হেরোইন নুরুন্নবীর পুরস্কারবাতিক
নাম তার নুরুন্নবী। নামের আগে 'হেরোইন' শব্দ যুক্ত না করলে তাকে কেউ চেনে না। হেরোইনসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর এই 'খেতাব' যুক্ত হয়েছে তার। ইউপি নির্বাচনের সদস্যপদ থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়ে অবশেষে উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও হলফনামা জালিয়াতি করে আলোড়ন তুলেছেন। এ নিয়ে দুটি মামলাসহ সাকুল্যে তার নামে মামলা রয়েছে ৯টি।
নিজের সুযোগমতো দল বদলাতেও তার জুড়ি নেই। এরপরও 'সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের' স্বীকৃতিস্বরূপ মাঝেমধ্যে ঢাকা থেকে পুরস্কার নিয়ে এসে শোডাউন করে তা সবাইকে জানান দেন। বৃহস্পতিবার এমনই একটি অনুষ্ঠানে পুরস্কারের ক্রেস্ট নিয়ে পুলিশের মঞ্চে সংবর্ধনা নেওয়ার ঘটনা নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে কুড়িগ্রামে।
কে এই নুরুন্নবী :
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সুভারকুঠি গ্রামের বক্তার আলীর ছেলে নুরুন্নবী। দিনমজুর বাবার ২০/২৫ শতক জমির বেশি ছিল না।
নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৮০ সালে বিডিআরে চাকরি নেন। '৮৬ সালে ফেনীতে থাকার সময় চেক জালিয়াতি করে আড়াই লাখ টাকা আত্মসাৎ ও অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসার কারণে তিনি চাকরিচ্যুত হন। '৮৬ সালে ইউপি সদস্য, '৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সংসদ সদস্যপদে ও ২০০২ সালে ইউপি নির্বাচন করে প্রচুর অর্থ খরচ করেও হেরে যান। জাপার আমলে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। নিজের সুবিধামতো জাতীয় পার্টির বিভিন্ন উপদলে ভিড়ে যান।
বর্তমানে আওয়ামী লীগে যোগদানের চেষ্টা করছেন। পৈতৃক ভিটায় গড়ে তোলা 'পল্লীভবন'-এ এখন তিনি বাস করেন শান-শওকতের সঙ্গে।
চোরাচালান ও প্রতারণা : ১৯৮৭ সালে নাগেশ্বরীর নারায়ণপুর সীমান্তের সোলায়মান নামে এক চোরাকারবারির সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। সেই সুবাদে জড়িয়ে পড়েন চোরাকারবারে। মদ, গাঁজা, হেরোইন পাচার করে রাতারাতি অর্থ-বিত্তের মালিক হতে থাকেন।
'৯৬ সালে কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদ ডাকবাংলো থেকে পুলিশ হেরোইনসহ তাকে গ্রেফতার করে। যদিও প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কয়েকমাস হাজতবাস করার বিনিময়ে তিনি মামলা থেকে রেহাই পান বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়া ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ সীমান্ত পিলার, ম্যাগনেট, কষ্টিপাথর, মূল্যবান ব্রিটিশ মুদ্রা সরবরাহের কথা বলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা। ২০০১ সালে সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে তিনি একটি মুদ্রাসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। একই বছর বগুড়ার মহাস্থানগড়ে গণধোলাইয়ের শিকার হন।
নাটোরের এক ব্যবসায়ীর কাছে মুদ্রা দেওয়ার কথা বলে ৬ লাখ টাকা নেন। টাকা ফেরত না দেওয়ায় তিনি নাটোর থানায় একটি মামলা করলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোঃ নাসিমের আত্মীয় শরীফ চৌধুরীর কাছে একই কায়দায় ৪২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও শেষ পর্যন্ত ৩২ লাখ টাকা মেরে দেন তিনি।
কুড়িগ্রাম-রংপুর সড়কে আরডিআরএস বাজারে গাঙচিল নামে একটি শোরুম খুলে কয়েক বছর ধরে চোরাই কার ও মোটরসাইকেলের ব্যবসা করছেন। এই শোরুম দেখিয়ে ঢাকার ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের চিটুমা এন্টারপ্রাইজ থেকে বাকিতে ৪২ লাখ টাকার মোটরসাইকেল এনে ২০/২৫ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্টে বিক্রি শুরু করেন।
ওই ব্যবসায়ীকে ৫ লাখ টাকার চেক দিলেও চেক ডিজঅনার হয়।
ওয়ান-ইলেভেনের পর যৌথবাহিনী এখান থেকে চোরাই মোটরসাইকেলসহ তাকে গ্রেফতার করে। কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবার চালু করেছেন এই শোরুম। এছাড়াও স্কুলের সম্পদ আত্মসাৎ ও প্রতারণা করে জমি কেনাকে কেন্দ্র করে তিনি প্রতিবেশীদের মারপিট করলে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়, যা বিচারাধীন রয়েছে। ২০০৪ সালে সুভারকুঠি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা ও হলোখানা পল্লী উন্নয়ন সংস্থা নামের এনজিও খুলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বহু টাকা হাতিয়ে নেন বেকারদের কাছ থেকে।
বর্তমানে তার বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৩টি, নাটোর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১টি, ঢাকার সিএমএম কোর্টে ৩টি ও জেলা জজকোর্টে ২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
হলফনামা জালিয়াতি :
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে তিনি সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রতিদ্বন্দ্বী রফিকুল ইসলাম শাহী নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। এতে বলা হয়, তিনি তার বিরুদ্ধে দায়েককৃত ফৌজদারি মামলার তথ্য গোপন করেছেন এবং ঢাকা ও কুড়িগ্রামে চলমান ৪টি মামলার কথা চেপে গেছেন। পাশাপাশি নিজেকে এইসএসসি পাস দাবি করে দেওয়া হলফনামাও মিথ্যা বলে অভিযোগে বলা হয়। বেকায়দায় পড়ে হেরোইন নুরুন্নবী মোটা টাকার বিনিময়ে ওয়েবসাইটে জালিয়াতি করে হলফনামা পাল্টে নিজেকে অষ্টম শ্রেণী পাস ও চলমান ৭টি মামলার বিবরণ যুক্ত করেন।
এ ঘটনা ফাঁস হলে নির্বাচন অফিসের দুই কর্মচারীকে বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়।
পুরস্কারবাতিক : নিজের অপকর্ম ঢাকতে বারবার পুরস্কার ও সংবর্ধনা নিয়ে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তুলেছেন আলোচিত হেরোইন নুরুন্নবী। ঢাকার ভুঁইফোড় বিভিন্ন সংগঠনে মোটা অঙ্কের ডোনেশন দিয়ে এ পর্যন্ত 'স্বাধীনতা' পুরস্কার, 'অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার', 'মাদার তেরেসা পদক' ও 'মহাত্মা গান্ধী পদক' পেয়েছেন। প্রতিটি পুরস্কার পাওয়ার পর রঙিন পোস্টার ছাপিয়ে মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল বহর নিয়ে তিনি শোডাউন করেছেন। নিয়েছেন সংবর্ধনা।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম পুলিশ লাইনে পুলিশের একটি কনসার্টে পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা নিতে গিয়ে ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে পড়েন। এ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে জনমনে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান দাবি করেছেন নুরুন্নবী ৯ মামলার আসামি তা তিনি জানতেন না। শনিবার এ ব্যাপারে অভিযুক্ত নুরুন্নবীর বক্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। মামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, ২টি মামলা ছাড়া অন্যগুলো নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
তথ্যসুত্র: http://www.samakal.com.bd
আরও জানুন: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।