আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণতন্ত্রের চর্চা : দুই (মনোনয়নের মহড়া)

করণিক: আখতার২৩৯

গণতন্ত্রের চর্চা : দুই (মনোনয়নের মহড়া) বসো, বসো হে, -এখনো তুমি ‘প্রতিনিধি’ হিসেবে নির্বাচিত হওনি কিম্বা জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে উদ্ধার পেতে হবে, এমন কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে আসোনি তুমি, -আমরা আমাদের স্বার্থেই তোমাকে ডেকে এনেছি এখানে। তুমি তো আমাদেরই সন্তান, সামাজিক কর্মকাণ্ডে আমাদের অন্যান্য সকল সভ্য ভদ্র সন্তানদের মতোই তোমার আচার আচরণ। আমরা তোমাকে পেয়ে কতখানি গর্বিত, তুমি তা’ জানো না। ভিখারির জোড়হাত মাথানোয়ানো তোমার ঐ দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে আমরাই লজ্জা পাচ্ছি। ওভাবে দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না, কাছে এসে বসো।

আমরা, এদেশের জনসাধারণের একাংশ, একজনকে প্রতিনিধি বানিয়ে আমাদের সংসদে পাঠাবো আর সেজন্যেই তোমাকে মনোনীত ক’রে এই জনসমাবেশে ডেকে এনেছি। তোমার জীবিকায়, ব্যক্তিগত পেশার ক্ষেত্রে, যে-পরিমাণ ক্ষতি হবে ভাবছো, আনুমানিক একটা হিসেব কষে আমরা তার পাঁচগুণ তোমাকে দেবো, প্রতিনিধিত্বের মেয়াদশেষে তুমি চাও তো আগের পেশায় সমন্বিত স্তরে ফিরে যেতে পারবে। আশা করি, আমাদের প্রস্তাব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে তোমার কোনো আপত্তি থাকবে না। ভয় পেয়ো না। তোমার সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো দায়িত্বভার আমরা তোমার উপর চাপাবো না।

তুমি আমাদের কেবল মুখপাত্র হবে। যতক্ষণ তুমি আমাদের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বে থাকবে, ভুলে যেয়ো না যে, তুমি কোনো ব্যক্তির প্রতিনিধি নও; কিম্বা ভুলে যেয়ো না যে, আমরা কোনো দলোপ্রতিনিধিও নির্বাচন করি না, জোটপ্রতিনিধিও নির্বাচন করি না। জনসাধারণ আমরা নির্বাচন ক’রে তোমাকে কখনো সরকারের বিশাল ক্ষমতার আসনটা পেতে দেই না। আমাদের জাতীয় সংসদে সাজিয়ে রাখা আসনগুলো দেখবে তুমি, দায়িত্ব পালনের আসনগুলো, মনে রেখো, ওগুলোর কোনোটাই ‘সরকারের আসন’ নয়। জনগণের পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধিদের জন্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঐ আসনগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

‘প্রতিনিধির আসন’কে ‘সরকারের আসন’ ভেবে, অজ্ঞ বা মূর্খের মতো কোনো উদ্ধত আচরণ তুমি কখনো দেখাবে না, এমন বিশ্বাস এবং আস্থা তোমার উপর রাখতে পারবো বুঝেই সমন্বিত আমরা প্রতিনিধি নির্বাচনে তোমাকে মনোনীত করেছি। গণতন্ত্রে, জনসাধারণ আমরা জনপ্রতিনিধির নির্বাচক। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভাবনায় আচরণে গণসমষ্টিকে রাষ্ট্রের ‘শাসকের আসনে’ মেনে নিয়ে ভয় পেতে পারে, তারা আমাদেরকে নির্বাচক মালিক মনে করে মর্যাদা দিতে পারে। নির্বাচিত হ’লে তুমি আমাদেরকে ‘মালিকের আসনে’ অথবা ‘শাসকের আসনে’ কিম্বা দু’টোর জায়গায় তোমার চেতনায় একটা বিশাল আসনে বসাবে কি-না, নির্বাচনের আগেই জেনে নিতাম, তবে, তোমার কাছে আমরা এজন্যেই তা’ জানতে চাইবো না যে, তোমার আচরণে আমরা কোনো উগ্রতা দেখিনি। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে মালিকানা, অভিভাবকত্ব এবং শাসকের ক্ষমতা, যে আসনটা থেকে প্রকাশ পায়, সেটা ‘সরকারের আসন’।

