বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...
জীবনানন্দ পুরস্কার ২০০৮ পেলেন কথা সাহিত্যে সুশান্ত মজুমদার এবং কবিতায় কামাল চৌধুরী। শুক্রবার জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে জীবনানন্দ পুরস্কার ২০০৮ প্রদান অনুষ্ঠাণে সভাপতিত্ব করেন ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি বেলাল চৌধুরী। অনুষ্ঠাণে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট প্রাবান্ধিক প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। এছাড়া আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি রফিক আজাদ, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি নূরুল হুদা ও কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এছাড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই লেখক অনুষ্ঠাণে তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্নণা করেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন নব্বই দশকের তরুণ কবি শামীম রেজা। ধানসিঁড়ি সাহিত্য সৈকত ও শিল্প সাহিত্যের কাগজ ও দূর্বা যৌথভাবে এই পুরস্কারের উদ্দ্যোক্তা। অনুষ্ঠাণে নানা বয়সি কবি সাহিত্যিক লেখিয়েদের উপস্থিতি শেষ পর্যন্ত একটা প্রাণবন্ত সাহিত্য আড্ডায় রূপ নেয়। দেশের প্রচলিত সাহিত্য পুরস্কারগুলো থেকে এই পুরস্কারের বিশেষত্ব হল এর আগে কোন জাতীয় পদকে ভূষিত হননি এমন ব্যক্তিদের জন্যই কেবল এটি প্রযোজ্য। যদিও নোবেল পুরস্কার থেকে শুরু করে যে কোন ধরনের পুরস্কারের সাথেই আজকাল রাজনীতির ব্যাপারটি জড়িত।
কিন্তু আয়োজক ও আলোচকদের নিরহঙ্কার দাবী ছিল যে জীবনানন্দ পুরস্কারটি সে তুলনায় অনেকটাই অরাজনৈতিক পুরস্কার। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৭ সাল থেকে ধানসিঁড়ি ও দূর্বা যৌথ উদ্দ্যোগে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। সে বছর জীবনানন্দ পুরস্কার পান কবিতায় আসাদ মান্নান এবং কথা সাহিত্যে সালমা বাণী।
অনুষ্ঠানের শুরুটা ধরতে দেয়নি ঢাকার যানজট। তাই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আর প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর আলোচনা শোনার সৌভাগ্য হয়নি।
প্রফেসর সিদ্দিকীর বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে গিয়ে শুনলাম করতালিতে মুখরিত হলঘর। অনুমান করি স্বয়ং কবি জীবনানন্দ দাশ এই অনুষ্ঠাণে সশরীরে হাজির থাকলে উনিও খানিকটা পুলকিত হতেন। কারণ কথায় কথায় তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছিল নানা বিশেষণে নানা ভঙ্গিমায়। কবি বেলাল চৌধুরী জানালেন একবার নাকি কলকাতায় এরকম একটা অনুষ্ঠাণে কবি জীবনানন্দকে একটা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিল। পুরস্কারের মূল্য ছিল নগদ একশো টাকা, একটা সম্মাননা পত্র আর অনেকগুলো ফুলের মালা।
কবি তনয়া মঞ্জুশ্রী দাশ বাবার স্বৃতিচারণে শুনিয়েছিলেন যে, অনুষ্ঠাণ থেকে ফেরার পর বাবাকে দেখলুম ফুলগুলো খাটের নিচে রেখে চুপচাপ লেখার ঘরে হেঁটে যাচ্ছেন। অনুষ্ঠাণ কেমন হল জিজ্ঞাসা করলে উনি তখনো আগের মতোই নির্লিপ্ত ছিলেন। অর্থ্যাৎ পুরস্কারের প্রতি স্বয়ং জীবনানন্দই তেমন একটা আগ্রহ দেখাননি। পুরস্কার বরং শিল্পীর সৃষ্টিকে আরো শানিত করার জন্য উৎসাহ যোগাতে সাহায্য করতে পারে বলে তিনি অভিমত রাখেন। কবি রফিক আজাদ বলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিমান কবি জীবনানন্দ দাশ-এর নামে প্রবর্তিত এই পুরস্কার যথার্থভাবেই দু’জন সঠিক লোককে দেওয়া হচ্ছে দেখে তিনি খুশি।
