স্বাগতম
কেমন আছি সৌদি আরবে –দ্বাদশ পর্ব
একবার ছুটিতে গিয়ে পুরানো এক ক্লাশমেটের সন্ধানে তাদের বাড্ডার বাড়ীতে গেলাম। বিকেল বেলায় গিয়ে সেই রাত ১০টা অব্দি বসে থাকার পর সে এলো। বললাম কিরে ক’ঘন্টা অফিস করিস,সেও একসময় সৌদি আরবে প্রবাসী ছিলেন,তাই কাচুমাচু করে বলল সকাল সাতটায় বের হয়ে এই এলাম!অর্থাত যাতায়ত সহ প্রায় ১৫ঘন্টা। আমার মনে হয় এই রকম সীমাহীন কার্যকাল কমবেশী সবাইকেই আমাদের বাংলাদেশে মেনে নিতে হয়।
এদেশে এসে আমি কিন্তু কাজের সময়সূচি দেখে বেশ খুশীই হয়েছিলাম।
হাতে গুনে ৮ঘন্টা মাত্র ডিউটি। যদি কোন দিন টেকনিশিয়ান ও লেবাররা ১০ঘন্টা কাজ় করে তবে ২ঘন্টা ওভার টাইমের পয়সা পাবে তারা। আর কার্যস্থলে যাতায়তের সময় কোনভাবেই এক ঘন্টার বেশী হয়না। আজতক আমাদের এই নিয়মের মধ্যেই চলতে হচ্ছে। তাই আমরা প্রবাসীরা অখন্ড সময় হাতে পাই গল্প গুজব আর টিভি-সিনেমা দেখার।
কেউ কেউ আবার বাইরে কাজ করে টুপাইস এক্সট্রা কামায়।
আমরা কাজে যোগদেয়ার পরই কতকগুলি ব্যক্তিগত ও সামাজিক সুবিদা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জন করি। আমার থাকা-খাওয়া,যাতায়ত ও স্বাস্থ্যগত গ্যারান্টি ঐ প্রতিষ্ঠানের মালিক দেবে।
ধরাযাক কারো বেতন ২০০০রিয়াল। তবে তার মূল বেতন ১২০০,খাওয়া খরচ ৩০০,যাতায়ত ৩০০ এবং মেডিকেল খরচ ২০০ রিয়াল(কোম্পানী ভেদে কমবেশী হোতে পারে) এছাড়াও একবছর বা দুবছর পর পর ছুটিতে দেশে যাওয়ার বিমানের টিকিট এবং আকামার টাকাও প্রতিষ্ঠানটি বহন করে থাকে।
এখন যাতায়ত ও মেডিকেল খরচ প্রায় ক্ষেত্রেই মালিক নিজের দায়িত্তে নিয়ে নেয় ,সেই ক্ষেত্রে তার বেতন কিন্তু ১৫০০ রিয়েল হয়ে গেল। আবার কেও যদি একদিন কাজে না আসে তবে ঐ ১২০০ রিয়াল বেসিক বেতন থেকে তার বেতন কাটা যাবে বা ওভার টাইম করলে ঐ বেসিক থেকেই হিসেব করে পাবে। এই নিয়মের বাইরে গেলে লেবার কোর্ট রয়েছে,সেখানে যে কেঊ কোম্পানির নামে বিনা পয়সায় কেইস করতে পারে। এবং হিসাব পত্রের জন্য অনেকেই সেখানে গিয়ে লাভবান হয়েছেন। সেখানে কাল কাপড়ওয়ালা উকিলের উপস্থিতি নেই।
নিজেই নিজের কথা জজকে বলা যায় আর অনুবাদক হিসেবে তারাই ফ্রিতে লোক নিয়োগ দেয়।
মেডিকেল সুবিদা আমরা পাই দুইভাবে। প্রথমতঃ কোম্পানীকে একটা সরকারী ইন্সুরেন্স,যাকে গুছি (General Organization for Social Insurance)বলে সেটা প্রত্যেকের জন্য মালিক কর্মচারীদের বেতনের ২% দিয়ে করা বাধ্যতামুলক। কোন কার্যদিবসে কেঊ যদি কাজ করতে গিয়ে কোনপ্রকার ব্যাথা বা দূর্ঘটনায় হাত-পা কাটা,চোখে আঘাত বা মরেও যায় তবে চিকিতসা এবং নির্দিস্ট হারে টাকা পয়সা পায়। আমার একটি উদাহরন দিচ্ছি একদিন গাড়ীর দরজা বন্ধ করতে গিয়ে আমার হাতের আঙ্গুল চিপায় পরে নখ উঠে গেল।
