কত সম্ভাবনাই না লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের কত জায়গায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাগুলো (ইপিজেড) আলোকিত হয়েছে দেশি-বিদেশি
বিনিয়োগকারীদের বদান্যতায়। এসব স্থানে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকের। আবার বিনিয়োগকারীরাও বড় লাভের মুখ দেখছেন সস্তা শ্রম কিনতে পেরে। এসব ইপিজেডে শিল্পপ্লট পাওয়া থেকে শুরু করে নামমাত্র ভাড়ার সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে যোগাযোগ কিংবা গ্যাসপ্রাপ্তির মতো সমস্যা।
এ সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে নিশ্চিতভাবেই গর্ব করা যাবে ইপিজেডগুলোকে নিয়ে। এগুলোর সুবিধা, সম্ভাবনা আর সমস্যা নিয়ে লিখেছেন কুমিল্লা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মোল্লা, পাবনা প্রতিনিধি এস এ আসাদ ও নীলফামারী প্রতিনিধি আবদুল বারী-
পণ্য নিয়ে বিদেশ খুশি :
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে পদ্মার তীর ঘেঁষে পাকশী মৌজায় প্রায় ৩০৮.৯৭ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে ঈশ্বরদী ইপিজেড। ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু হয়ে এটি উদ্বোধন হয় ২০০১ সালে। স্বল্প মূল্যে শ্রমিক সুবিধা, রেল ও সড়ক যোগাযোগ এবং কৃষিপ্রধান এলাকা হওয়ায় ঈশ্বরদী ইপিজেড রয়েছে বিনিয়োগকারীদের অন্যতম পছন্দের তালিকায়। আর এখানকার পণ্য আমদানি করে খুশি বাইরের দেশগুলো।
এদিকে পরিবেশগত সর্বোচ্চ মান আর জ্বালানি কম খরচ করায় সম্প্রতি মার্কিন সংস্থা ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) লিড সনদ পেয়েছে ঈশ্বরদী ইপিজেডের একটি কারখানা। সংস্থাটি এ পর্যন্ত পৃথিবীর তিনটি পোশাক কারখানাকে লিড সনদের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্লাটিনাম প্রদান করেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বিশ্বসেরা কারখানার স্থান দখল করেছে বাংলাদেশের ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড। ঈশ্বরদী ইপিজেডে দেশি-বিদেশি মিলে পুরোপুরি উৎপাদনে আছে ১৩টি প্রতিষ্ঠান। এখানকার উৎপাদিত পণ্য ইতোমধ্যে সক্ষম হয়েছে ভোক্তাসাধারণের সন্তুষ্টি অর্জনে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে জাপানের তিনটি, দক্ষিণ কোরিয়ার দুটি, ভারতের দুটি, চীনের দুটি, মার্শাল আইল্যান্ডের একটি, অস্ট্রেলিয়ার একটি ও বাংলাদেশের দুটি। এ ছাড়া রয়েছে বাংলাদেশি মালিকানাধীন ১৭টি কোম্পানির বিনিয়োগ। কারখানাগুলোতে ব্যাটারি, সোয়েটার, প্রক্রিয়াজাত প্লাস্টিক অ্যাগলোমারেট, টেঙ্টাইল কেমিক্যাল, প্লেইন পলি, রেডিমেড গার্মেন্ট, মেটাল আইটেম, ইলেকট্রনিক পণ্য, ক্রাফট, হেয়ার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লোবস, জুট রিলেটেড প্রোডাক্টস, গার্মেন্ট এঙ্সেরিজ, তেল ও অন্যান্য বায়োকেমিক্যাল পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে এখানে। এ ছাড়া আরও ১৬টি কারখানা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইপিজেডে ২৯০টি প্লটের মধ্যে খালি আছে স্বল্পসংখ্যক।
এখানকার উৎপাদিত শতভাগ পণ্যই রপ্তানি হয়ে থাকে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আর এ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে যাদের অবদান, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ছয় হাজার ৭১। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ইপিজেড রপ্তানি করেছে ১৩৮.৫৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরে ৩০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৪১.৫৩ মিলিয়ন। বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে শিল্পপ্লট ও কারখানা ভবনের ভাড়া ধরা হয়েছে অনান্য ইপিজেডের তুলনায় অর্ধেক।
