স্বাধীনতার ৪২ বছর অতিক্রান্ত হলেও দেশের রাজনীতিতে এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি হয়নি। রাজনীতি যেন অনাস্থা, ভয়, শঙ্কার এক অন্ধকারময় জায়গা। রাজনীতিতে এককথায় জাতীয় ঐক্য বা ঐকমত্য বলে কিছু নেই। যারা ক্ষমতায় আসেন তারাই তাদের মতো করে, নেতৃত্ব দিয়ে দেশ চালান। প্রতিপক্ষ বা বিরুদ্ধপক্ষের মতামত খুব একটা আমলে নেন না।
তাদের কথাও শোনেন না। এমনকি জাতীয় কোনো দুর্যোগেও আমরা একই অবস্থা দেখতে পাই রাজনৈতিক দলগুলো এবং জাতীয় নেতৃত্বের মধ্যে। দেখা যায়, ঐক্যের বদলে একে অপরের সমালোচনা, কখনো কখনো যা ইচ্ছা তাই বলার মহড়াও। যারা ক্ষমতায় আসে তার অতীতকে ভুলে দানবীয় রূপে আবিভর্ূত হয়। ক্ষমতার পালাবদল হলে আবার সেই একই নাটক মঞ্চস্থ হয়, শুধু পরিবর্তন হয় রাজনীতির কুশীলবরা।
মাঝখানে কেবল সাধারণ জনগণকে নিষ্পেষিত হতে হয়।
আমাদের জাতীয় রাজনীতির চিরাচরিত রূপটি এখন এরকম- ক্ষমতায় বসা বা আরোহণ মানেই প্রতিপক্ষকে দমন করা, গণতন্ত্রকে বিকশিত করার বদলে তার লাগাম টেনে ধরা, ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার, সর্বত্র দলীয়করণ এবং দুর্নীতিকরণ করা। মোটা দাগে বললে রাজনীতির চেহারাটা এখন পরিষ্কার এরকম। তৃণমূল থেকে জাতীয় রাজনীতি সবক্ষেত্রে এভাবেই চলছে। বলতে দ্বিধা নেই মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে দেশের রাজনীতিতে কিছু বড় দাগে পরিবর্তন হলেও রাজনীতি মোটেও তার পুরনো খোলস থেকে বের হতে পারেনি।
বরং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনীতি আলোর চেয়ে অন্ধকারের দিকেই ছুটে চলেছে। ফলে রাজনীতি নিয়ে, রাজনৈতিক চর্চা নিয়ে, নেতৃত্ব নিয়ে, যোগ্য বা সঠিক নেতৃত্বের বিকাশ নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন রয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যোগ্য-দক্ষ বা সঠিক নেতৃত্বের অভাবের কারণেই বাংলাদেশ প্রত্যাশিত উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারেনি। কোথাও কোথাও সাফল্য থাকলে তার মাত্রা আমাদেরকে সেভাবে সন্তুষ্ট করে না। অথচ আমাদের থেকে যারা পিছিয়ে ছিল শুধু সঠিক নেতৃত্বের কারণেই তারা এগিয়ে গেছে ঢের।
দেশকে তারা রীতিমতো বদলে দিয়েছে। বিষয় বিশেষজ্ঞরা এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি মাহাথির মোহাম্মদের উদাহরণ দেন এভাবে যে, একজন মাহাথির রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্ব দিয়ে সব দিকেই বদলে দিয়েছেন মালয়েশিয়াকে। বিশ্বের বুকে মালয়েশিয়াকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন।
রাজনীতির এই দুরবস্থার কারণেই বিশ্বের বুকে উন্নয়নের ধারায় বাংলাদেশকে যতটা এগুনোর কথা ছিল সেটা হয়নি। এখনো মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আমরা পরিগণিত হতে পারিনি।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে আমরা অনেক পিছিয়ে। মাতৃমৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি। কর্মসংস্থানের অভাব। নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা সেই অর্থে তৈরি হচ্ছে না। খাদ্য নিরাপত্তা খাতে আমরা এখনো বিভিন্ন দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে।
সামগ্রিক পুঁজির নিয়ন্ত্রণ রাখছে একটি শ্রেণী। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিকশিত হচ্ছে না। এর বিপরীতে হয়তো আমাদের কাছে অনেক ইতিবাচক উন্নয়নের কথা আছে। অনেকে হয়তো অনেক ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলবেন। অস্বীকার করব না সেটা হয়েছে।
তবে যতটা যে সময়ের মধ্যে হওয়ার কথা ছিল তার কাছাকাছিও হয়নি।
আমাদের দেশে সঠিক নেতৃত্ব বিকশিত হওয়া বা না হওয়া নিয়ে রাজনীতি যারা করেন বা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তবে আমরা যারা পর্যবেক্ষক আমরা বুঝি বর্তমান ধারার রাজনৈতিক চর্চা নিয়ে জনগণের মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভ-দুঃখ আছে এবং ঢের বেদনাও আছে। আর এ কারণেই রাজনীতিতে যখন বড় বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, রাজনীতিতে যখন আরও অন্ধকার সময় অনুভূত হয় তখন অনেকের বুক থেকে করুণ আর্তি শোনা যায়_ 'আমাদের রাজনীতিতে বুঝি আর সুদিন ফিরে আসবে না। আমাদের রাজনীতি সেই পুরনো পথ ধরেই চলছে।
