বাঙলা কবিতা
শুন শুন সুন্দরি হিত উপদেশ।
হাম শিখাওব বচন বিশেষ \
*এই বলে বাঙালি বিদ্যাপতি রাধাকে কামকলা শেখাতে প্রবৃত্ত হয়েছেন। বেশ কিছু উপদেশ দেবার পর শেষে এসে বলছেন :
ভনহি বিদ্যাপতি কি বোলব হাম।
আপহি গুরু হই শিখায়ব কাম \
মানে, আমি আর কি বলবো, কামই স্বয়ং গুরু হয়ে তোমাকে শিক্ষা দেবে। লক্ষণীয়, এখানে বাৎসায়নের বিরুদ্ধে একটা হুংকার আছে।
প্রত্যাখ্যান আছে শাস্ত্রের বিরুদ্ধে। কবিতা সম্পর্কে প্রায় একই কথা বলা যায়। কবিতা কোনো ক্যানোনিকাল ব্যাপার নয়। যে-কেউ যে-কোনোভাবে কবিতা লিখবেন এবং ভবিষ্যৎ কবিতার পথ তারই প্রভাবলয়ে এসে নির্ধারিত বা রচিত হবে। প্রভাব তৈরি করতে পারাটাই হলো আশল কর্তব্য।
সেদিক বিবেচনায় সমকালীন কবিতার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। অর্থাৎ, পাঠক রুচিগতভাবে কোথায় অবস্থান করছেন, কবিতার উৎসারণ কোন দিকে* এইসব মৌন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়ানো।
২
বাংলাদেশে বাংলা কবিতার একটা পালাবদল ঘটে গেছে আশির দশকে। সে বদল ঘটে চলেছে এবং তা এমন অব্যবহিত যে তাকে দশকের বিভাজনে শনাক্ত করা মুশকিল। যেমন আশির দশকের অনেক কবিকে আমরা পাবো, যারা সত্তরের শববাহী, ছদ্মবেশী আঞ্জুমানে মফিদুল।
আবার যাদের কবিতা দিয়ে আমরা দিঙনির্ণয় করতে চাই, তার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ নব্বইয়ে। ঠিক একইভাবে নব্বই এসে ধরা দিলো শূন্যে। এখন প্রশ্ন হলো ‘শূন্য’ তার আয়ু না ফুরাতেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে কি না?
এর উত্তর দেয়াটা দুরূহ, অসম্ভব হয়তো নয়। কিন্তু তার আগে ফয়সালা করে নেয়া দরকার আশির দশকে কবিতার বাঁকবদলটা আশলে কেমন। পয়েন্ট আকারে কথাগুলো এভাবে সাজিয়ে নেয়া যায় :
১. প্রগল্ভতার বিরুদ্ধে বাকসংহতি
২. একরৈখিকতার পাল্টা বহুরৈখিকতা
৩. শ্লোগানভিত্তিক রাজনীতির বিপে মনন-নির্ভরতা
৪. অশ্র“-উদ্গত আবেগের পরিপন্থি ব্যাসকূট ও কটা
এছাড়া জয়ের শব্দ-জেল্লা ও জয়োল্লাস, উৎপলের উৎকেন্দ্রিকতা, বিনয়ের বীণ ও প্রবচনমুখীনতা, মৃদুলের ম্রিয়মাণ সন্ধ্যাভাষা* এসব অভিজ্ঞতা রাহমান-মাহমুদ-কাদরীর কাব্যভুবনকে অনেকখানি আচ্ছন্ন করেই জেগে উঠেছিল।
ভাষা-অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ রফিকের অনুপ্রেরণা কারো কারো উপর বর্তেছে বলে মনে হতে পারে। যারা চেয়েছিলেন কথ্যভঙ্গিকে আশ্রয় করে বাংলাদেশী কবিতা লিখতে। প্যারাডক্সিকাল মনে হতে পারে, তবু, তারা অনেকখানি হাংরি-প্রভাবিত। এর পাশাপাশি পশ্চিমের নানা শিল্প-অভিজ্ঞতা, বিশেষত পোস্টমডার্ন তত্ত্বের হুল্লোড় দেখা দেয় মধ্য-আশির পর থেকে। শুরু হয় কেন্দ্রের শাসনকে অস্বীকার করার প্রাণান্ত চেষ্টা।
