আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন ভাটির মানুষ: তাঁর চেতনা, কিছু স্মৃতিচিহ্ন এবং আমার অনুভূতি

'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। শিরোনাম দেখে পাঠক হয়তো চিন্তা করছেন, ’'ভাটির মানুষ'’ বলতে কাকে বোঝাচ্ছি? সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের উজানধল গ্রামের সেই নির্লোভ, প্রচার বিমুখ মানুষটার কথাই আমি বলছি, যিনি ’'বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম'’ নামে সমধিক পরিচিত। ভাটির জল-হাওয়া আর মাটির গন্ধ, কালনী নদী তীরবর্তী জনজীবন, মানুষের সুখ-দু:খ, দারিদ্র্য-বঞ্চনা, জিজ্ঞাসা, লোকাচার, স্মৃতি প্রভৃতি তাঁর গানে এক বিশিষ্ট শিল্পসুষমায় পরিস্ফুটিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ভাটি বাংলার বাউল সাধক এই জগতখ্যাত মানুষটিকে নিয়ে অনেক লেখা, অনেক অনুষ্ঠান, অনেক সাক্ষাতকার, অনেক পুস্তক প্রকাশনা হয়েছে।

তাই পাঠকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, পৃথিবীর বুকে সাধারণ জীবন-যাপন করে যাওয়া অসাধারণ এই মানুষটিকে নিয়ে কেন আমার এহেন লেখা-লেখির অবতারণা? বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম সম্প্রতি তাঁর বাড়ি ঘুরে এসে, তাঁর স্মৃতি চিহ্নগুলোকে স্বচক্ষে খুব কাছে থেকে দেখে অনেকটা নিজের আত্মতৃপ্তির জন্যে, কবির ব্যাপারে নিজের কিছু লেখার আকুল আকাঙ্খা থেকেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। বাউলসম্রাটের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা: ১৫ জানুয়ারি, ২০১২। সকাল ১১.৩০। দিরাই বাজার থেকে মোটরসাইকেলে ধলের রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ যাবার পরে স্থানীয় মানুষজনদের কে ’'করিম সাহেবের বাড়ি কোনটা?’' জিজ্ঞেস করতেই তারা দেখিয়ে দিলো বাড়িটি। বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশের সাথে সাথে '’দুখু মিয়া'’, যিনি বাউল সম্রাটের সম্পর্কে নাতি হন, আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানালেন।

বিশ্বখ্যাত বাউল সম্রাটের স্মৃতিচিহ্ন দেখার উদ্দেশ্যে এসেছি জানতে পেরে হাসি মুখে তিনি আমাদের কবির মূল বাড়িটির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথেই দেখলাম কবির সহজ সাধারণ জীবনযাপনের স্মৃতিচিহ্ন গুলো। সেখানে পরিচয় হলো বাউল সম্রাটের পুত্রবধু শিরীন আক্তার এবং নাতি শাহ নূর আলম -এর সাথে। যে বাড়িটিতে বাউল সম্রাট থাকতেন এই ঘরটির ভেতরেই ঘুমিয়ে আছেন শাহ আবদুল করিম ও তাঁর সহধর্মিনী একে একে দেখলাম শাহ আবদুল করিমের রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নগুলো: যে বিছানায় তিনি ঘুমাতেন, তাঁর হারমোনিয়াম, একতারা, বেহালা। বাড়ির দেওয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে অনেক দুর্লভ কিছু ছবি।