গুছির নির্দিস্ট হসপিটালে গেলাম। আমার কার্ডটা দেখাতেই বলল তোমার কোম্পানীরও একটা কাগজ লাগবে। আমি বললাম চিকিতসা করো পরে কাগজ নিয়ে আসবো, ব্যস হয়ে গেল বিনা টাকায় চিকিতসা। ডাক্তার একদিনের রেস্ট লিখে দিলেন। মাস খানেক পর ২১০রিয়ালের একটা চেক পেলাম গুছি থেকে।
ইন্সুরেন্স থেকে আমার একদিনের বেতন আর টেকসি ভাড়া দিয়েছে!
অন্য মেডিকেল সুবিদা হচ্ছে হেলথ ইন্সুরেন্স যা জ্বর,কাশি বা অন্যান্য অসুখ-বিশুখের জন্য। দু বছর আগে নিজ দায়িত্বে বা কোম্পানির নির্দিস্ট হাসপাতালে আমাদের যেতে হতো। তখন হয়তো টাকা বাচাতে অনেক কোম্পানী সহজে কাউকে মেডিকেল স্লিপ দিতনা। কিন্তু বর্তমানে এখানেও ইন্সুরেন্স বাধ্যতামুলক করা হয়ছে। তাই শুধুমাত্র ইন্সুরেন্স কার্ড দেখিয়েই মাত্র ১০%টাকা দিয়ে
নিজের যে কোন রোগের চিকিতসা ও ঔষধ নেয়া সম্ভব হচ্ছে।
আর একটা ইন্সুরেন্স চালু হয়েছে গাড়ির। আগে একটা একসিডেন্ট করা মানে ছিল নির্ঘাত জেলে যাওয়া। কোম্পানির লোক কাগজপত্র এনে গ্যারান্টি দেয়ার পর মুক্তি,দুদিন পর এলে দুদিন জেল হাজত!এখন এই কার্ড ট্রাফিক পুলিশকে দেখানো মানে আমার দায় ঐ ইন্সুরেন্স ওয়ালারা নিয়ে নিয়েছে। একদম স্পট থেকেই ছাড়া পাওয়া এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে একবার পুলিশ স্টেশনে গেলেই হলো।
আমার একটা ঘটনাই বলি।
দিন কয়েক আগে আমার গাড়ীতে এক বুড়ো সৌদি ঠুকে দিল। তার গাড়ী আমেরিকান জিএমসি আর আমারটা টয়োটা!বেশ ক্ষতি হলো আমার গাড়ীর। কিন্তু সৌদি বূড়ো নেমে এসে আমাকেই গালাগালি শুরু করলো!আমি জাস্ট মোবাইল হাতে কল করে দিলাম। তখন বুড়ো ইনিয়ে বিনিয়ে ৩০০ রিয়ালে রফা করে সটকে যেতে চাইলো আমি রাজি না হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ৪০মিনিট অপেক্ষার পর ট্রাফিক এসে দুটো গাড়ীরই ফটো নিলেন।
তার পর আমাদের কাগজপত্র দেখে ট্রাফিক অফিসে ২৪ ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট করতে বললেন। পরদিন গেলাম তারা এক ওয়ার্কসপে নিয়ে গিয়ে আমার গাড়ীর ক্ষতি বিবেচনা করলেন ১০৫০রিয়াল!! কাগজটা আনন্দের সঙ্গে ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে নিয়ে গেলাম। ওরা ১০দিনের মধ্যে আমার উক্ত টাকার চেক দেবেন বললেন। মাত্র ৪০০ রিয়ালেই আমি গাড়ী ঠিক করিয়ে বাকি টাকা চাইনীজে শেষ করেছিলাম!