দক্ষ শ্রমিক যাতে সহজেই পাওয়া যায়, এ জন্য ডরমেটরি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। ঈশ্বরদী ইপিজেডে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন ও পরিত্যক্ত বিমানবন্দর চালুর বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিনিয়োগকারী ও বেপজা কর্তৃপক্ষ। বিমানবন্দরটি চালু হলে এখানে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়বে বলে শিল্পোদ্যোক্তারা মনে করছেন। উৎপাদনমুখী শিল্পগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে বলে জানিয়েছে বেপজা কর্তৃপক্ষ। ঈশ্বরদী ইপিজেড একটি সম্ভাবনাময় এঙ্পোর্ট জোন।
এ জোনকে টিকিয়ে রাখতে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে_ এমনটাই মনে করেন মালিক, শ্রমিক ও বেপজা কর্তৃপক্ষ।
কর্মসংস্থান হবে ১৫ হাজার মানুষের : কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) নতুন উৎপাদনে যাচ্ছে আরও নয়টি কারখানা। বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এতে কর্মসংস্থান হবে ১৫ হাজার শ্রমিকের। কুমিল্লা ইপিজেড সূত্র জানায়, এখানে নতুন বিনিয়োগ করা ৯টি দেশি, বিদেশি ও যৌথ মালিকানার কারখানাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাকিস্তানের সুরটি টেঙ্টাইল বিডি।
কারখানাটি এখানে বিনিয়োগ করবে ৫০০ কোটি টাকা। এখানে কর্মসংস্থান হবে পাঁচ হাজার মানুষের।
নতুন উৎপাদনে যাওয়া নয়টি কারখানা হচ্ছে চীনের মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেঙ্টাইল অ্যান্ড কেমিক্যাল পাইবার ইন্ডাস্ট্রি, জাপানের খেলনা তৈরি কারখানা হাসি টাইগার কোম্পানি লিমিটেড, জাপানের ক্যাট গার্মেন্ট, যুক্তরাজ্য ও চীনের যৌথ মালিকানাধীন ফ্যাশন হেয়ারের সামগ্রী তুংহিং লিমিটেড, শ্রীলঙ্কার ওয়েস্টার্ন পেপার ইন্ডাস্ট্রিজ, পাকিস্তানের সুরটি টেঙ্টাইল বিডি, তুরস্কের স্টার কার্পেট লিমিটেড, তুরস্ক ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানাধীন টিএনএস গার্মেন্ট এবং বাংলাদেশি ওয়াসিস স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড।
সূত্র জানায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে কুমিল্লা ইপিজেডের অবস্থান হওয়ায় এখানে রয়েছে পণ্য পরিবহনে বাড়তি সুবিধা। আর এ কারণে দিন দিন বিনিয়োগ বাড়ছে কুমিল্লা ইপিজেডে।
১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ ২৬৭ দশমিক ৪৬ একর জায়গা নিয়ে শুরু হয় কুমিল্লা ইপিজেডের যাত্রা। এখানে প্লট রয়েছে ২৩৮টি। এর মধ্যে ২৩৫টি বরাদ্দের চুক্তি হয়েছে। বাকি তিনটি প্লটে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। বেপজা কুমিল্লার মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুস সোবহান বলেন, এখানকার ইপিজেডে কর্মরত আছেন ২০ হাজার শ্রমিক।
নতুন নয়টি কারখানা চালু হলে এখানে কাজের সুযোগ পাবেন আরও ১৫ হাজার শ্রমিক। কর্মসংস্থান হবে জেলার বেকার ও স্বল্পশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের। ইপিজেডের কারণে ইতোমধ্যে আশপাশের এলাকাসহ জেলায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে।
পছন্দের তালিকায় উত্তরা ইপিজেড : উত্তরের জেলা নীলফামারীর সোনারায় ইউনিয়নে প্রায় ২১৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উত্তরা ইপিজেড। ১৯৯৬ সালে শুরু হয়ে এর কাজ শেষ হয় ২০০১ সালের ১ জুলাই।