আর আলমিরাগুলোর মধ্যে দেখলাম তাঁর মূল্যবান পদকগুলো। মূল বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখলাম একটি ঘর, যে ঘরের ভেতরেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম তাঁর সহধর্মিনীর পাশের কবরটিতে। বাউল সম্রাটের ব্যবহৃত বিছানা বাউল সম্রাটের ব্যবহৃত হারমোনিয়াম এবং একতারা বাউল সম্রাটের ব্যবহৃত বিছানার আরও একটি ছবি আলমিরার ভেতরে তাঁর দুর্লভ সম্মাননা সমূহ ঘরের দেওয়ালে রক্ষিত দুর্লভ ছবিগুলো তিনি, তাঁর সহধর্মিনী এবং তাঁর একমাত্র ছেলে তাঁর ব্যবহৃত বেহালা হাতে দুখুমিয়া গ্লাসের ভেতরে রক্ষিত তাঁর সম্মাননা তিনি ও তাঁর সহধর্মিনী বাউল সম্রাটের গুরু মাস্তান শাহ মূল বাড়ি থেকে একটু দূরেই রয়েছে কবির নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া সংগীত একাডেমী। আর একটু দূর হেঁটে চলে গেলাম সেই বিখ্যাত কালনী নদীর ধারে, যে নদীটি কবির জীবনে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলো। বাউল শাহ আবদুল করিম সঙ্গীত একাডেমী এই সেই বিখ্যাত কালনী নদী শাহ আবদুল করিমের পুত্রবধূ এবং নাতি প্রস্তাবিত জাদুঘর কালনীর তীরের এ রাস্তা দিয়েই হেঁটে ঘরে ফিরতেন বাউল সাধক তাঁর ঘরের ভেতরের আরও কিছু ছবি চিরনিদ্রায় শায়িত বাউল সাধক বাউলসম্রাটের সংক্ষিপ্ত জীবনইতিহাস: জন্ম: সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলাধীন ধল-আশ্রম গ্রামে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি (মঙ্গলবার)।

১৯৫৭ সাল থেকে উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মৃত্যু: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯ শ্বাসকষ্টজনিত রোগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পিতা-মাতা: বাবা ইব্রাহিম আলী, মা নাইওরজান বিবি। বিবাহ: বাউল সম্রাটের জীবনসঙ্গিনীর নাম মুমজান, তিনি অতি সহজ-সরল ছিলেন বলে তাঁর স্বামী তাঁকে ’'সরলা'’ বলে ডাকতেন। সন্তান: একটি মাত্র ছেলে, নাম নূর জালাল।

সঙ্গীত জগতে পদচারণা: দূরসম্পর্কীয় দাদা নসিবউল্ল্যাহ, নেত্রকোণার বাউল সাধক রশিদউদ্দিন, মৌলাবক্স মুন্সী প্রমুখের সান্নিধ্যে তিনি তাঁর সঙ্গীত সাধনার শুরুর দিকে প্রত্যক্ষভাবে আসেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং '৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গাওয়া গণসঙ্গীত প্রতিটি আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। পূর্ব পাকিস্তান সময়কালীন তিনি বেতারে গান গেয়েছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭৫ সাল থেকে সিলেট বেতারে নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও তাঁর পদচারণা উল্লেখযোগ্য। সম্মাননা: ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ’একুশে পদক’ প্রদান করেন।

এছাড়াও মেরিল -প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা (২০০৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড (২০০৫), সিলেট সিটি কর্পোরেশন নাগরিক সংবর্ধনা (২০০৬), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), অভিমত সম্মাননা (২০০৬), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা (২০০৮), খান বাহাদুর এহিয়া সম্মাননা পদক (২০০৮) -সহ দেশ-বিদেশ থেকে বহু পদক, সম্মাননা এবং সংবর্ধনা পেয়েছেন। ১৯৬৪, ১৯৮৫ এবং ২০০৭ সালে তিনি তিনবার বিলাত ভ্রমণ করেন। বাউল সম্রাটের প্রকাশিত বইসমূহ: আফতাব সঙ্গীত (১৯৪৮), গণসঙ্গীত (১৯৫৭), কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮) এবং কালনীর কূলে (২০০১) বাউল সম্রাটের লেখা ও সুর করা কিছু গান: গায়ক: প্রদীপ কুমার, কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি গায়ক: আশিক, আমার বন্ধুরে কই পাবো সখিগো গায়ক: আশিক, যার যা ইচ্ছা তাই বলে, বুঝিনা আসল-নকল গায়ক: হাবিব ফিচারিং হেলাল, মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে আমি কুলহারা কলংকিনী গ্রামের নওজোয়ান বাউল সম্রাটকে নিয়ে কিছু ডকুমেন্টরি: ভাটির পুরুষ: ১ম পর্ব ভাটির পুরুষ: ২য় পর্ব ভাটির পুরুষ: ৩য় পর্ব ভাটির পুরুষ: ৪র্থ পর্ব ভাটির পুরুষ: ৫ম পর্ব ভাটির পুরুষ: ৬ষ্ঠ পর্ব উৎসব: আসছে ফাল্গুন মাসের ১ম বুধবার '’ধল মেলা’'। ঠিক তার পরের শনি এবং রবিবার ’'বাংলা লিংক'’ এর সৌজন্যে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে লোকউৎসব হবে। শাহ আব্দুল করিম কিভাবে ঢাকা থেকে বাউলসম্রাটের বাড়ি যাওয়া যাবে: ঢাকা থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জ যেতে হলে ’'শ্যামলী পরিবহন'’ কিংবা '’মামুন'’ - যে কোন একটাই বেছে নেওয়া যায়।