নেতিবাচক রাজনীতিই এদেশটাকে এগুতে দিচ্ছে না। ' এ ধরনের কথাবার্তা যে কোনো জায়গাতে কান পাতলেই শোনা যায়। সাধারণ মানুষ সেই অর্থে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি মোটেও সন্তুষ্ট নন। যে কথা আগেই বলেছি রাজনীতিকে ঘিরে তাই সাধারণ মানুষের মনোবেদনার শেষ নেই। অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, এত সময় চলে গেল, ক্ষমতার কত পরিবর্তন হলো কিন্তু দেশ ও গণতন্ত্রের কোনো উন্নতি হলো না।
গণতান্ত্রিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হলো না। শুধু রাজা যায় রাজা আসে, আর নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটে। দেশ ও জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
রাজনীতিতে এখনো সেই একই আর্তনাদ চলমান। কোনো সুসংবাদের খবর নেই।
চারদিকে কেবলই প্রতিহিংসার প্রতিধ্বনি। সব মিলিয়ে রাজনীতিকে ঘিরে এক মহাজটিল কূটিল অবস্থা । মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নানা শঙ্কা, ভয়ভীতি, সংশয়। রাজনীতিকে আবর্ত করেই প্রতিহিংসার দাউ দাউ আগুন সর্বত্র। গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি এভাবেই চলমান।
গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, সুশাসন পুড়ে কেবলই কয়লা হচ্ছে। বিপরীতে দুর্বৃত্তায়ন আর দলীয়করণের উৎসব চলছে। দলীয়করণে আমরা এতটাই অন্ধ হয়ে উঠেছি যে, উপজেলা বা থানা পর্যায়ের একজন নেতা যা করেন ঠিক সেই একই কাজ করতে দেখা যায় শীর্ষ নেতারাদেরও। আর এ কারণেই আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেও আমরা দেখি দলীয় রাষ্ট্রপতির কৃপা পেয়ে আবার জনারণ্যে ফিরে আসতে। আবার মন্ত্রীদের আশীর্বাদে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগার থেকে সংগোপনে বের হয়ে যান।
আবার ক্ষমতার পালাবদল হলেই নাম বদলেরও হিড়িক পড়ে। জাতীয় পর্যায় থেকে এই উস্কানি ছড়িয়ে পড়ে খোদ তৃণমূল পর্যন্ত। এরকম আরও অজস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে। এসব কারণেই আমরা দেখছি রাজনীতিতে চাকচিক্য বাড়লেও ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসছে। একে অপরের মধ্যে বিভাজন বৈরিতা বাড়ছে।
প্রতিহিংসা আর নিপীড়ন নির্যাতনই যেন হয়ে উঠছে মুখ্য। রাজনীতির এই চেহারার কি কোনো পরিবর্তন আসবে না? রাজনীতি কি পুরনো আবর্তেই ঘুরপাক খাবে? পুরনো সংস্কৃতির মাঝেই কি রাজনীতি বন্দী হয়ে থাকবে? প্রতিহিংসার রাজনীতির এই সময়ে আমরা কি স্বপ্ন দেখতে পারি তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে? আমার বিশ্বাস তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্বই বদলে দিতে পারে আমাদের ঘুণেধরা পুরনো রাজনীতি। তারাই আনতে পারেন গুণগত পরিবর্তন। তৈরি করতে পারে আগামীদিনের এক সহনশীল সুন্দর সৌন্দর্যময় রাজনীতি। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে রাজনীতিতে আমরা অনেক তরুণ মুখ পেয়েছি।
টেলিভিশন খুললেই সেই মুখগুলোকে আমরা দেখতে পাই। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে টকশোতে এসব তরুণ এখন মুখর। দেশ, জাতি, উন্নয়ন, রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। অনেকেই স্বপ্নের কথা বলেন, স্বপ্নময় কথা বলেন। তাদের কথায় আশান্বিত হই।
