৩১ অক্টোবর টঙ্গীতে বড় আকারে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ হয়েছে। শুক্রবার রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা সেখানকার নিপ্পন গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু সকালে কাজে এসে তারা দেখেন কারখানায় লে-অফের নোটিশ ঝোলানো আছে। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কারখানা বন্ধ থাকবে এক মাসের জন্য। গার্মেন্ট কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে, এমনকি শ্রমিকদের থেকে বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রেখে অতি চক্রান্তমূলকভাবে কারখানা বন্ধ করে দেন।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ মালিকানাধীন নিপ্পন গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এতবড় একটি কারখানায় শ্রমিকদের একেবারে কিছু না জানিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ ৩১ অক্টোবর সকালে কারখানা ফটকের সামনে এক নোটিশ ঝুলিয়ে দেন যাতে বলা হয়, 'এতদ্বারা নিপ্পন ক্যাম্পাসের সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বিশ্বমন্দার কারণে কারখানায় কাজ না থাকা এবং কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে ৩১ অক্টোবর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। 'এই সঙ্গে শ্রমিকদের ১০ নভেম্বর বেতন দেওয়ার কথা বলা হলেও অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে সে কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ শ্রমিকরা দেখেননি। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে মালিকপক্ষ এভাবে গোপনে কারখানা লে-অফের যে ব্যবস্থা করেছে এটি চক্রান্তমূলক ব্যাপার ছাড়া আর কী? কিন্তু তা সত্ত্বেও গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের অনেকের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস করার চক্রান্তের কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আসলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারণ, বলা যেতে পারে একমাত্র কারণ শ্রমিকদের প্রতি মালিকদের আচরণ, তাদের শোষণ, নির্যাতন ও ধাপ্পাবাজি।
কাজেই চক্রান্ত যদি কেউ করে থাকে তাহলে সেটা মালিকরাই করেছেন এবং সজ্ঞানে এ চক্রান্ত সমর্থন করছে মালিকদের সংগঠন। তার সঙ্গে সমর্থনের জোগান দিচ্ছে সরকার। এ দেশে শাসকশ্রেণীর সরকার ও পুঁজি মালিকদের একটি রেওয়াজ দাঁড়িয়েছে, যা তারা করে তার উল্টো কথা বলা। এ ক্ষেত্রেও সেদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। নিজেরা গার্মেন্ট শিল্পের বিরুদ্ধে নয়।
শ্রমিকদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে উল্টো তাদেরই চক্রান্তকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজেদের গা বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের চক্রান্ত এতই স্বচ্ছ যে, এ ব্যাপারে তারা হালে পানি পাচ্ছেন না।
আসল ঘটনা হলো দু'মাস কোনো মজুরি, ওভারটাইম ইত্যাদি না দিয়ে শ্রমিকদের দিয়ে একটানা কাজ করিয়ে শিপমেন্টের মালামাল তৈরি করা হয়। ৩০ অক্টোবর শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার কথা ছিল, সে অনুযায়ী তারা নিজেদের মজুরি ভাতা দাবি করেন। কিন্তু মালিকপক্ষ নানা টালবাহানা করতে থাকার পর শুক্রবারই শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করে শনিবার সকালে সবাইকে কারখানায় আসতে বলা হয়।
সে অনুযায়ী শনিবার শ্রমিকরা কারখানায় এসে দেখেন সেখানে গেটের সামনে উপরোক্ত লে-অফ নোটিশ ঝুলিয়ে ১০ নভেম্বর মজুরি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
লে-অফ নোটিশে বিশ্বমন্দা ইত্যাদির কথা বললেও তার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা শ্রমিকদের কাছে থাকেনি। কারণ তারা ইতিমধ্যে টানা দু'মাস কাজ করে শিপমেন্টের জন্য বস্ত্র তৈরি করেছেন। কাজেই বিশ্বমন্দা সম্পর্কিত মালিকদের বক্তব্য যে ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়, এটি বুঝতে শ্রমিকদের কোনো অসুবিধা হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে দু'মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সপরিবারে পেটে পাথর বাঁধা অবস্থায় শ্রমিকরা মেজাজ ঠিক রেখে শান্তশিষ্ট থাকবেন এটিই ছিল মালিকদের 'যুক্তিসঙ্গত' প্রত্যাশা! সেই প্রত্যাশা পূর্ণ না হয়ে শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে বিক্ষোভে নামায় মালিকপক্ষ বড়ই নাখোশ।
শুধু তা-ই নয়, তারা একে মনে করেন গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস করার জন্য শ্রমিকদের চক্রান্ত!!