রাজা ঐ আসনটা পায় রাজতন্ত্রে, দলীয় জোট বা দলোগণের দখলে ঐ আসনটাই চ’লে যায় দলতন্ত্রে। জনগণ সুযোগ দিলে অস্ত্রের জোরে সরকারের আসনে কোনো স্বেচ্ছাচারী তার লেজুড়-পাছা গেড়ে সর্বাধিকারী সেজে বসার চেষ্টা করে যে তন্ত্রে, সেটা স্বৈরতন্ত্র। জনসাধারণ কখনো কখনো তন্দ্রার ঘোরে আক্রান্ত হ’তে পারে, তবে, কখনোই নিদ্রাচ্ছন্ন হয় না, জনগণ সদাজাগ্রত। স্মরণে রেখো, প্রতিনিধির আসন শূন্য থাকতে পারে, গণতন্ত্রে, সরকারের আসনটা জনগণের, -সাধারণ গণসমষ্টির ঐ আসনটা কখনোই শূন্য হয় না। ‘সরকারের প্রতিনিধি নেই’-এর অর্থ ‘সরকার নেই’ মনে করে অজ্ঞরা।

রাষ্ট্রের জাতীয় সরকারের আসনটা, আকারে-আকৃতিতে বর্ণে-বৈচিত্রে দৈর্ঘে-প্রস্থে-উচ্চতায়, রাষ্ট্রের জল-স্থল-আকাশ সীমার সমান, -কখনোই শূন্য হয় না। সমষ্টির কাছে খণ্ডাংশের যেকোনো ধরনের বকেয়া পাওনা, বর্তমান দাবি, আগাম প্রত্যাশা আছে এবং আগামীতেও থাকবে। স্থান-কাল-সাপেক্ষ জাগতিক বাস্তবতায় যেহেতু কোনো খণ্ডাংশ সরাসরি সমষ্টির নাগাল পায় না, মাধ্যমরূপে কাউকে রাখতেই হয়, তাই, সমষ্টির পক্ষ থেকে আমরা জনসাধারণ যথারীতি আমাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করি। জনপ্রতিনিধির আসনে তোমাকে যতক্ষণ রাখবো আমরা, তোমার কর্মকাণ্ডে তোমার কোনো ব্যক্তিস্বার্থ, গৃহস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ বা জোটীয় স্বার্থের টান বা প্রভাব আমরা দেখতে চাই না, -এতটুকু মনে রেখো। জ্ঞানপাপী দুরাত্মারা তোমার মঙ্গলকামী সেজে তোমাকে ঘিরে থাকবে।

তাদের পেতে রাখা লোভের ফাঁদে ফেলে তোমাকে তাদের ক্রীতদাস বানানোর জন্যে চূড়ান্ত চেষ্টা চালাবে। তবে, তুমি স্বেচ্ছায় তোমার নিরাপত্তা প্রাচীরের বাইরে না-গেলে তোমার উপর তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। অভিশপ্ত দুরাত্মা তোমাকে অপকর্মের হাতিয়ার বানিয়ে তার নিজের কাজে ব্যবহার করতে চাইবে। তারা চাইবে, তুমি যেন ‘প্রতিনিধিত্ব’কে ‘মালিকানা’ আর ‘দায়িত্ব’কে ‘ক্ষমতা’ ভাবো। দুরাত্মাকে ‘অভিভাবকের আসনে’ বসালে তুমি নিজেই বিপদে পড়বে।

