গত ৭ অক্টোবর তারিখে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। পোস্টের নাম "বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাঃ "দিন বদল" না হলেও দিন কিন্তু বয়ে যায় ......", লিংক: Click This Link তার পরদিন, ৮ তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি তাঁর মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানান দেন যে, বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জাতিসংঘের সালিস আদালতে (আরবিট্রেশন ট্রাইবুনাল) যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের এই অবস্থান সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য যুক্ত করে আমাদের আগের পোস্টে কিছু এডিট করেছি। যেহেতু আগের পোস্টটিতে অনেকেই আবার ঢুকবেন না- সেহেতু ঐ পোস্টে যুক্ত করা অংশটুকু এখানে পোস্ট আকারে দিচ্ছি।
বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান অবস্থান:
৮ অক্টোবর তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি তাঁর মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জাতিসংঘের সালিস আদালতে (আরবিট্রেশন ট্রাইবুনাল) যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
(নিউ এজ, ৯ অক্টোবর)
খুবই ভালো খবর, দীপু মনির ভাষায়- "বাংলাদেশের সম্পদ ও সমুদ্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এটিই যথাযথ পদক্ষেপ"। কিন্তু আমরা ঠিক এমন ভালো খবরেও ঠিক নি:শংসয় হতে পারছি না। আমরা আসলে কি দাবি জানাতে যাচ্ছি, তার ভিত্তি কি, ভারত ও মিয়ানমারের দাবির ব্যাপারে আমাদের আপত্তির ভিত্তি কি- এসব এখনো আমাদের জানা নেই। কেবল আমরা একজন আইনজীবী ব্রিটিশ ভন লুই এর নাম জানি- যিনি বাংলাদেশের পক্ষে আইনি লড়াই করবেন। স্বভাবতই এই আইনজীবী আমাদের সংশয় দূর করতে পারছেন না।
এর আগে গত ১৯ সেপ্টম্বর তারিখের বিডি নিউজ ( http://www.bdnews24.com/details.php?id= 143115&cid=2 ) এও দেখেছি, বাংলাদেশ নাকি তার দাবি পেশ করার ব্যাপারে প্রস্তুত। সেই রিপোর্টে কিছু স্ট্রাটেজিক আলোচনাও চোখে পড়েছিল বৈকি:
"Asked if Bangladesh has become isolated on the issue of maritime boundaries boundary issues, Quayes said all countries had to defend their own positions, but "Bangladesh is not without friends".
Pressed further, he said, "It's you who point out that China has good ties with Myanmar, but we too have good ties with China."
বাংলাদেশ কতখানি কি প্রস্তুত সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য আমাদের নেই, বরং আমরা সন্দিহান। বাংলাদেশ এই বিষয়টিতে এরই মধ্যে পিছিয়ে পড়েছে সত্য, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে এনিয়ে আওয়াজ তুলতে হবে- এটাও সত্য, কিন্তু তাড়াহুড়া করে যেনতেন প্রকারে আওয়াজ তুললে যে হিতে বিপরীত হতে পারে সে কথা আগেই বলেছি। পররাষ্ট্র সচিব মহোদয়ের "Bangladesh is not without friends" এবং তার ব্যাখ্যায় চীনের সাথে বাংলাদেশেরও ভালো বন্ধুত্ব আছে- এমন কথাবার্তাকে দায়িত্বশীল মনে হয় না। বস্তুত, চীনের সাথে সাথে মায়ানমারের বা বাংলাদেশের কেমন বন্ধুত্ব- তা কোন গণনাতেই আসবে না এটা হলফ করে বলা যেতে পারে।
মায়ানমারের যাবতীয় খনিজ- গ্যাস ও তেল সমস্তেরই চীন একচ্ছত্র ভোক্তা। ফলে- মায়ানমারের সমুদ্রাঞ্চল বৃদ্ধি পাওয়া মানে- চীনের সরাসরি সে বর্ধিত অংশের খনিজ পাওয়া। কোনভাবেই এদিকটা ভুললে চলবে না। তার চেয়েও বড় কথা, আগে তো আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দাবির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। সেকাজটিতে আমরা কোন অবস্থানে আছি?
বাংলাদেশ সমুদ্রবক্ষে উল্লেখযোগ্য কোন সার্ভে কাজ সম্পন্ন করেছে বলে আমাদের জানা নেই।
সার্ভের মাধ্যমে বাংলাদেশ সমুদ্রবক্ষে ফুট অব দ্য স্লোপ এবং ২৫০০ মিটার আইসোবাথ এর অবস্থান নির্ণয় করেছে কিনা, বাংলাদেশের কন্টিনেন্টাল সেলফ এর তলদেশ আসলেই যে বাংলাদেশের পলি দিয়ে গঠিত তার স্বপক্ষে কোন স্টাডি করেছে কিনা- তাও আমাদের জানা নেই। আর এসব প্রাথমিক প্রস্তুতি ছাড়াই যদি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে যায়- বাংলাদেশের পক্ষে রায় আশা করি কি করে?