শ্যামলী পরিবহনের ভাড়া জনপ্রতি ৫০০ টাকা। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ার সময়: সকাল ৭.০০, ৯.০০, দুপুর ১২.০০, ২.১৫, রাত ৯.৩০, ১০.৩০, ১০.৪৫ এবং ১১.১৫। উল্লেখ্য যে, শ্যামলীর বাসগুলো কল্যাণপুর কাউন্টার থেকে ছেড়ে আসে। সুনামগঞ্জ পুরাতন বাসস্ট্যাণ্ড থেকে ছাড়ার সময়: সকাল ৭.৩০, ৯.১৫, ১০.৩০, দুপুর ১২ টা (আপাতত বন্ধ), ২.৩০, রাত ১০.৩০, ১১.০০ এবং ১১.৩০। ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জ যেতে হলে 'গ্রীনলাইন পরিবহন' সবচাইতে ভালো।

ঢাকা থেকে ৫ ঘন্টায় সিলেট শহরে নেমে রিজার্ভ ১৫০ টাকা ভাড়ায় সিএনজি -তে করে চলে যেতে হবে কুমারগাঁও (সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যাণ্ড)। সেখান থেকে ১১০ টাকা ভাড়ায় দিরাইগামী বিরতিহীন বাসে সর্বোচ্চ ২ ঘন্টায় পৌঁছে যাবেন দিরাই। দিরাই পৌঁছানোর পর বাজার থেকে আপ-ডাউন ২০০ টাকায় মোটরসাইকেল ভাড়া করে আনুমানিক ২০ মিনিটে ’ধলবাজার’ পৌঁছে ’করিম সাহেবের বাসা’ বললেই লোকজন দেখিয়ে দেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, দিরাইতে থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই যদি রাতে থাকতেই হয়, তবে দিরাই বাসস্ট্যাণ্ড থেকে লেগুনা-তে জনপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়ায় সুনামগঞ্জ শহরে গিয়ে নিচের যে কোন একটি যায়গায় থাকতে পারেন: ১. ওয়ার্ল্ড ফিস সেন্টার (এনজিও), ষোলঘর, আলীপুর, সুনামগঞ্জ।

যোগাযোগ: জনাব হালিম, ফোন: ০১৯১৮ ২৭৩৪৮৫ ২. সানক্রেড (এনজিও), হাসননগর, সুনামগঞ্জ। যোগাযোগ: জনাব রেমা, ফোন: ০১৭১৮ ৫২৩২০৪ ৩. সিএনআরএস (এনজিও), সুনামগঞ্জ। যোগাযোগ: জনাব আলম, ফোন: ০১৬৮১ ৩০৮১৭৪ ৪. হোটেল প্যালেস, সুনামগঞ্জ। যোগাযোগ: জনাব মনোজকান্তি, ফোন: ০১৭১৯ ০৪৮২৮২ এই লেখার সূত্রসমূহ: ১. বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম, লেখক: সুমনকুমার দাশ ২. গণগীতিকার শাহ আবদুল করিম, লেখক: সুমনকুমার দাশ ৩. শাহ আবদুল সংবর্ধন-গ্রন্থ, সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত ৪. শাহ আবদুল করিম রচনা সমগ্র, সংকলন ও গ্রন্থ: শুভেন্দু ইমাম ৫. উইকিপিডিয়া কৃতজ্ঞতা: ব্লগার হুদাই পেচাল ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.