আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এশিয়ান হাইওয়ে: মানচিত্র কথা বলে

ও আমার দেশের মাটি... তোমার পরে .... মাথা।
এশিয়ান হাইওয়ের উদ্দেশ্য কি? ইউনাইটেড নেশনস্‌ ইকোনমিক এন্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া এন্ড দি প্যাসিফিক (ESCAP) এর বর্ণনা অনূসারে এশিয়ান হাইওয়ের মূল উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে ১. রাজধানী থেকে রাজধানীর যোগাযোগ স্থাপন (Capital to Capital links), ২. প্রধান প্রধান কৃষি ও শিল্পভিত্তিক শহরগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন, ৩. প্রধান প্রধান সমূদ্র ও নদীবন্দরগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন, ৪. প্রধান প্রধান কনটেইনার টার্মিনাল ও ডিপোগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন এবং ৫. প্রধান প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন। বাংলাদেশের বর্তমান পারিপার্শিক অবস্থা বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন হাইওয়ের মাধ্যমে ভারতের সাথে সংযুক্ত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সীমান্ত বর্ডার সমূহ হচ্ছে বেনাপোল (যা যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কে সংযুক্ত করে), সোনামসজিদ সীমান্ত (চাঁপাই নাবাবগঞ্জ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কে সংযুক্ত করে), হিলি (যা দিনাজপুর দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কে সংযুক্ত করে), তামাবিল ও জকিগঞ্জ (যা সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যকে সংযুক্ত করে), আখাউড়া (যা কুমিল্লা দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা কে সংযুক্ত করে)। এছাড়াও আরো অসংখ্য সীমান্ত দিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বানিজ্যিক যোগাযোগ রয়েছে।

প্রতিদিন এইসব সীমান্ত বর্ডার দিয়ে অসংখ্য ভারতীয় পন্য বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে অতি অল্প পরিমান পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান অনূযায়ী যে পরিমান ভারতীয় পন্য বাংলাদেশে আমদানি হয়ে থাকে ভারতের বিভিন্ন শর্তাবলী আরোপের কারনে বাংলাদেশ তার দশভাগের একভাগও মালামাল ভারতে রপ্তানী করতে পারেনা। বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়ের সাথে যুক্ত হলে সহজেই ভারত, চীন (কুনমিং শহর), মিয়ানমার(বার্মা), থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার সাথে যুক্ত হতে পারবে যা কিনা বাংলাদেশের সাথে এইসব দেশগুলোর ব্যাবসা বৃদ্ধিতে অত্যন্ত সহায়ক হবে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিভিন্ন হাইওয়ের দ্বারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত সেহেতু নতুন করে এশিয়ান হাইওয়ের দ্বারা ভারতের কাছ থেকে বানিজ্যিকভাবে অতিরিক্ত লাভবান হবার কোন সম্ভাবনা নাই। বিষয়টি নিম্নে মানচিত্র দেখলে সহজেই পরিস্কার হওয়া যায়।

এখানে আরেকটু পরিস্কার করে বলা দরকার যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত যেসব পন্য চট্টগ্রাম সমূদ্রবন্দরে খালাস হয়ে থাকে তার কিছুটা অংশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে (Seven sister states) সরাবরাহ করে বাংলাদেশ ভারতের সাথে কিছুটা বানিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করে। ভারত প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েতে বাংলাদেশের ক্ষতি কি কি? ১। চীনের কুনমিং কিংবা দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পৌছানোর জন্য প্রথমে মিয়ানমারের একটি নির্ধারিত স্থানে যেতে হবে যেখান থেকে কুনমিং, রেঙ্গুন, থাইল্যান্ড, হ্যানয়(ভিয়েতনাম), সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া যাবার বিভিন্ন পথ ভাগ হয়ে গেছে। ভারত প্রস্তাবিত রূট অনুযায়ী এই নির্ধারিত স্থানে যেতে হলে প্রথমে আমাদের ঢাকা বা চট্টোগ্রাম থেকে সিলেট হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্য তারপর যথাক্রমে আসাম, নাগাল্যান্ড ও মনিপূর রাজ্য পার হয়ে মিয়ানমারের উত্তরের বিশাল পাহাড়ি এলাকা পার হয়ে পৌঁছাতে অতিরিক্ত এক হাজার কিলোমিটারের বেশী পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হবে। এক কথায় বাংলাদেশের যে কোন মালবাহী যানকে অতিরিক্ত দুই দিনের বেশী ভ্রমণ করতে হবে (ছবি নং ২ দেখুন)।

