জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই
আমার এক বন্ধু দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা । কয়েক দিন আগে খুব আফসোস করল। সে বলল, ভারতীয় পোশাকের চাকচিক্যে মার্কেটগুলি ঢাকা পড়ে গেছে। বিগত সময়ে যেখানে দেশীয় পোশাক বিক্রি হত আশি ভাগ আর বিদেশী পোশাক বিক্রি হয়েছে বিশ ভাগ। সেই চিত্র এখন উল্টো।
প্রায় শতভাগই এখন ভারতীয় পোশাক বিক্রি হচ্ছে। মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের প্রধান দুটি উৎসব ঈদুল-ফিতর এবং দূর্গাপূজা। এই দুটি উৎসবে পোশাক বিক্রি হয় অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। ধনী-গরীব সবাই যার যার সাধ্যমত কম-বেশি পোশাক ক্রয় করে থাকে। এই সময়ের অপেক্ষায় সারা বছর দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারকগণ বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক তৈরী করে থাকেন।
বিশেষ করে দেশীয় বুটিক হাউজগুলি রীতিমত গবেষণা করে থাকে। এবার ভারতীয় পোশাকের আগ্রাসনে তাদের কপালে হাত পড়েছে।
যে কারণে ভারতীয় পোশাক আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু :
০১) ভারতীয় চ্যানেলগুলি সারা বছর যে ড্রামা সিরিয়াল দেখাচ্ছে তাতে পোশাকের প্রচার অনেকটা হয়ে যায়। এতে করে বার বার দেখা জিনিষগুলি মানুষের মনে গেঁথে থাকে। এমনকি ক্রেতাদের উপর অবচেতনে এর প্রভাবও পরে।
মহিলারা সারা বছর বিভিন্ন ভারতীয় চ্যানেলে যে সব পোশাক দেখেছেন তা এখন তার হাতের নাগালে পেয়েছেন। প্রতিটি পোশাকের সাথে রয়েছে ভারতীয় নামীদামী তারকাদের ঐ পোশাক পরিহিত ছবি।
শাড়ি, থ্রি-পিস,বেবী স্যূট, শার্ট এমনকি এবার পাঞ্জাবীতে মার্কেটগুলি ভরে গেছে। একেক পোশাকের একেক বাহারী নাম। মাছাক্কালি, দিল্লি সিক্স, সানিয়া মির্জা, ক্যাটরিনা ইত্যাদি নানা নামে দোকানীরা ক্রেতাদের দেখাচ্ছে।
পূর্বে দেখা গেছে পাঞ্জাবীর বাজার অন্তত অন্যকোণ দেশের ছিল না। এবার পাঞ্জাবির বাজারেও থাবা বসিয়েছে ভারতীয় পণ্য। তাই তো মাছাক্কালি প্রেমের জ্বরে কাঁপছে বাংলাদেশ।
০২) কিছু বৈধ-অবৈধ আমদানীকারক তারা দোকানগুলিতে বিভিন্ন পোশাক বাকিতে দিয়ে গেছেন। বিক্রি করে টাকা দিতে হবে।
বিক্রি না হলে তারা সে সব পোশাক ফেরৎ নিয়ে যাবে। দোকানদারদের কাছে এটা একটা ভালো সুযোগ। তাই তারা নগদে ক্রয় করে দেশী পোশাক বিক্রির কোনরূপ ঝুঁকি নিচ্ছে না।
এক সেলসম্যানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম - আপনারা কার কাছ থেকে এইসব পোশাক পাচ্ছেন?
তিনি এর সঠিক উত্তর না দিয়ে বললেন, আমাদের কাছে তাদের কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর নেই।
০৩) মজার ব্যাপার হল, ভারতীয় পোশাকের বাহারি নাম হলে এগুলো তেমন টিকসই নয়।
কেবল চাকচিক্যে ভরা। দামও আকাশচুম্বী। অন্য দিকে দেশীয় পোশাকের দাম সেই তুলনায় সস্তা। অথচ ক্রেতাটা দেশীয় পোশাকের চেয়ে ভারতীয় পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে বেশি।
০৪) ভারতীয় পোশাকের ব্যবসা যারা করেন, তারা একটা মাল বৈধ রাখলে তার পাশাপাশি তিনটা মাল চোরাই রাখেন।
এর ফলে ভারতীয় পোশাকের ব্যবসায় লাভ আর লাভ। অন্য দিকে দেশ হারাচ্ছে আমদানী কর এবং বৈদেশিক মুদ্রা। এই হল আমাদের দেশ প্রেমের নমুনা।
আমাদের যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে :
আমার বন্ধু জানায়, চাহিদা মোতাবেক তাদের প্রতি বছরই প্রডাক্টশন বৃদ্ধি করতে হয়। এবারও তারা করেছিলেন।
কিন্তু এমনটি হবে জানলে এই বছর প্রডাক্টশন বৃদ্ধি করতেন না। এখন এর প্রভাব শুধু হাউজগুলোর উপরেই না পরবর্তিতে তাঁতীদের উপরেও পড়বে। যেমন তারা শীঘ্রই কাজের অর্ডার পাবে না। গত কয়েক বছর আশাতীতভাবে দেশীয় পোশাক শিল্পের বিকাশ ঘটে চলেছে। বলা চলে রীতিমত জোয়ার চলছে।
এবারের এই ধস সামনে দেশীয় পোশাকের বিকাশে বড় রকমের বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। বিদেশী পোশাকে যদি বাজার সয়লাব হয়ে যায় তাহলে দেশীয় পোশাক শিল্পের জন্য মারাত্মক হুমকি।
শেষ কথা :
আমরা কথায় কথায় ভারত বিরোধিতা করি। কথায় কথায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমরা কত বার ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছি।
কিন্তু ভারতীয় পোশাক গায়ে চড়িয়ে এই বর্জনের ডাক হাস্যকর একটা ব্যাপার।
দেশের প্রতি প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব আছে। দেশের পণ্যের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। দেশীয় শিল্পের বিকাশে সরকারের পাশাপাশি ক্রেতাদেরও দায়িত্ব আছে। ক্রেতা না কিনলে দেশীয় শিল্পের বাজার কখনও সৃষ্টি হবে না।
ফলে আমরা চিরকালই বিদেশী পণ্যের বাজার থেকে যাব। ভারতীয় ও চীনা পণ্যে আমাদের বাজার সয়লাব হওয়ার কারণ ক্রেতা হিসেবে আমাদের বিদেশপ্রীতি। দাম বেশি দিয়ে হলেও আমরা কম মানের বিদেশী পণ্যই কিনি। অথচ সস্তা ও টেকসই যেই দেশি পণ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার দিকে ফিরেও তাকাই না। ক্রেতার এই আচরণ হলে আমাদের দেশীয় শিল্পের বিকাশ কোন দিনও হবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।