জ্ঞানপাপীরা তোমাকে তাদের গ্রন্থের জ্ঞান দেবার চেষ্টা চালাবে, তুমি নিয়ো না। তাদের অভিধানে তুমি দেখবে, -‘জনসাধারণ’ অর্থ অজ্ঞ নির্বোধ প্রজা, ভদ্রতার অর্থ দুর্বলতা, আক্রমন অর্থ আত্মরক্ষা, চাকর মানে প্রশাসক বা কর্তা, মুক্ত আলোচনার অর্থ কারো আড়ালে তার দোষ ঘাঁটাঘাঁটি করা, -ইত্যাদি, ইত্যাদি। ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটা কখন কিভাবে এলো, এ নিয়ে একটুখানি ভাবলেই তুমি অনেকাংশেই আধিপত্যকামীদেরকে চিনে ফেলবে। রাষ্ট্রের সরকারকে নিজের মালিকানাধীনে নেবার চেষ্টা কোরো না। ‘দায়িত্ব’কে কখনো ‘ক্ষমতা’ মনে কোরো না।

প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনকালে তোমার কোনো কথায় বা আচরণে কেউ যেন কখনোই সমষ্টিকে খণ্ডাংশের অধীনস্ত মনে না-করে। ক্ষমতাধারী আমরা রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সমন্বিত ভালোটাকে লক্ষ্যে রেখে এগিয়ে যেতে চাই। নিজের আবেগকে মনিবের আসনটি পেতে দিয়ে কোনো স্বৈরাচারী যদি এমন আশা করে যে, ঐ মিথ্যাচারী মনিব তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে, -তার বিবেচনাবোধকে আমরা কখনো সমর্থন দেই না, ঘৃণা করি। আমাদের ঘৃণ্যের স্পর্শ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে তোমাকে দেখেছি আমরা, আর তাইতো আমাদের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা তোমার আছে ভেবে, আমরা তোমাকেই মনোনীত করেছি। দুরাত্মার-ক্রীতদাসত্বে-লিপ্ত-কোনো-স্বেচ্ছাচারী বিপদে পড়লে তুমি নিজেও যেমন তার জামিনদার হ’তে চাইবে না, আমরাও যেমন কোনো স্বেচ্ছাচারীর জামিনদার হ’তে পারি না, -তেমনি অন্যেরাও যদি আমাদের মতো অক্ষমতা দেখাতে চায়, তারাও যদি অত্যাচারীর জামিনদার হ’তে না-চায়, বিপদাক্রান্ত স্বৈরাচারীর কাছ থেকে দূরে স’রে গিয়ে আত্মরক্ষা করে, -তাদেরকে নির্দয় মনে হ’লেও আমরা তো তাদেরকে ঘৃণা করতে পারি না।

এমনিতেও, তুমি তোমার অজ্ঞতা অথবা অনিচ্ছাকৃত অসাবধানতার কারণে মহাবিপদে পড়তে পারো, ভয় পেয়ো না, জনসাধারণ তোমাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করবে। তুমি তো জানোই যে, প্রকৃত ক্ষমতাধারী কখনো প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা প্রদর্শন করে না। আমাদের নীরবতাকে অক্ষমতা ভেবে ভুল কোরো না। সংসদে তুমি মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হ’লে, সাধারণ জ্ঞানে সমকালীন পরিবেশকে লক্ষ্যে রেখে জনস্বার্থে বাস্তবসম্মত আইন বা নিয়মশৃঙ্খলা উদ্ভাবন ক’রে যথাযথভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে। যদি কোথাও আটকে যাও তো ভয় পেয়ো না, সরাসরি জনসমাবেশে ছুটে এসো।

তোমার যোগ্য অভিভাবক আমরাই তোমাকে পথ দেখাবো। ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে মালিক ক্ষমা করে। প্রতিনিধির স্বার্থে নয়, বরং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ক্ষমতার স্বার্থেই গণমালিক তার প্রতিনিধিকে রক্ষা করবে। এরই মধ্যে আমরা তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে বিনীত দাবি পেশ ক’রে তোমাকে চেয়ে নিয়েছি। আমাদের প্রস্তাবে তুমি নির্দ্বিধায় রাজি হ’য়ে আমাদের প্রত্যাশাকে নীরবে ধন্য করবে, সেই লক্ষ্যেই আজকের এই গণসমাবেশ।

... রঙ্গপুর : -১০/১১/০৮ করণিক : আখতার হারাটিয়া।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।