-নাট্যকলায় নানাভাবে নানান ঢঙ্গে বিচরণ।
এর আগে তিনি বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবন ও দর্শন নিয়ে লিখেছেন মঞ্চনাটক 'মহাজনের নাও'।

বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবন নিয়ে নির্মাণ করেছেন তথ্যচিত্র 'ভাটির পুরুষ'। বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে শাকুর মজিদ দীর্ঘ ছয় বছরে যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে এবার লিখেছেন স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'ভাটির পুরুষ-কথা'।
বাউল শাহ আবদুল করিমের উপর প্রামাণ্যচিত্র বানানোর জন্য বিশিষ্ট নাট্যনির্মাতা, প্রমাণ্যচিত্র নির্মাতা, ভ্রমণ কথা সাহিত্যিক, স্থপতি, গবেষক, শিক্ষক ও আধুনিক নগর-বাউল শাকুর মজিদ ২০০৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ বছরে প্রায় ১০ বার বাউল শাহ আবদুল করিমের মুখোমুখী হন। আর এসব করতে গিয়ে হাওরের ঢেউ খেলানো জল, কালনী নদী, নৌকাবাইচ, ধলমেলা, উজানধলের ওরস, সিলেটের প্রত্যন্ত উপশহর দিরাই, বাউল শাহ আবদুল করিমের শিষ্যদের সঙ্গে তিনি নানাভাবে মিশেছেন। বাউল শাহ আবদুল করিমের উপর যাদের আগ্রহ রয়েছে, যারা তাঁর গান নিয়ে কাজ করেছেন, গবেষণা করেছেন, নানাভাবে নানান পর্যায়ে যারা শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের সঙ্গে নানান পর্যায়ে নানাভাবে শাকুর মজিদ কথা বলেছেন।

এসব করতে গিয়ে নগর-বাউল শাকুর মজিদ যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেই সব স্মৃতিচারণই অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায়, মনের মমতা মিশিয়ে তুলে ধরেছেন তাঁর নতুন স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'ভাটির পুরুষ-কথা'য়।
লোকায়ত সংস্কৃতি ও আধুনিক সংস্কৃতির যুগ সন্ধিক্ষণের গীতিকবি বাউল শাহ আবদুল করিম। ১৩২২ সালের ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার (১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে) দিরাই থানার উজানধল গ্রামে বাউল শাহ আবদুল করিমের জন্ম। খুব ছোটবেলায় মুদি দোকানের এসিসট্যান্ট হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। তারপর মহাজনের বাড়িতে রাখালের চাকরি।

গানের নেশায় একসময় গান শেখার জন্য ওস্তাদের কাছে গমন। তারপর শাহ আবদুল করিমের জীবনে নানা বাধা বিপত্তি আসলেও তিনি গান সাধন ছাড়েন নি। ঈদের জামাত থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া, মসজিদ থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা, এক পর্যায়ে গানের কারণেই তাঁকে গ্রামছাড়া করার পরেও শাহ আবদুল করিম জীবনে কখনোই গান ছাড়েন নি। আবার গ্রামবাসীদের উদ্যোগে গানের লড়াইয়ে নিজেদের গ্রামকে জেতানোর মতলব থেকেই শাহ আবদুল করিমকে সেই গ্রামবাসীরাই ডেকে আনেন। শাহ আবদুল করিম সন্যাসী জীবনযাপন করতেন।

বাড়ি থেকে একবার বের হলে তিন মাস আর কোনো খোঁজ থাকত না। সন্যাসী জীবনের মধ্যেও তাঁর সংসার ছিল। প্রথম স্ত্রী হারানোর পর আবারও বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী'র নামে তিনি প্রথম গানের বইও প্রকাশ করেছিলেন। ১৩৫৫ সালে 'আফতাব সংগীত' নামে সেই বইতে মোট ৪০টি গান ছিল।

বইটির দাম ছিল বারো আনা। শাহ আবদুল করিমের দ্বিতীয় গানের বইয়ের নাম 'গণসংগীত'। ১১টি গান নিয়ে ১৬ পৃষ্ঠার বইটির প্রকাশক ছিলেন ছনাওর রজা। ১৯৮১ সালে ১৬৫ টি গান নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন দশ ফর্মার 'কালনীর ঢেউ' গানের বইটি। বইটির প্রকাশক তাঁর ছেলে নূর জালাল (বাবুল)।

