আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তগদ্য: ছায়ানদ এবং কবির আত্মবিস্মৃত উত্তর

ডুবোজ্বর

০১. কবিরা স্বর্গে যায় না। কবিরা অগ্নিময় এবং অগ্নিজ। ওম স্বাহা। রাত্রি এসো, সকলদেয়াল ভেঙে এসো। আমি জন্মাবধি কবিতার দিকেই যাচ্ছি।

কবিতার পথ হলো দিগন্তের পথ। যতো যাই দিগন্ত দূরে সরে যায়। ০২. হয়তো নিজস্ব স্বর রপ্ত করতে পারি নি এখনো। কথা দিচ্ছি, একদিন সত্যি সত্যি কবিতা লিখে ফেলবো। আমি কবিতা লিখতে চাই, এটা সত্যি।

সবকিছুর উপর কবিতা সত্য। একটা কবিতা লেখার জন্যে আমি অনেককিছুই ছাড়তে পারি। আমি এখানে আমার সকল দীনতা নিয়ে এসেছি শুদ্ধ হবো বলে। কারণ সত্যি সত্যিই কবিতা লিখতে চাই, একটা সত্যিকারের কবিতা। আমার একান্ত কবিতা।

আমার ধ্যান পুরোপুরি শিল্পন্দনে, যার ভিত্তি রচনা করেছে কবিতা-ই। আমি শেষপর্যন্ত একটা কবিতা হলেও লিখতে চাই। আমি সবসময় চেয়েছি নিজের একটা স্টাইল দাঁড় করাতে, অন্য কবিতা থেকে নিজের লেখাকে আলাদা করতে । হয়তো এখনো পারি নি। তবে চেষ্টা চলছে নিয়ত।

কেন না আমি শেষপর্যন্ত একটা হলেও কবিতা লিখবো ঠিক করেছি। কখনো যদি একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারি! কখনো যদি একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারি! কখনো যদি একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারি! কখনো যদি একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারি! কেবল সেই জন্যেই বেঁচে থাকা। ০৩. নি ডাকতে পারেন। নি মানে শূন্য। আবার নৈ ডাকতে পারেন।

নৈ মানে নদী। অথবা ডাকতে পারেন নিনৈ; মানে শূন্যনদী। হা হা হা... আমিও যেতে পারি না, ডানা নেই আঙুরলতা শেষগ্রাম সুরসুদূরের। তবে কে যাবে? পেইন্টিং হলো টেক্সট আর অন্য সব কিছুর মতো। দর্শক(শিল্পের) এর বিচার করবে।

এইভাবে লিখে আমি স্বস্তি পাই। এতে তেমন একটা ব্যাকরণ লঙ্ঘন হয় না, তবে প্রথা লঙ্ঘিত হয় বৈকি। ০৪. কাহিনি পাখি হলে ছড়িয়ে পালক উড়ে গিয়ে বসে দিগন্তে কাহিনির ছায়া তলে আমরা ধূলিকাদা একাকার আদিগন্ত প্রথম স্তবক কল্পনা; দ্বিতীয় স্তবক অর্ধেক আত্মরতিজাত অর্ধেক কল্পনা। তৃতীয় স্তবক প্রার্থনা। শেষ স্তবক স্বপ্ন এবং কামনা-- প্রিয়তমনারী এবং প্রিয়তমমৃত্যুর কাছে।

আমি রাত্রি নিভিয়ে দিলাম প্রতিবারের মতো। তারপরও কীভাবে সম্ভব জানা নেই। ঘোর জানি। তাই ভোর জানি না। এখনো যদি ঘুম আসে তবে যাই।

০৫. কুসুম শব্দের প্রতি আমার বিশেষ কোনো মোহ নেই। তাই বাদ দিলাম। আর তা আমার হত্যার তালিকায় ছিলো। আর শব্দবন্ধের ব্যাপারে নতুন-পুরাতন, প্রচলিত-অপ্রচলিত বিষয়টা আমার মাথায় থাকে না যখন লিখি, যেশব্দটা অন্য যে শব্দটাকে সহজে বাঁধতে পারে, বাঁধতে দিই। যা লিখি একবারেই লিখি, যে শব্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ।

আসে তাকে কাটি না, আমি মূলত বাক্যের আধুনিকতা নিয়ে ভাবি। তবে শব্দের ক্ষেত্রে একটা বিষয় মানি প্রায় সবক্ষেত্রে, তা হলো গাছকে গাছ লিখি, তরু কিংবা মহীরুহ লিখি না, তেমনি আকাশকে গগন, মেঘকে অভ্র এইসব লিখি না। যা আমরা সচরাচর বলি সেইশব্দই লেখার চেষ্টা করি। আমরা যদি পরস্পর অসংগতি ধরিয়ে না দিই তবে পথ তার পা হারাবে। ০৬. দেয়ালকে দুহাতে বুকে চেপে ধরা যায় না, দেয়ালকে দুহাতে বুকে চেপে ধরা যায় না।