রাজনীতির ক্ষেত্রে এর কোনো প্রণোদনাই জাগেনি বটে, কিন্তু সাহিত্যে একটা প্রভাব পড়ে বেশ জাঁকালো হয়েই। বিশেষত কবিতায়। যাকে বলে সেন্ট্রাল থিম ভেঙে ফেলার অভিযান। কেন্দ্রের শাসনকে ভাঙার লড়াই চলেছে আজও। এই ভাঙন দেখা দিয়েছে আঙ্গিক ও বিষয় উভয়ক্ষেত্রে।
ছন্দকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞাপূর্বক বাক্যস্পন্দকে সম্বল করে টানা গদ্যে কবিতা লেখা হচ্ছে। উঁকি দিচ্ছে গল্প বা গল্পের ছদ্মাভাস। নব্বইয়ের কবিরা যেমন আঙ্গিকের পুনরুত্থান ভেবেছিলেন পয়ার, ত্রিপদী কিংবা পুথির নানা বাহ্যরূপ অনুসরণের ভেতর, তা পূর্ণত অবসিত শূন্যের দশকে এসে। একেবারেই যে নেই তা কী করে বলি! আগেই বলেছি আঞ্জুমানে মফিদুলের কথা। শববহনের ঐতিহ্যিক দায়।
৩
তরলের অহঙ্কার বর্ণহীন হাজার বাহুকে মেলে ধরা
*মৃদুল দাশগুপ্ত
সব দিক থেকেই ননলিনিয়ার হয়ে উঠতে চাইছে কবিতা। কবিতার লিনিয়ারিটির ফাঁদ এড়াতে গিয়ে শূন্যের কবিরা প্রায়শই আশ্রয় নিয়েছেন ইমেজে। সে অর্থে ইমেজিস্ট কবিতার একটা নব-রূপায়ণ ঘটেছে। ইমেজগুলি সব ঐক্য-ভাবের সুতোয় গাঁথা নয়। কোলাজ ও কম্পোজিশন।
একই সঙ্গে কোরাস এবং ক্যাওস।
একে ঠিক ফ্রাগমেন্টেশান বলা যাবে না। একটি বিশেষ ভাবও ফ্রাগমেন্টেড হয়ে আসতে পারে। চূর্ণিত, খণ্ডিত হয়ে ধরা দিতে পারে, আবার অখণ্ডরূপেও তাকে পাওয়া সম্ভব। বরং ‘পলায়নী চিত্রভাষ্য’ রচনার একটা কৃৎকৌশল বলে মনে হয়।
অর্থাৎ একটি ভাবের প্রতিষ্ঠা হতে না হতে তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া। ফলে এমনকি বৈপরীত্যের সূচনা হতে পারে কবিতার মধ্যে বা প্রান্তে এসে।
‘প্রতিষ্ঠা হতে না দেয়া’ এবং ‘কিছুই প্রতিষ্ঠা না করা’র প্রবণতাকেই আমি ‘পলায়নী চিত্রভাষ্য’ বলতে চাইছি। এভাবে হয়তো বিশেষ একটা রূপের উন্মোচন ঘটে। স্বভাবতই সে রূপ স্থির নয়, তার অঙ্গ নাই, সে অনঙ্গ।
ণে ণে রূপের বিভ্রম জাগায়। তাকে সম্বোধন করি যা বলে, হয়তো সে তা নয়। প্রপঞ্চমাত্র। এবং ণিকের জন্য হলেও তা চেতনা-সঞ্চার করে।
শুনি ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে অতল জলের আহ্বান,
মন রয় না, রয় না, রয় না ঘরে, চঞ্চল প্রাণ।
মুহূর্তের সেই উদ্ভাসন এবং তন্মাত্র বিলয়* তবু কীভাবে সেই রূপ ধরা দেয়* তা বরং একটি কবিতা দিয়েই বলি :
অনঙ্গ রূপের দেশে
সুচ এক, সুতো ছাড়া, যুবতীর আঙুলে সে নাচে;
খেলে যায় ডুব-সাঁতারের খেলা* কাঁথার সমুদ্রে* সারাদিন।
পৃথিবীতে কিছু ফুটলো না ফুল, যদিওবা আঁকা হলো;
সেই হলো মজা,
বুঝলো না কেউ।
আমি সুতো, গুটলি পাকানো, কেবলই গড়িয়ে যাই*
যদিও জড়াতে চাই; পড়ি গিয়ে জলে। দেখি ঢেউ, অর্থহীন আদিম উল্লাস।
সে উল্লাসে নারীরা প্রহার ভোলে, পুরুষও ছলনা।
শিখার কবলে পড়ে তাই পুড়ে গ্যালো বায়ু, আগুনেরও আয়ু
ফুরালো কি হাওয়ার ছোবলে? শেষ হলো দাবানল...