তিনি পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই লেখককে আরো সৃষ্টিশীল লেখায় ধ্যানস্থ হবার পরামর্শ দেন। কবি আসাদ চৌধুরী আক্ষেপ করেন আজকাল যেন সাহিত্য চর্চায় সাধু ভাষার ব্যবহার একেবারে উঠে যাচ্ছে। লেখকদের তিনি সাধু ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ করেন। কবি নুরুল হুদা পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি কামাল চৌধুরী ও কথা সাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদারের সৃষ্টিশীল কাজের দীর্ঘায়ু কামনা করেন। তিনি বলেন আমরা যদি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি তাহলে বলতে হয় যে পুরস্কার দিতে পারে কেবল দুইজন।
স্বয়ং ঈশ্বর বা খোদা বা গড বা ভগবান। আর পারেন তাঁর প্রতিদ্বন্দী শ্রীমান শয়তান। আজকের এই পুরস্কারকে পরুস্কারপ্রাপ্তরা কিভাবে গ্রহণ করবেন এটা ওনাদের বেছে নিতে হবে।
পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক কথা সাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার জানালেন এটাই তাঁর জীবনে প্রথম কোন পুরস্কার প্রাপ্তি। অপর পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি কামাল চৌধুরী শোনান পুরস্কার নিয়ে অক্টাভিও পজ, ভিএস নাইপল আর নাগিব মাহফুজের খেদোক্তি।
অনুষ্ঠাণে দর্শক সারিতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কবি আজিজুর রহমান, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, কথা সাহিত্যিক সালমা বাণী, কথা সাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল, গল্পকার দম্পত্তি আনিস রহমান ও নাসিমা আনিস, কবি আমমেদ স্বপন মাহমুদ, কবি চঞ্চল আশরাফ, কবি শান্তা মারিয়া, কবি চন্দন চৌধুরী, কবি মাসুদ হাসান, মুহম্মদ মুহসিন প্রমুখ।
কথা সাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদারের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১১ নভেম্বর বাগেরহাটে। দীর্ঘদিন তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যে এমএ করেছেন। এছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯নং সেক্টরের একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সাংবাদিকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু।
এক সময় সচিত্র সন্ধানী’র সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। সেগুলো হল ছেঁড়াখোঁড়া জমি, রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও, জন্মসাঁতার, শরীরে শীত ও টেবিলে গুণ্ডাপাণ্ডা, সুশান্ত মজুমদারের মুক্তিযুদ্ধের গল্প, চরমৈহদ্দির মনুষ্যি, ছোঁয়াছুঁয়ি। এছাড়া তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস দুটো হল গরম হাত ও আমি আর আসব না।
কবি কামাল চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়করা গ্রামে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০টি। সেগুলো হল মিছিলের সমান বয়সি (১৯৮১), টানাপোড়েনের দিন (১৯৯১), এই পথ এই কোলাহল (১৯৯৩), এসেছি নিজের ভোরে (১৯৯৫), এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা (১৯৯৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৮), ধূলি ও সাগর দৃশ্য (২০০০), রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল (২০০৩), হে মাটি পৃথিবীপুত্র (২০০৬) ও প্রেমের কবিতা (২০০৮)। এছাড়া তিনি য. আলী রীয়াজ-এর সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন সত্তর দশকের কবিদের কবিতা (১৯৯৫)। এর আগে তিনি রুদ্র পদক ২০০০ ও কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার ২০০৮ লাভ করেন।
অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত গরম চা আর সাহিত্য আড্ডার মাধ্যমে শেষ হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।