তাই দেয়াল আজন্ম হাহাকার। আমি আপনাকে ছুটি দেই নি, নিজে নিজেই নিলেন এতোদিন। ঝামেলা কেটেছে? কেমন আছেন, আপনি? আসেন, আমার ঘরে একটুখানি সুন্দর ছড়িয়ে যান। আপনার ঘর ঘুরে এলাম, নতুনপ্রদীপ কই? আমিও ঝড় চাই কিংবা বুক ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিতে চাই আরো কোনো ঝড়। আপনার কথা অবশ্যই ঠিক।

বাস্তবে সম্ভব নয় বলেই এতো স্বপ্ন আর কল্পনা। সবই অস্তিত্বের যন্ত্রণাকে ভুলে থাকার জন্যে। বালক মক্তব শুরুতেই ছেড়ে দিয়েছে। এবং প্রকৃতির বিদ্যালয়ে নিজে নিজেই ভর্তি হয়েছে। তাই সে মায়ের শুধু শূন্যিসিঁথি নয় স্রাবও দেখতে পায়।

০৭. কবিতাই আমার ঈশ্বর। তাকে আমি ছুঁতে পারি, ধারণ করতে পারি। আমাকেও সে পারে। কবিতা আমার লৌকিক ঈশ্বর। আমি তার ধ্যানই করি।

চাইলেই প্রতিদিন লেখা যায় না। মাঝে মাঝে অনেকদিন লিখতে পারি না। তবে যখন লিখি সারাক্ষণ লিখতে পারি। এটা অবশ্যই স্বতঃস্ফূর্ত। না ভাই, রেগে যাই নি।

আমি বছরে দুয়েকবার রেগে যাই। তাছাড়া আপনি রাগ করার মতো কিছু করেন নি। আপনি ফান করেছেন বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি ফান করে উত্তর দিই নি শুধু একটা কারণে: আপনি যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের নখের যোগ্যও আমি হতে পারবো কিনা সন্দেহ, কবি হওয়া তো অনেক দূরের কথা। তাদের জীবনের যন্ত্রণা, সাধনা, ত্যাগ আর সংগ্রাম অনেক বেশি।

আমি অতি তুচ্ছ এসবের কাছে। তাই নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। আমার তো স্বপ্ন ছাড়া কিচ্ছু নেই! এটা আমার বিনয় নয়, এটা আমার উপলব্ধি। ০৮. তারা মানে তো নক্ষত্র। আর নক্ষত্র পৃথিবীর আকাশেরো উপরে থাকে।

পৃথিবীর যাকিছু সবই তার ছায়া। বৃষ্টির দেবতা তো আর অনেক ছায়ার একটিমাত্র ছায়া.... ডুবে যেতে চেয়েছি পারি নি ভেসে যেতে চেয়েছি পারি নি উড়ে যেতে চেয়েছি পারি নি উক্তলাইনগুলিতে পারি নি হচ্ছে প্রলাপের মতো। প্রলাপে একই কথা বারংবার আসে। তুমি তো প্রতিধ্বনি, তোমাকে শুনি পাহাড়ের গায়ে; আমরা এইখানে কথা বলি-- পাহাড় ধরে রাখে বুকে ০৯. প্রতিবার বদ্ধঘরের গল্পগুলি কেঁদে কেঁদে ভোর প্রতিবার বদ্ধঘরের দেয়ালগুলি গল্পে কামাতুর হরিপদ বাবু আপনারে একটু নস্টালজিক করে দিই, ঘরেতে এলো না সেতো মনে তার নিত্য আসা যাওয়া; পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর... পিসির দেওরের মেয়ের কথা মনে পড়ে? আর আমি কান্তবাবু কিংবা নীরেন্দ্রনাথের অমল কান্তি। ১০. পাখি তার চঞ্চুতে দুইখানিধান রেখে ভুলে গেলো চুম্বন মেঘ তাই উড়ে এসে ঢেকে দিলো আনমনপাখিদের বন আপনার সাথে কি সবসময় মাইক্রোসকোপ থাকে? আমার সাথেও থাকে একখানা টেলিস্কোপ, তারা দেখি; আবার পাড়াও দেখি... না, নির্ঝর মানে যা অঝর ধারায় ঝরে, মানে আমাদের বাড়ির একটিঘরে রঙ আর ঝড় অঝোরে ঝরে।

কেননা পাখির মতো তাদেরও দেহর ভিতর রক্ত এবং হাড়ের ভিতর মজ্জা আছে। শুধু একটা জিনিশ নাই তাদের, তাদের ডানা নেই। তারা ডানা দেখতে গিয়েছিলো। তথাকথিত মনের ডানা অবশ্য আছে, তা দিয়ে ধূলি আর কাদায় হোছট খাওয়া ছাড়া কিছু করা যায় না। ১১. আমি কি লিখেছি সেটা বড় কথা নয়।