বরং, সংশয় আরো বাড়ছে যখন দেখি, গ্যাসব্লকের নতুন মানচিত্র সম্বলিত দাবিটিকেই বাংলাদেশ তার দাবি হিসাবে জানাচ্ছে (যেটি প্রকৌশলী এম ইনামুল হকের মতে ত্রুটিপূর্ণ) এবং সেটা ১৯৭৪ সালে প্রণীত নিজস্ব সমুদ্র আইন (Bangladesh Territorial Waters & Maritime Zones Act 1974) অনুযায়ি করা- যেখানে বাংলাদেশ ২০০১ সালে সমুদ্রসীমা বিষয়ক UN Conference on the Law of the Sea 1982 (UNCLOS III) স্বাক্ষর করার পরেও UNCLOS III এর ধারাগুলো অন্তর্ভূক্ত করে ১৯৭৪ সালের সমুদ্র আইনকে উন্নীত করা হয়নি।
****************************************
যারা মূল পোস্ট (Click This Link) পড়েননি, তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে দুটো কথা:
নীচের মানচিত্রটি দেখুন:
ভারত ও মায়ানমারের দাবিকৃত সমুদ্রসীমার রেখাটির দিকে তাকালে বোঝা যায়- বাংলাদেশের ভাগে কতখানি অংশ থাকে! সমুদ্রবক্ষের ২৮টি গ্যাস ব্লকের অধিকাংশের ব্যাপারেই ভারত বা মায়ানমারের বা ভারত ও মায়ানমারের আপত্তি রয়েছে। এটার নিষ্পত্তি হবে কিরূপে?
বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা বিষয়ক UN Conference on the Law of the Sea 1982 (UNCLOS III) ২০০১ সালে অনুস্বাক্ষর করেছে, কিন্তু এখনও দাবী পেশ করেনি। নিয়মানুসারে UNCLOS এ স্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যে দাবি পেশ করতে হয়- সে হিসাবে ২০১১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তার দাবী পেশ করতে হবে।
ভারত ও মায়ানমারও UNCLOS III এ স্বাক্ষরকারী দেশ এবং এরই মধ্যে তারা তাদের দাবী পেশ করেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার দাবী পেশ না করলেও গ্যাসব্লকের নতুন মানচিত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে তার দাবীর কথা একভাবে প্রচার করেছে, এবং স্বভাবতই ভারত ও মায়ানমার উভয়েই তাদের স্ব স্ব আপত্তির কথা জানিয়েছে।
সেকারণেই আমরা বলছি- অবিলম্বে বাংলাদেশকে তার দাবীর কথা আন্তর্জাতিকভাবে পেশ করতে হবে। সেটা কেবল একটা মানচিত্রে বাংলাদেশের দাবিকৃত সমুদ্রসীমা দেখিয়ে দিয়েই নয়- বরং UNCLOS III এর ধারা-উপধারা মোতাবেক সেসমস্ত দাবীর স্বপক্ষে যুক্তি সহকারেই দাবী পেশ করতে হবে। যেহেতু ভারত ও মায়ানমার তাদের দাবী জানিয়েছে- এবং তাদের ও আমাদের দাবীকৃত সমুদ্র ওভারল্যাপ করেছে- সেহেতু তাদের দাবীর অযৌক্তিকতাও আমাদের তুলে ধরতে হবে।
আর এটা করতে গেলে- সমুদ্রবক্ষে নানাধরণের সার্ভে কাজ চালানোর কোন বিকল্পও নেই। UNCLOS III এ উল্লেখিত ফুট অব দ্য কন্টিনেন্টাল স্লোপ, ২৫০০ মিটার গভীর আইসোবাথ, ১% পলি যুক্ত সমুদ্র তলদেশ এসব নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত না করতে পারলে- আমরা আমাদের দাবীর স্বপক্ষে সুনিশ্চিত প্রমাণাদি হাজির করতে ব্যর্থ হবো- এবং ভারত ও মায়ানমারের কাছে আমাদের পরাস্তই হতে হবে। এসবই আমাদের আশংকার কথা। আমরা তাই চাই- বাংলাদেশ সবদিক দিয়েই প্রস্তুত হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এই ইস্যুটি মোকাবেলা করুক। আগের পোস্টে উল্লেখিত দাবিসমূহ এখানে আবার উল্লেখ করছি:
আমাদের দাবিসমূহঃ
১।
বাংলাদেশ যেহেতু সমুদ্রসীমা বিষয়ক UN Conference on the Law of the Sea 1982 (UNCLOS III) স্বাক্ষর করেছে, সেহেতু অবিলম্বে এর ধারাগুলি অন্তর্ভুক্ত করে Bangladesh Territorial Waters & Maritime Zones Act 1974 কে উন্নীত করতে হবে ।
২। অবিলম্বে বঙ্গোপসাগরে সমস্ত ধরণের সার্ভে কাজ সম্পন্ন করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ তার দাবির স্বপক্ষে তার অবস্থানকে জোরালো করতে পারে।
৩। পানি বিশেষজ্ঞ ও আইন বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সমস্ত দিক বিচার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে।
৪। ভারত ও মায়ানমারের সাথে এর বিরোধের জায়গাগুলো পরিষ্কারভাবে যুক্তি সহকারে (UNCLOS III এর ধারা মোতাবেক) দেখিয়ে আমাদের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৫। এটা আন্তর্জাতিকভাবে পেশ করার আগে দেশে সকলের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে, এবং সমুদ্রসীমা নির্ধারণের কাজে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের বাইরের নানাস্তরের বিশেষজ্ঞ ও সচেতন নাগরিকের মতামত গ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে।
৬।
জাতিসংঘ কর্তৃক প্রদত্ত সময়ের অন্তত এক বছর পূর্বে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত সমুদ্র তলদেশের তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে এবং UNCLOS III কনভেনশন এর ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের দাবী প্রস্তুত করে ভারত ও মায়নমারকে জানিয়ে দিতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।