অথচ চট্টগ্রাম হয়ে মিয়ানমারেএকই স্থানে পৌঁছাতে মাত্র ৩০ মাইল পথই যেখানে যথেষ্ট। নিচের মানচিত্রগুলো লক্ষ্য করুণ (ছবি - ১, ২ ও ৩): ছবিঃ-১ ছবিঃ ২, ৩ ২। উপরে বর্নিত কারণে অতিরিক্ত পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়া কোনভাবেই লাভজনক না হওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে চীন কিংবা অন্যান্য দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর সাথে ব্যবসা-বানিজ্য কোনভাবেই সম্ভব হবেনা। উপরন্তু ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে যাতায়াত সহজ হওয়ায় ভারত সহজেই এইসব দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বানিজ্য বৃদ্ধি করতে পারবে অর্থাৎ এইসব অঞ্চলে ভারত এককভাবে বানিজ্য নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। এইক্ষেত্রে ভারতকে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হবেনা।

৩। উপরে বর্নিত একই কারণে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমূদ্র বন্দরের চাহিদা কমে যাবে, বাংলাদেশ যেটুকু পন্য ভারতে সরাবরাহ করে তা কমে যাওয়ায় দেশের জিডিপি কমে যাবে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশ আরো গরীব রাষ্ট্রে পরিনত হবে। ৪। ভারত প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে দ্বারা বাংলাদেশ সংযুক্ত হলে ভারতীয় পন্য সহজেই পশ্চিমবঙ্গ-যশোর-সিলেট রুট ব্যবহার করে সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে যেতে পারবে যার ফলে এইসব রাজ্যে বাংলাদেশী পন্যের আর কোন প্রয়োজন হবেনা।

৫। বাংলাদেশে আরো সহজে (পশ্চিমবঙ্গ এবং সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো থেকে) ভারতীয় পন্যে সয়লাব করে দেয়া সম্ভব হবে। আমাদের কেন চট্টগ্রাম হয়ে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়া জরুরীঃ ১। চট্টগ্রামের সাথে মিয়ানমারের মধ্যে দিয়ে এশিয়ান হাইওয়েতে বাংলাদেশ সংযুক্ত হলে মিয়ানমারের একই স্থানে পৌঁছাতে আমাদের মাত্র ৩০ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে যেখান থেকে সহজেই চীনের কুনমিং, রেঙ্গুন, হ্যানয়, থাইল্য্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া যাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত হাজার কিলোমিটারের বেশী পথ পাড়ি দেবার প্রয়োজন হবেনা।

২। বাংলাদেশ এই হাইওয়ে দ্বারা সহজেই ভারত, নেপাল, ভুটান ও সিকিমের সাথে সংযুক্ত হতে পারবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশকে নেপালে যেতে ভারতের মধ্য দিয়ে মাত্র ৪০ মাইলেরও কম ট্রানজিট প্রয়োজন। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি পাবে কারণ বহির্বিশ্ব থেকে আগত মালামাল সহজেই চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে নেপাল বা ভুটানে এমনকি ভারতেও সরাবরাহ করা সহজ হবে। ৩।

বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই আরো সমৃদ্ধ হবে এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যার সৃষ্টি হবেনা। ৪। ভারত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পন্য আমদানি করে আরো লাভবান হতে পারবে। ভারত সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর জন্য কি করতে পারে ? ১। ভারত সহজেই উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয় সীমান্ত এলাকায় মাত্র ১০০ মাইলেরও কম রাস্তা নির্মাণ করে এশিয়ান হাইওয়েতে সংযুক্ত হয়ে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে পারে।

এক্ষেত্রে ভারতের জন্য নেপাল, ভুটান ও সিকিমের যোগাযোগ আরও সহজ হবে। ২। ভারত সহজেই হিমাচল প্রদেশের উত্তর দিয়ে চীনের সাথে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হতে পারে। এছারা ভারত আসাম-মেঘালয়-মনিপুর-মিয়ানমার রুট ব্যাবহার করে সহজেই চীনের কুনমিং কিংবা দক্ষিন-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সাথে বানিজ্য বৃদ্ধি করতে পারে। সাধারণ জিজ্ঞাসা উপরে উল্লেখিত মাণচিত্রটি ঠিকভাবে লক্ষ্য করে থাকলে বা সেখান থেকে পুরো ধারণা পেয়ে থাকলে যে কোন বাংলাদেশী নাগরিকের মনে নীচের কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারেঃ ১।