রাজনীতিতে এখন যা চলমান বিশ্বাস করি সেই পুরনো বৃত্ত ভাঙতে সক্ষম হবে তরুণ রাজনীতিবিদরা। গণমাধ্যমে যখন দেখি একজন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী অ্যানি, আন্দালিব রহমান পার্থ, মাহি বি চৌধুরী কিংবা গোলাম মাওলা রনি, শাহরিয়ার আলম, জুনাইদ আহমদ পলক পাশাপাশি বসে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি নিয়ে যুক্তিতর্কের ভাষায় কথা বলছেন_ বিষয়টি আমাদের স্বপ্নের জায়গা তৈরি। তাদের কথায় আমরা আশান্বিত হই। কিন্তু পাশাপাশি আমরা হতাশও হই যখন দেখি সুকৌশলে তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। অযথাই বিষোদগার করা হচ্ছে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও কিন্তু তরুণ নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। দেশের প্রয়োজনেই তরুণ রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কাও রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। কয়েক বছর আগে খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানের রাজনীতিতে আগমন ঘটে। সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। রাজনীতির জন্য এটি সুসংবাদ এবং অভিনন্দনযোগ্য।
এই দুই তরুণ আধুনিক বিশ্ব ও রাজনীতি সম্পর্কে অবগত। তারেক রহমান এবং সজীব ওয়াজেদ জয় আগামীতে দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব আসবেন এটাই সত্য। এই দুই নেতৃত্ব নিয়ে দেশের মানুষের স্বপ্ন দেখাটাও স্বাভাবিক। রাজনীতিতে এই দুই তরুণের আগমন আমাদের উচ্চতর সৃজনশীল রাজনীতি চর্চার বড় এক নিয়ামক হতে পারে। কিন্তু সেখানেও কেন জানি হোঁচট খেতে হচ্ছে।
আমরা দেখছি এক ধরনের স্তাবকরা অহেতুক তুলনা করে এক অপরকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ বিষোদগারও করছেন। তারেক না জয় বড়_ রাজনীতিতে এই বিতর্কটা এখন অনর্থক এবং অপ্রত্যাশিত। আসলে রাজনীতিতে এক অর্থে দুজনই নবীন, হয়তো একজনের আগমন আরেকজনের একটু আগে বা পরে। রাজনীতিটাকে তারা কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন সেটাও খুব একটা পরিস্ফুটিত হয়নি।
কিন্তু সুকৌশলে এক ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা দুজনের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে চলেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে নতুন করে বিভাজন নয় বরং মতবিনিময়ের ঐক্যই জরুরি। যে ঐক্যের কথা দেশের সাধারণ মানুষ অন্তত নিজেদের মধ্যে লালন করে। তাদের মতে, রাজনীতির পুরনো সংস্কৃতির ধারা থেকে বেরিয়ে তারেক-জয় অন্তত যে কোনো জাতীয় ইস্যুতে এক টেবিলে বসবেন। আলোচনা করবেন।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। রাজনীতির চিরায়ত বিভেদমূলক বৃত্ত থেকে তারা বেরিয়ে আসবেন। তবে এ ক্ষেত্রে তাদেরকেও সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে সজীব ওয়াজেদ জয়কে মনে রাখতে হবে কাউকে ব্যক্তি আক্রমণ করে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তারুণ্য হলো একটি সমাজের প্রাণ।
যাদের মধ্যেই গড়ে উঠে আগামী দিনের নেতৃত্ব। ইতিবাচক রাজনীতি, শিক্ষা, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, মেধা-মননে, ক্রীড়া-সংস্কৃতিতে তরুণরা এগিয়ে গেলে আপনাআপনিই সমাজ এগিয়ে যায়, রাষ্ট্রের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। রাজনীতির পুরনো বলয় আর কেউ নয়- কেবলই ভাঙতে পারে তরুণ রাজনীতিবিদরাই। আমার প্রত্যাশা এই তরুণ রাজনীতিবিদরা এক চোখ নয়, সবকিছু দুই চোখ দিয়ে দেখবেন। এই তরুণ রাজনীতিবিদদের কাজ হবে পেছনের ইতিহাস ধরে থাকা নয়, প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে সামনে অগ্রসর হওয়া।
যদি জাতীয় ঐক্যের জায়গায়, রাজনীতির জায়গায়, গণতন্ত্র বিকাশের জায়গায় সর্বোপরি বাংলাদেশ গড়ার জায়গায় তরুণ নেতৃত্ব এক হতে পারে তাহলে বাংলাদেশের জন্য সামনে বোধহয় সত্যিই সুসময় অপেক্ষা করছে। তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতেই গড়ে উঠুক আগামীর এক নতুন বাংলাদেশ। প্রবীণ রাজনীতিকরা তরুণ নেতৃত্বকে বিভেদের বদলে ঐক্যের পথে হাঁটতে সহযোগিতা করলে বাংলাদেশে সত্যিই এক ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটবে। রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের যে আগমনী বার্তা শোনা যাচ্ছে তা হোক বাংলাদেশের জন্য এক নতুন আশীর্বাদ।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
ই-মেইল : kirondebate@gmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।