কখন ডানার ভস্ম ছেয়ে যায় আকাশদুপুর
বিষণ্ণ ব্যাধের বুকে, চেয়ে দ্যাখো পাখি, বিঁধেছে কি ব্যাসকূট?
তুমি এসেছো হে মর্ম-পরিযায়ী, ধুপছায়াময়...
এর একটা রাজনৈতিক দিক তো আছেই। ইতিহাসের অনেক পুনরাবৃত্তির পর এই একুশ শতকে ধর্ম, দর্শন বা সমাজনীতির একটা ভঙ্গুর পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়েছি পুরনো শতাব্দীর কাতরতাসহ। কোনো কিছুরই ইউনিফায়েড অস্তিত্ব নাই আর। আমাদের চিন্তাপথের ধারে চারুবৃরে ভগ্নডাল যেমন পড়ে আছে, হা করে আছে খানাখন্দও। কাউকে অনুসরণ করে কোথাও পৌঁছুতে আজ আর মন সরে না।
এক বিষণœ উন্মার্গগামিতা, এক মধুর অর্থহীনতার সুর-যাপন ছাড়া কোনো বাক্যালাপ, কোনো প্রবচন নেই কারো জন্য। একটি ভাবনাকে উৎখাত করে দিচ্ছে আরেকটি ভাবনা এসে। কেউ যেন স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।
বোঝা যাচ্ছে, নৈরাজ্যের যে শৃঙ্খলা, তাকে আবিষ্কারের মন, আধুনিক যুক্তিসিদ্ধ মনের সঙ্গে একটা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে গোপনে গোপনে। সে লড়াইয়ের অসিলোগ্রাফ কেমন হবে আমরা জানি না, তবে ঐ নৈরাজ্যিক শৃঙ্খলার একটা ক্যালিডোস্কোপ তুলে ধরা যায় কি না দেখা যাক :
অনুসরণ
আমার ভেতর এক চতুষ্পদ অনুসরণ করছে তোমাকে আর তুমি অনুসরণ করছো বাঁশবনে হারিয়ে যাওয়া সেই সাপটিকে, ছোবল ভুলে যে তার বিষদাঁত ফেলে গেছে ইঁদুরের কালো গর্তে।
ইঁদুর যত্নে সাজিয়ে রেখেছে ঐ দাঁত। কত যত্নে তুলে রেখেছি আমিও মরে যাওয়া বৃরে শ্বাস, মাছের বুদ্বুদ, নিভে যাওয়া মোমের আলো।
প্রতীক্ষার ভেতর তাই জ্বলে নিঃসঙ্গ-মেরুন আওয়াজ সদ্য চেরাই-করা কাঠের মেহগনি গন্ধের মতো। ঐ কাঠের চেয়ারে বসে এখন বেশ ল করা যায় নদীর ঝিমুনি। এই নদী উত্তর দিক থেকে এসেছে, এসেছে দণি সমুদ্রের সন্ধানে।
ওদিকে ক্রমশ একটা সমুদ্র হ্রদ হতে হতে সরোবর হয়ে ঢুকে পড়েছে পাহাড়ের বুক পকেটে। যে পাহাড়ে বসে স্মৃতিভ্রষ্ট এক বুড়ো ভালুক প্রতিদিন ভোরবেলা করে রোলকল বনমোরগের দল ডেকে এনে। ভুলবশত একে নিসর্গের নান্দীপাঠ বলে মনে হয়; যেন নয় ছোট ছোট ঝোপের আড়ালে কারো বকাধ্বনি, ককাশব্দ। শব্দ ফুরিয়ে গেলে তাই কিছু কথা পড়ে থাকে বনের আধমরা ঘাসে শাদা সুতোর মতো। ঐ সুতো ধরে ধরে আমি এসে আজ দাঁড়িয়েছি তোমার পৈথানে তুঁত গাছের ছায়ায়...
