আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষা সংস্কার এবং ২৫ বৎসর মেয়াদী ভিশন

যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর।

গতকাল "জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও শিক্ষার্থীদের ভাবনা" শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও শিক্ষার্থীদের ভাবনা লেখাটির মূল বক্তব্য ছিল শিক্ষা সংস্কার এবং কর্মসংস্থানমূলক শিক্ষাকে একটি দীর্ঘমেয়াদী (২৫ বছর) ভিশন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা। ছোট ছোট মিশন নিয়ে ২৫ বছর মেয়াদী এই ভিশনটি বাস্তবায়নে দলমত নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

কারণ শিক্ষা এমন একটি বিষয় যা অর্জন করতে পারলে আমরা পৃথিবীর বুকে উন্নত জাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারবো। কারণ শিক্ষাই দারিদ্রকে দূর করে দিতে পারবে। একটি জাপানিজ নাটকের মর্মকথা থেকে উদ্বৃত্তি দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। নাটকটির নাম একশ বস্তা চাল। নাটকটির সময়কাল শোগানদের শেষ সময়।

মেইজি সংস্কার শুরু হয়েছে। দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি গ্রামে ক্ষুধার্ত জনগণকে ১০০ বস্তা চাল বিলিয়ে না দিয়ে সেই চাল বিক্রিলব্ধ টাকা দিয়ে স্কুল ঘর নির্মান করে এলাকার বৃদ্ধ পন্ডিত। পন্ডিতের যুক্তি গ্রামের পুরো জনগণকে উক্ত চাল বিলিয়ে দিলে মাথাপিছু এক ছটাক করেও পড়বে না, তাতে তাদের একবেলাও হবেনা। বরং তাদেরকে যদি শিক্ষার আলো পৌছিয়ে দেয়া যায় তাতে তারা দারিদ্রের কারণ উদঘাটন এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবে। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ১৯৭১ সালে।

বাংলাদেশ নামক দেশটির বয়স আজ আটত্রিশ। ৩৮ বছরের তারুণ্যে উদ্দীপ্ত টগবগে তরুণ হওয়ার কথা ছিল দেশটির। কিন্তু অশিক্ষা, দারিদ্র, কর্মহীন জনগোষ্ঠীর ভারে দেশটি আজ বৃদ্ধের ন্যয় জবুথবু হয়ে আছে। দুর্বল অর্থনীতি, দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশ নামক দালানটি ৩৮ বছরেই জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন এর সংষ্কার।

বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ভিশন-২০২১ দাঁড় করানোর লক্ষ্যে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। বিরোধী দল এই ভিশনটি মানছেন না। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে একটি ভিশন আমরা দাঁড় করাতে পারি। ভিশনটি হবে দীর্ঘমেয়াদী। ২০১০ সালে থকে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত ২৫ বছর সময়।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর পপুলেশন প্রজেকশন অনুযায়ী ২০৩৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ১৯৬ মিলিয়ন বা ১৯ কোটি ৬০ লক্ষ। এই ১৯ কোটি ৬০ লক্ষ লোককে পুরোপুরি শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব ২৫ বৎসরে। কীভাবে সম্ভব! বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সংষ্কার করাই হবে ভিশনের লক্ষ্য। ভিশন হচ্ছে কতগুলো মিশনের সমন্বিত ফলাফল। মিশনগুলো হবে একেকটি লক্ষ্যাভিমুখী সুনির্দিষ্ট সংস্কার কার্যক্রম।

সংষ্কার এবং কর্মসূচি যথাক্রমে ‘প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক’ এবং ‘কর্মসংস্থান’ দুটি পৃথক ইস্যুতে বিভক্ত। এ বিভক্তিকে একত্রীকরণের জন্য প্রয়োজন ‘সংস্কার-কর্মসূচি’। অর্থাৎ সংস্কার এবং কর্মসূচিগুলোকে সমন্বিতকরণ (Integration। সংষ্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের চুড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে সংস্কার কার্যক্রমটিকে আইনে পরিণত করা।