ভারত প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হলে বাংলাদেশের আদৌ কোন লাভ আছে কি? কেউ কি একটি মাত্র দৃষ্টান্ত দিতে পারবেন? ২। অনেকে হয়তো বলবেন ভারতীয় যানবাহন বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করতে দিলে সেখান থেকে বাংলাদেশ টোল আদায়ের মাধ্যমে কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারবে। কিন্ত সঠিকভাবে হিসাব করলে সহজেই বোঝা যায় যে কিছু টোলের টাকা আদায় করতে গিয়ে আমরা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যেটুকু পন্য রপ্তানী করে থাকি সেটা একেবারেই হারিয়ে ফেলবো। হারানো রপ্তানীর পরিমান কি এই টোলের অর্থের চেয়ে কয়েকশো গুন বেশী নয়? ৩। ভারত প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে কি শুধুমাত্র ভারতের লাভের জন্য নয়? ৪।

আমরা কেন চট্টোগ্রাম থেকে মাত্র ৩০ মাইল রাস্তা তৈরী করে মিয়ানমারের নির্দিষ্ট স্থানে সংযোগ স্থাপন করতে পারিনা? ভারত প্রস্তাবিত এই রুটটি কি বাংলাদেশের জন্য ESCAP প্রস্তাবিত পাঁচটি উদ্দেশ্যের যে কোন একটির মধ্যে পড়ে? চট্টগ্রাম হয়ে মাত্র ৩০ মাইল রাস্তার সংযোগ দিলে সেটা কি বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য ESCAP এর সবগুলোই উদ্দেশ্য পূরণ করেনা? ৫। অনেকে বলে থাকেন, এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত না হলে বাংলাদেশ ইউরোপের সাথে সড়কযোগে সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইউরোপের সাথে কি বাংলাদেশ পূর্ব সীমান্ত নাকি পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে যুক্ত হবে? এখানে সিলেট সীমান্ত (পূর্ব সীমান্ত) দিয়ে যুক্ত হবার প্রস্তাব কি হাস্যকর নয়? আসুন, আমরা জুজুর ভয় না দেখিয়ে বা না দেখে বরং কোন্‌ পন্থায় বাংলাদেশের উন্নতি হবার সম্ভাবনা আছে সেই দিকটা চিন্তা করি। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক (WB) বা এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (ADB) যেসব উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা ভারত প্রস্তাবিত পথে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হবার জন্য তদবির করছেন বা বাংলাদেশেকে পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁদেরকে অনুরোধ করি, বাংলাদেশ ছোট দেশ বলে একে উপেক্ষা করে শুধু ভারত নির্দেশিত পথের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে বাংলাদেশের সুবিধা-অসুবিধাটা একটু দেখুন আর উন্মুক্ত গোল টেবিলে একসঙ্গে বসে জনগনকে একটি মাত্র উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে যান যে আপনারা যেভাবে ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তাতে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবে? আর বাংলাদেশীরা যারা অনেকেই না বুঝে এর পক্ষে কথা বলছেন, তাদেরকেও অনুরোধ, কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের হীন চক্রান্তে পা না দিয়ে, গাছে কাঁঠাল আর গোফে তেলের মতো টোলের টাকার স্বপ্নে বিভোর না থেকে বরং বাংলাদেশ কিভাবে নিজের পায়ে দাড়াতে পারে তার স্বপ্ন দেখান। দেশবাসী আপনাদেরকে চিরদিনের জন্য স্মরণ করবে।

উপরের মানচিত্রে লাল বৃত্ত দ্বারা ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো (মেঘালয়, আসাম, অরুনাচল,নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা) দেখানো হয়েছে । Data source: Click This Link Click This Link Click This Link লেখকঃ গোলাম আহমেদ তুহিন, আমেরিকায় হোন্ডা মোটর কোম্পানীর রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে কর্মরত একজন উর্ধতন প্রকৌশলী ও কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ এবং আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স ও সোসাইটি অব অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার্স এর সদস্য ও একজন ফ্রি ল্যান্স জার্নালিস্ট। ইমেইলঃ লেখাটা( Click This Link )এইখানে পাইলাম তাই শেয়ার করলাম।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.