শেষ কথাটা কবিতায় নেই, হয়তো তা এমন যে, ঐ ভাবনাসূত্র, কথাসূত্র বা চিহ্নসূত্র ধরে তুঁত গাছের ছায়ায় এসে ঠিকই দাঁড়িয়েছে পথিক, কিন্তু যার পৈথান বলে নির্দিষ্ট করতে চাইছে, আদৌ সেখানে সে নাই।
৪
একটি দশকের সমগ্র কাব্যকৃতি একটা বিশেষ দৃষ্টিতে বিচার করা সম্ভব নয়, সমীচীনও নয়। নানা দিক থেকে আলো ফেলার প্রয়োজন আছে। তবে খণ্ডিত হলেও, একটা নির্দিষ্ট এঙ্গেল থেকেই কথা বলতে আমি আগ্রহী। অন্য কথাগুলি অন্যেরা নিশ্চয়ই বলবেন। শূন্যের কবিতায় এই যে পারম্পর্যহীন, কখনোবা অভিসন্ধি* ও তাৎপর্যহীন চিত্রকল্পের সন্নিবেশ* তা আমাকে এই কথা ভাবতে প্ররোচিত করে যে, রূপের সন্ধানই করছেন তারা, মানে শূন্যের কবিরা।
রূপাবিষ্কারও বটে। ফলে তাদের কারূদ্ভাবনা সেই বিবেচনাতেই পর্যবেণ করা প্রয়োজন। আইডিয়া ইমপোজ করা নয়, আইডিয়া জেনারেট করা। ছিন্নভিন্ন, অসংস্থিত, অসংলগ্ন, সম্পর্করহিত, সামঞ্জস্যহীন, ব্যাখ্যানিরপে, সদাচঞ্চল, দ্রুত পরিবর্তনশীল একটা জগদ্ব্যাপার* দৃশ্যের সামনে দ্রষ্টার নীরব ও নিষ্ক্রিয় উপস্থিতিসমেত। স্বভাবতই দেখার ভেতর দিয়েই ভাবনার উৎপাদন।
রূপের আবির্ভাবেই দর্শনের প্রস্তাবনা। ফলে এখানে ভাব শাসিত হয় রূপের দ্বারা। ভাব ছিন্নও হয় একই পন্থায়। হয়তো আকার নিরাকৃতি পায়, রঙের ফোয়ারা নিরঙ হয়ে ওঠে। এমনকি কাঠের ফলকে ঘুণের অর থেকে তৈরি হয় ভাষা।
ধরা যাক, একটা প্রজাপতি, তার ডানার রঙ কাঁচা, যতবার যে ডানা মেলছে, বাতাসে লেগে যাচ্ছে নানা রঙের পোঁছ। যেভাবে শূন্যে প্লেনের ধোঁয়া, মেঘে সূর্যাস্ত ধরা পড়ে। কোঁচবিদ্ধ মাছ যেমন পালায় রক্ত ব্যাপন করতে করতে জলের শরীরে। সেই নানা রঙের স্তরীভূত বাতাসে দৃষ্টিভেদ করতে পারলেই তো সম্ভব প্রজাপতির উড্ডয়নপথের একটা গ্রাফ নেয়া। তখনই বোঝা যাবে সে কেমন বক্রজটিল।
ঐ রঙটুকুর সন্ধান করছেন শূন্যের কবিরা* এমনটা আমার মনে হয়। বিজলিসঘন এই রাতে, ভাদ্রের আকাশে, বাংলা কবিতার দিকে চেয়ে মনে হয় :
দেখা না দেখায় মেশা হে বিদ্যুৎ-লতা,
কাঁপাও ঝড়ের বুকে এ কি ব্যাকুলতা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।