আপনি যা বুঝবেন তাই। আর যদি কিছুই না বুঝেন, তবে এইটা কিছুই হয় নাই। আমি নিজেই এটাকে দশভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। প্রথমে আমার আঁকা একটা পেইন্টিং এর বিবরণ লিখেছিলাম। ছবিটা বেশকিছু দিন ছিলো আমার দেয়ালে।

হঠাৎ একদিন একতীব্র ঘোরের ভিতর খুব নিষ্ঠুরভাবে ছবিটাকে নষ্ট করলাম, ফালি ফালি করে কাটলাম এন্টিকাটার দিয়ে। তারপর লেখাটা আমার কাছে অন্য অর্থ হয়ে গেলো। না, চোখের জলে অচেনা হয় না। মনে করেন আপনার প্রিয়তমনারীটি এসে আপনার ধবধবে বালিশে শুলো। তার দীঘল একটিচুল বালিশে ঝরে পড়লো, গোধূলিদিগন্তরঙ এবং আলোয় পাল্টে দিলো নকশা বর্ণ এবং ঘ্রাণ।

এই মহানসৌন্দর্য বুকে ধরে বালিশটি ক্রমে অচেনা হলো... বাকিটা আপনি ভাবেন। মূলত নারী এবং রাত্রি বিভিন্ন নয়। রাত্রি যেমন সৃষ্টির আধার তেমন নারীও... ফ্রয়েড ঠিকই করেছেন। নারীকে বুঝা যায় না। ফ্রয়েডের কোন একটা লেখায় জানি পড়েছিলাম তিনি সারাজীবন নারী নিয়ে গবেষণার পর শেষপর্যন্ত নারীকে বুঝতে পারেন নি।

পরে মনে হয়েছে আমি উক্ত কবিতায় এক আশ্চর্যসুন্দর সঙ্গমের স্মৃতিই বর্ণনা করেছি। এইখানে অবসাদ আছে। ১২. আমি অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করি না বললেই চলে। কেননা অপ্রচলিত শব্দ প্রয়োগের পক্ষে আমি নই। যদি কোনো বাক্যে অপ্রচলিত কোনোশব্দ অপরিহার্য হয়, তবে করি।

আমি সচেতন ভাবেই আমার বাক্যরচনায় সমস্ত চিহ্ন বর্জন করেছি। এবং আমি এমন কোনো বাক্য তৈরি করি না যে বাক্য বিরাম কিংবা যেকোনো চিহ্ন দাবী করে। আমার বাক্য যদি কোনো অর্থ প্রকাশ না করে, তবে তা চিহ্নের অভাবে নয়, আমার সক্ষমতার অভাবে। সমস্তবাক্যরচনার ভিতর কেবল একটি শব্দই কবিতাটিকে ধারণ এবং প্রকাশ করতে সক্ষম। বাকিটা ওই বিশেষ শব্দের অবগুণ্ঠন।

দৃশ্যগুলি যদি আপনি প্রলম্বিত এবং কল্পনা করতে না পারেন-- সে আমারই ব্যর্থতা। এখানে পরের লাইনের সাথে সম্পর্ক তেমন অপরিহার্য নয়। যেহেতু একজনের (যে দৃষ্টির বাইরেও দেখতে পায়, কিংবা ধরেন, নিওরোটিক কেউ) মুখ থেকেই কথাগুলি বের হচ্ছে সেহেতু একটা সম্পর্ক আছে তো বটেই। রাবণের সাথে সিঁথির একটা সম্পর্ক আছে। বলেন তো, কী? এখানে কথক এবং রাবণ একাকার।

১৩. এখন চোখের বিপরীতে দৃষ্টি সরীসৃপ বুকে হেঁটে নিতে চায় আত্মজ নির্যাস অন্ধকার সবচে বেশি দৃষ্টিনন্দন। অন্ধকারে চোখ রেখে কেউ কি অন্ধকারেই কিছু খুঁজে? যে চায় সেতো খুঁজে বুকের ভিতর। এন্টেনাটা ভেঙে ফেলেছি বেশকবছর আগে, চারপাশে জ্বেলে দিয়েছি অবিনাশী অন্ধকার কিংবা চারপাশই আমাকে অন্ধ করে দিয়েছে। চারপাশ ভয়ানক মনোটনাস। মেজরপয়েটকে তৈরি করা হয়, আর শক্তিমান কবি যন্ত্রণা আর সাধনার মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করেন।

১৪. মুঠো খুলে দেখি একটা রেখা মাঝখানে কাটা রেখাটা জীবনকে পরিমাপ করে দুচোখে জন্মাবধি বিঁধে আছে অশ্রুপুষ্পকাঁটা মুঠোতে কুয়াশা ভাঙি অন্ধকারে বিশেষণগুলি যুক্ত করে ফেলার প্রবণতা আমার নিজেরও চোখে লাগছে; কিন্তু কেনো যে করছি, কেনো যে করছি? তবে করবো। এবং একদিন অভ্যস্ত হয়ে যাবো। এটা অন্য অভ্যাস। সুন্দর মূর্ত আর সুন্দরতা বিমূর্ত। রোদে বোনা দিন হলো দিগন্ত।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।