মালিকরা যে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতাতেই এ কাজ করছেন এতে সন্দেহ নেই। গার্মেন্ট শিল্পকে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত করে এ শিল্প মালিকদের সরকার এমনসব সুবিধা প্রদান করছে, এমনভাবে তাদের আইএলও বা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়মকানুন মেনে চলার ক্ষেত্রে রেয়াত দিচ্ছে, যা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে সামরিক শাসন ছাড়া অন্য সময়ে এ দেশে চিন্তা করাও যেত না। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের অন্য হাতেগোনা কয়েকটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র ছাড়া কোনো সভ্য দেশে এর কোনো নজির নেই। এই শিল্প মালিকদের প্রতি সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এরা বাস্তবত কোনো আইন-কানুন ও নিয়মের তোয়াক্কা করেন না।
৩১ তারিখের শ্রমিক বিক্ষোভের সময় তাদের ওপর গুলিবর্ষণের ফলে তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
অসংখ্য শ্রমিক আহত হন। বকেয়া মজুরির দাবিতে আশুলিয়ার গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করার সময় সেখানেও গত ২৭-২৮ জুন পুলিশ গুলি করে দুই শ্রমিককে হত্যা করে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে বিএনপি, আওয়ামী লীগ কোনো সরকারের সময়েই বন্ধ থাকেনি। উপরন্তু মালিকশ্রেণীর পক্ষে দাঁড়িয়ে তারা একইভাবে শ্রমিকদের ওপর সর্বাত্মক নির্যাতনের ব্যবস্থাই করে এসেছেন। এবারও এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নেই।
৩১ তারিখের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মালিকদের এ বিষয়ে দায়ী করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের মর্মবস্তু উপলব্ধি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গার্মেন্ট কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে, তাদের একজনকেও গ্রেফতার না করে শ্রমিকদের ওপর ঢালাও নির্যাতনের ব্যবস্থা করেছেন। হাজার হাজার শ্রমিকের ওপর ঢালাওভাবে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে তাদের বেপরোয়াভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অন্যদিকে মালিকরা বেশ বহাল তবিয়তে থেকে গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের চক্রান্তের কথা বলছেন!!!
এই মালিকরা নেমকহারাম ছাড়া আর কী? শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার কারণেই তারা বিরাট মুনাফা লুট করছে এবং সব থেকে বড় বিদেশি মুদ্রা অর্জনকারী হিসেবে সরকারের দ্বারা প্রচারিত হচ্ছে। সরকারের এই পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শ্রমিকদের ওপর তাদের নির্মম শোষণ-নির্যাতন যে সম্ভব হতো না, এটি বলাই বাহুল্য।
কাজেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ৩১ তারিখের ঘটনার জন্য প্রকাশ্যে মালিকদের দায়ী করলেও সরকার যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না, এ বিষয়ে তারা নিশ্চিন্ত। মালিকদের এই চিন্তা যে সঠিক এটিই এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ প্রমাণ করছে। মালিকদের পরিবর্তে শোষিত-নির্যাতিত শ্রমিকদের ওপরই জেল-জুলুমের খৰ নেমে আসায় তারা নিজেদের এলাকায় অনেকে পলাতকের জীবনযাপন করছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নিয়ম-কানুন মেনে গার্মেন্টে লে-অফ ঘোষণা করা হয়নি। (যুগান্তর, ১-১১-০৯) কিন্তু এ বক্তব্য দেওয়ার পর এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর, যেভাবে উল্টো কাজ হচ্ছে এর থেকেই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সরকার সম্পূর্ণভাবে শ্রমিকদের বিপক্ষে এবং মালিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েই কাজ করছে।
এক্ষেত্রে শ্রমিকদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে অন্যান্য সরকারি কর্তৃপক্ষ যেসব বক্তব্য প্রদান করছেন সেগুলোর কোনো মূল্য যে বাস্তব ক্ষেত্রে নেই, এটি তারা নিজেদের কাজকর্মের মাধ্যমে নিজেরাই প্রমাণ করছেন।
নিপ্পন গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা দু'মাস ধরে শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া রেখেছেন। সামান্য মজুরিতে কাজ করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা কাজ করেন তাদের মজুরি এভাবে এতদিন ধরে বকেয়া রাখা শুধু যে এই একটি কারখানাতেই হচ্ছে তা-ই নয়, অনেক কারখানাই এ কাজ করছে। ৩১ অক্টোবর নিপ্পন কারখানার শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি দেওয়ার কথা বললেও মালিকরা সেটা না করে কারখানা বেআইনিভাবে লে-অফ করেছেন। এ ক্ষেত্রে সরকার কী করে সেটিই এখন দেখার বিষয়।
কোনো মালিককে সরকারের পুলিশ এখনও গ্রেফতার করেনি। কিন্তু সরকার কি মালিকদের বাধ্য করবে অবিলম্বে শ্রমিকদের পুরো মজুরি ও ভাতা পরিশোধ করতে? সরকার কি তাদের বাধ্য করবে অবিলম্বে বেআইনি লে-অফ উঠিয়ে নিয়ে কারখানা খুলে দিতে?
একদিকে মালিকদের পরিবর্তে শ্রমিকদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার এবং অন্যদিকে শ্রমিকদের পুরো বকেয়া মজুরি প্রদানের জন্য মালিকদের বাধ্য না করা হলে শ্রমিক ও মালিকদের প্রতি সরকরের দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি এবং আচরণের চরিত্র কী এটি শুধু শ্রমিক নন, জনগণের পক্ষেও বোঝার কোনো অসুবিধা হবে না।
২.১১.২০০৯
# প্রবন্ধটি আজকের (৩ নভেম্বর, ২০০৯) সমকালে প্রকাশিত।
# গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে আমাদের লেখা:
অথ সস্তা সমাচার (Click This Link)
# waronwant.org এ প্রকাশিত "Ignoring the Law - Labour rights violations in the garment industry in Bangladesh" শীর্ষক গবেষণাপত্রটি ( Click This Link) দ্রষ্টব্য। এবং এর সাথে মালিকদের গালগল্প মিলিয়ে নিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।