এখানে একটা কথা না বললেই নয়। গাড়ীর ইন্সুরেন্স না করালে গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন করা যাবেনা আর অন্যান্য ইন্সুরেন্স না করা হলে কোম্পানির লাইসেন্সও নবায়ন হবেনা।
তাই বৈধভাবে এদেশে বসবাসকারীরা বিনাচিকিতসায় মারা যাচ্ছে এটা ডাহা মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়।
এবার আসা যাক এক্সিডেন্টে কেউ মড়লে কি হয়। রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলে বা আহত হলে পুলিশ এবং ডাক্তার ছাড়া কেঊ বডি টাচ করতে পারবেনা। অনেক সময় দেখা যায় আহত ব্যক্তিকে পুলিশ আসার আগেই যদি হাসপাতালে নেয়া যেত তবে সে হয়তো বেচে যেত কিন্তু পরে পুলিশের জেরায় উপকারী ব্যাক্তির জীবন হবে নরকতুল্য। শুধু তাই নয় কারো বাড়ীতে আগুন লাগলেও একমাত্র ফায়ার সার্ভিসের অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই,যাক না পুড়ে!বলা যায় এখানে আইনের বারাবারি!
এ যাবত আমার কোম্পানীতে অনেক লোকই মরেছে।
কেঊ রাস্তা পারাপারে কেঊ অসুখে। আমি কখনো দেখতে যাইনি,সাহস নেই বলে!তবে হাসপাতালে গিয়ে দেখার নিয়ম আছে। নির্দিস্ট লোকের থেকে অনুমতি নিয়ে নির্দিস্ট দিনে দেখতে যেতে হয়। কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা খুব ভাবাবেগের বলেই হয়তো পরিচিত অপরিচিত অনেক লোক সেখানে ভীড় করে। তাই হাস্পাতালের লোকজন বডি দেখাতে চায়না।
আমি জানিনা ঢাকার মর্গে একত্রে ১০/১২ জনকে একত্রে ঢুকতে দেয় কিনা। আর এই ডেডবডি দেশে পাঠানো যে কতো ঝামেলা সে অন্য কাহিনী আর এজন্য দায়ী আমাদের এম্বাসীর লোক। সেই কাহিনী অন্যদিন লিখবো।
সর্বশেষ সৌদি পুলিশের একটা উদাহরনঃরিয়াদ থেকে দাম্মাম আসার পথে আমার গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। আমি ছিলাম একদম একা।
হাইওয়ের দুইলেন বন্ধ করে রাস্তার কাজ করছিল। তাই বাকি দুই লেনে গাড়ী ছিল প্রচুর। আমার গাড়ী আরো এক লেন বন্ধ করায় লেন হয়ে গেল একটা। ফলে মৌচাকের মোড়ের জ্যামের মতো অবস্থা!১০/১৫মিনিটের মধ্যেই হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশ এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? বললাম ইঞ্জিন ডাউন। আমি গাড়ী থেকে নামতে চাইলাম কিন্তু পুলিশ আমাকে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকতে বললেন এবং তিনি নিজেই গাড়ী ঠেলতে ঠেলতে রাস্তার বাইরে নিয়ে এলো।
তারপর ফোন করে রেসকিউ ট্রাক ডেকে দিলেন। এবার বলুন সেই পুলিশ কি নিজে আমার গাড়ীতে বসে আমাকে দিয়ে গাড়ী ঠেলাতে পারতেননা?
অবৈধ অভিবাসি শুধু সৌদি আরবে নয় দুনিয়ার সব প্রান্তেই অবহেলিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।