অন্যদিকে আইন প্রণয়নপূর্বক সেই আইনকে প্রয়োগ করেই পরিবর্তনের সূচনা করতে হয়। তাই পরিবর্তনের পূর্ব-শর্ত হচ্ছে আইন। সংষ্কার বিষয়ে ভাবনার ক্ষেত্রে পরিবর্তনকে একটু দূরে রাখতে হবে, একেবারে ফেলে দিলে চলবেনা। জনগণের মতামত নিয়ে সংষ্কার করে আইন প্রণয়ন করলে সেই আইন পালনে সাধারণ জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন এবং সহযোগিতা থাকবে। আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই সংস্কারের একটি ধাপ শেষ হবে।

পরবর্তী ধাপ শুরু হবে মূল্যায়ন এবং উন্নয়ন এর মাধ্যমে। শুরুটা করতে হবে ন্যাশনাল এডুকেশন কমিশন দিয়ে। গতানুগতিকভাবে হলেও সমস্যা নেই। তবে চুড়ান্তকরণের পূর্বে জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। ইতিপূর্বে বহুবার বাংলাদেশে এডুকেশন কমিশন বা কমিটি গঠন করা হয়েছে, স্থায়িত্ব পায়নি।

কিন্তু আমাদের প্রয়োজন একটি স্থায়ী ন্যাশনাল এডুকেশন কমিশন গঠন করা। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সামরিক, বেসামরিক সবাইকে নিয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। একটি মাইক্রো পাইলট প্রজেক্ট দিয়েই এর গোড়াপত্তন ঘটানো যেতে পারে। একটি স্থায়ী ন্যাশনাল এডুকেশন কমিশন গঠন করতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মতামতের প্রতিফলন থাকা দরকার। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনমত সংগঠিতকরণ।

একটি দক্ষ ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ ছোট্ট একটি পাইলট প্রজেক্ট এর মাধ্যমে জনমত সংগঠিতকরণের কাজটি শুরু করা যায়। এটিই হবে সংস্কার কর্মসূচিগুলোর গোড়াপত্তন। এর জন্য সরকারের অর্থ ব্যয়েরও প্রয়োজন নেই। শুধু আগ্রহী ও উপযুক্ত একজন-দুজন-একদল কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েই এরকম মাইক্রো প্রজেক্ট শুরু করা যেতে পারে। শিক্ষা সংষ্কারের লক্ষ্যে এ পাইলট প্রজেক্টের থাকবে নানান উদ্দেশ্যমুখী কর্মসূচি।

এ প্রজেক্টটি শিক্ষা সংষ্কারের নীতি-কৌশল প্রণয়ন, নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে আগ্রহীদের প্রচলিত এবং আরও কিছু আধুনিক পদ্ধতিতে খুঁজে বের করবে। একটি পুরো জনগোষ্ঠীর কি ভিশন হতে পারে, এর জন্য কি কি মিশন হাতে নেয়া দরকার এগুলো গবেষণা আকারে তুলে আনবে। পাশাপাশি মিশনের অন্তর্ভুক্ত কর্মসূচিগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কার্যক্রম ও কার্যপদ্ধতি, সময়, অর্থসংস্থান ও বাজেট এবং যৌক্তিকতা রিপোর্ট আকারে তুলে আনবে। এগুলোর গবেষণালব্ধ ফলাফল একটি সংগঠিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ, শিক্ষার্থী, প্রশাসক, ব্যবস্থাপকদের জানাবে। এটি হতে পারে তথ্যের একটি সমন্বিত পদ্ধতির সহায়তায়।

আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে তথ্য সংগ্রহ এবং সরবরাহ করে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মতামত, পরামর্শ, সমর্থন ইত্যাদি সংগ্রহ করা খুবই সম্ভব। প্রয়োজন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা। ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সরকারি নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হলে শুধুমাত্র একটি অনুরোধপত্রই যথেষ্ঠ। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে মতামত পৌছে দেয়ার কাজটিও এই প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব। এভাবে গড়ে উঠবে জনমত।

চুড়ান্ত জনমত যাচাইয়ের জন্য চুড়ান্তপ্রচার কার্যের পর গণভোটের মাধ্যমে জনমত যাচাই করা হবে। জনগণ যে ক’জনকে পছন্দ করবে তাদের দ্বারাই পুনরায় ভোট গ্রহণ না করা পর্যন্ত কমিশন পরিচালিত হবে। বাংলাদেশে চলমান শাসনতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে কাজটি দ্রুত এবং সহজে করা সম্ভব। এই স্থায়ী ন্যাশনাল এডুকেশন কমিশন গঠনের প্রারম্ভে কিছু বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। কমিশনের সদস্য নির্বাচন : সদস্য নির্বাচনের মূলনীতি হবে বহুমুখীকরণ।

বহুমুখীকরণের নীতিতে পূর্বতন সদস্যগোষ্ঠীর সাথে নতুন কিছু সদস্যগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্তকরণ। ফলে বাদপড়া গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হয়ে অধিকসংখ্যক গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। শিক্ষা যেহেতু সার্বজনীন বিষয়, সেহেতু শিক্ষা কমিশনে ক্রমান্বয়ে যতদূর বেশি সংখ্যক গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কমিশনের সচিবালয় স্থাপনে সর্বাধুনিকতার নীতি অনুসরণ করতে হবে। সর্বাধুনিকতার নীতি বিশ্বায়নের যুগে বিলাসিতা নয়, বিশ্বায়নের সুবিধাগ্রহণ।

এফএম রেডিও, মোবাইল, কম্পিউটার দিয়েই সর্বাধুনিকতার নীতি শুরু করা যায়। এরপর আসা যায় স্থাপনায়। শুরু করতে হবে ভাড়া বাড়িতে। পরিকল্পনা করতে হবে ন্যাশনাল এডুকেশন কমপ্লেক্স স্থাপনের। সরকার এ পরিকল্পনা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করবেন।

কমিশনের আরও কাজ হবে ন্যাশনাল এডুকেশন ফান্ড অথরিটি গঠন করা। এ অ্যাক্ট প্রণয়নের জন্য গঠন করতে হবে ন্যাশনাল এডুকেশন কমিশন। পটভূমি ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রয়োজন ন্যাশনাল এডুকেশন অ্যাক্ট। ন্যাশনাল এডুকেশন কমিশন সংষ্কার কার্যক্রম শুরু করার জন্য তথ্য সংগ্রহ, ফলাফল নির্ধারণ এবং ভবিষ্যত অবস্থার বিভিন্ন বিকল্প চিত্র তুলে ধরবে এবং তা প্রচার করবে। এজন্য একদল দক্ষ গবেষণাকর্মী ও প্রচারকর্মী তৈরি করতে হবে।

এজন্য এ দলকে এক বৎসর সময় দেয়াই যথেষ্ঠ হবে। কমিশনের কার্যক্রম : ১. কমিশনের সদস্য নির্বাচন। ২. কমিশনের কার্যক্রম নির্ধারণ। ৩. কমিশনের জনবল নিয়োগ। ৪. মাইক্রো পাইলট প্রজেক্ট গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

৫. মাইক্রো পাইলট মূল্যায়ন ও পাইলট প্রজেক্ট গ্রহণ। ৬. পাইলট প্রজেক্ট বাস্তবায়নের দিক নির্দেশনা প্রণয়ন। ৭. পাইলট প্রজেক্ট মূল্যায়ন ও কর্মসূচি প্রণয়ন। ৮. কর্মসূচি মূল্যায়ন ও উন্নয়ন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.