বইটির দাম ছিল ১৫ টাকা। বইটি তিনি নিজের টাকায় প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ১৯৯০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ধলমেলার দিন (১ ফাল্গুন) একটি দীর্ঘ কবিতা ও একটি গান নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন ১৬ পৃষ্ঠার 'ধলমেলা' বইটি। ১৯৯৮ সালে ৮৫ টি গান নিয়ে প্রকাশ করেন 'ভাটির চিঠি' বইটি। বইটি প্রকাশ করে সিলেট স্টেশন ক্লাব।

১৯৮১ সালের পরে তিনি যেসব গান লিখেছেন সেগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় ৮৮ পৃষ্ঠার বই 'কালনীর কূলে'। বইটির প্রকাশক লোকচিহ্ন। ২০০১ সালে শাহ আবদুল করিম একুশে পুরস্কার পাবার পর ২০০৯ সালের ২২ মে প্রকাশিত হয় 'শাহ আবদুল করিম রজনাসমগ্র'। এতে মোট ৪৮০ টি গান স্থান পেয়েছে। শাকুর মজিদের গবেষণায় উঠে এসেছে শাহ আবদুল করিমের মোট গানের সংখ্যা ৪৮০ টি।


'ভাটির পুরুষ' নির্মাণ করতে গিয়ে শাকুর মজিদ শাহ আবদুল করিমের শিষ্য রুহী ঠাকুর, রণেশ ঠাকুর, জামাল উদ্দিন হাসান বান্না, আবদুর রহমান, সিরাজ মিয়া, ভাগিনা তোয়াহেদ, ছেলে নূর জালাল (বাবুল)দের সঙ্গে কথা বলেছেন। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ, সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী, সংগীতশিল্পী ও সুরকার সঞ্জীব চৌধুরী, হাবিব, লন্ডনের কায়া ও হেলাল, কলকাতার 'দোহার শিল্পগোষ্ঠী', কালিকা প্রসাদ, কবি ও প্রাবন্ধিক শুভেন্দু ইমাম, লোক গবেষক ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, সাংবাদিক ও গবেষক সুমনকুমার দাশ সহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন।
দীর্ঘ ছয় বছরে বাউল শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে নানাভাবে গবেষণা করার যে অভিজ্ঞতা শাকুর মজিদ অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে করেছেন, সেখানে কিছু কিছু অনাকাঙ্খিত বিড়ম্বনার মুখোমুখিও তাঁকে হতে হয়েছে। তবু একজন নির্ভিক অভিযাত্রীর মত তিনি যে অসাধ্য সাধন করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার সরল বয়ান 'ভাটির পুরুষ-কথা'। বইটির প্রকাশক আবুল খায়ের।

বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শাকুর মজিদের আলোকচিত্র অবলম্বনে শিল্পী শিবু কুমার শীল। বইটির মূল্য ২৮৫ টাকা। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬৮। বোর্ড বাধাই বইটিতে শাকুর মজিদ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের নানান পর্যায়ের অনেক দুর্লভ ছবিও ব্যবহার করেছেন।

যারা বাউল শাহ আবদুল করিম সম্পর্কে জানতে চান, এই বইটি তাদের সংগ্রহ করতেই হবে। শাহ আবদুল করিমের অনেক গানের কথা বইতে স্থান পেয়েছে। বাউল শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় গানগুলো যেমন- 'বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে', 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম', 'গাড়ি চলে না', 'আমি কূলহারা কলঙ্কিনী', 'কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া', 'কোন মেস্তরি নাও বানাইছে', 'কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু', 'বসন্ত বাতাসে সইগো', 'আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু', 'মহাজনে বানাইয়াছে ময়ুরপংখী নাও', 'আমি তোমার কলের গাড়ি', 'সখী কুঞ্জ সাজাও গো', 'জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে', 'মানুষ হয়ে তালাশ করলে', 'আমি বাংলা মায়ের ছেলে', 'রঙ এর দুনিয়া তরে চায় না' ইত্যাদি গানগুলো বাংলার গানপাগল মানুষের অন্তরে চিরদিন বেঁচে থাকবে। শাকুর মজিদ বাউল শাহ আবদুল করিমকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাঁর এই পরিশ্রমকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে সাধুবাদ জানাই। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সিলেটের নূরজাহান পলি ক্লিনিকে বাউল শাহ আবদুল করিম ইহকাল ত্যাগ করেন।

উজানধল গ্রামে নিজের বাড়িতে স্ত্রী সরলা'র কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয় ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে। যারা বাউল শাহ আবদুল করিমের গান ভালোবাসেন, তারা দেখতে পারেন শাকুর মজিদের লেখা মঞ্চনাটক সুবচন নাট্য সংসদের 'মহাজনের নাও' আর তথ্যচিত্র 'ভাটির পুরুষ'। ।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.