স্বল্প মূল্যে শ্রমিক, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিমান ও স্থলবন্দরের সুবিধা থাকায় বিনিয়োগকারীদের অন্যতম পছন্দের তালিকায় রয়েছে উত্তরা ইপিজেড। এখানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে উৎপাদনে আছে ১১টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে_ নদার্ন পলি ইন্ডাস্ট্রিজ, কেপি ইন্টারন্যাশনাল, কোয়েস্ট অ্যাকসেসরিজ, সানফ্লাওয়ার অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, কাপরিক ইলেকট্রনিঙ্, এভারগ্রিন লিমিটেড, উত্তরা সোয়েটার, ওয়াসিস ট্রান্সকম, দিয়াজ স্পিনিং অ্যান্ড নিটিং, এসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং অ্যাকুই ইন্টারন্যাশনাল। এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখান থেকে রপ্তানি হয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সামগ্রী, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। উন্নত পরিবেশ ও বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক হওয়ায় উৎপাদনে আসার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে দেশি-বিদেশি আরও ১০টি কারখানা।
ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বলছে, চীন ও ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য উত্তরা ইপিজেড পরিণত হতে পারে উপযুক্ত স্থানে। শুরুতে এখানে হংকংভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে চীনারা বিনিয়োগ করেন। উত্তরা সোয়েটার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে চীনাদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের শ্রমিকরা উৎপাদন করছেন উন্নত মানের সোয়েটার। একইভাবে পরচুলা তৈরি করছে আরও একটি চীনা কোম্পানি। উত্তরা ইপিজেডে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ৩৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের হলদিবাড়ীর সঙ্গে চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু, সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হলে উত্তরা ইপিজেডে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বলছে, উত্তরা ইপিজেডে সব ধরনের সুবিধাই দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগকারীদের। উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্পপ্লট ও কারখানা ভবনের ভাড়া কমানো হয়েছে ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে উন্নত মানের তিন তারকার একটি হোটেল। নীলফামারীর সোনারায় ইউনিয়নে ২১৩.৬৬ একর জায়গা নিয়ে স্থাপিত হয় উত্তরা ইপিজেড। দুই হাজার ৪০০ শ্রমিক নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও এখানে কর্মরত আছেন সাড়ে আট হাজার শ্রমিক।
২০২টি প্লটের মধ্যে ১৩১টি দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে। এদিকে বেশ কিছু সুবিধা থাকলেও অসুবিধা থেকে একেবারে মুক্ত নয় এই ইপিজেড। গ্যাস না থাকায় এখানে ওয়াশিং প্লান্ট করতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। এ কারণে প্যাকেজিংয়ের আগেই নিটিংয়ের জন্য আনফিনিশড প্রডাক্টগুলো নিতে হচ্ছে চট্টগ্রামে। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।
অথচ ইপিজেড থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে এবং ৩৮ কিলোমিটার দূরের চিলাহাটিকে স্থলবন্দরে রূপ দেওয়া গেলে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে। ইপিজেড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি একটি সম্ভাবনাময় এঙ্পোর্ট জোন। এর সঙ্গে রেলের উভয় লাইন মিঙ্ড গেজের সংযোগ হলে যোগাযোগ সহজ হবে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে। এসব সুবিধা নিশ্চিত হলে বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেড়ে একটি বড় ইপিজেডে পরিণত হবে এই ইপিজেড। পাশাপাশি উত্তরা ইপিজেডে জায়গা সম্প্রসারণেরও প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।