"আমি দিশেহারা এক পথিক ; পথ হারিয়ে-ই যেন পথ খুজে পাই..."
ঘটনাঃ১
ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছি রিক্সায় করে। সেগুন বাগিচার নাট্যশালার রাস্তা ধরে জহিরুল ইসলাম সাহেবের বিশাল ইস্টার্ন এর ফ্লাট পার হয়ে ডানে মোড় নিয়েছি, শান্তিনগর দিকে যাবো। লক্ষ্য করলাম বিশালাকার সরকারি ভবনটির (নামটি মনে পড়ছে না। জ়ীবনে এতবার ওটার সামনে দিয়ে গিয়েছি কিন্তু নামটা লক্ষ্য করে মনে রাখার প্রয়োজন মনে হয়নি আজকের আগে কখনও) পাশের রাস্তার বীপরিতে যে রেস্তরাটি আছে তার দেয়াল ঘেঁষে আশ্রয় নিয়েছে একটি উদবাস্তু পরিবার। আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা আবর্জনার মত তাদের সেই সংসার দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এখানে তাদের খুব বেশি সময় হয়নি।
চলন্ত রিক্সায় বসে হঠাৎ খেয়াল করলাম ঐ পরিবারের মা তার ২-৩ বছরের কন্যা শিশুকে আদর করে মাথা আচঁড়িয়ে পুরাতন একটি ক্লিপ মাথায় পরিয়ে দিলেন। তারপর আবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখলেন। তার চোখের দ্যুতি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে মনে মনে মেয়েটিকে দেখে বলছিলেন “বাহ খুব সুন্দর লাগছে তো তোকে ”। তারপর সেই জীর্ণ পুরাতন ক্লিপটি মাথার একপাশ থেকে অন্য পাশে লাগিয়ে আবারও বিমুগ্ধ নয়নে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। কে জানে এবার হয়ত মনে মনে ভাবলেন “বাহ! এভাবেও তো তোকে বেশ লাগছে...”।
তার সেই কন্যা শিশুটি কিছু বুঝল কিনা যানি না কিন্তু আমার মনে কেন জানি ঘটনাটি বেশ দাগ কাটল।
রাস্তার পাশের ঐ মহিলাও একজন মা- তারও রয়েছে তার সন্তানকে নিয়ে সপ্ন দেখবার। নতুন জামা আর বাহারি ক্লিপ কিনে দিয়ে নিজের মেয়েকে সাজিয়ে পরিতৃপ্তির হাসি হাসার। কত অল্পেই তারা খুশি- একটি পুরাতন ক্লিপ, ছিন্ন একটি পিরান আর চোখ ভর্তি পরিতৃপ্তির দ্যুতি। আমি এত উচুঁ দালানের উপরে গান শুনতে শুনতে ফ্যানের নিচে আরাম করে বসে ব্লগ লিখেও কত-ই না কারনে-অকারনে দুখি।
আর ঐ মা কত অল্পেই খুশি; আর আমি/আমরা...??
ঘটনাঃ২
যথারীতি রিক্সায়। যাচ্ছি ভার্সিটিতে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের সামনে সিগনালে রিক্সা আটকে আছে। সেই সময়ে অবশ্য ভিক্ষুক সম্প্রদায় বেশ সক্রিয় থাকে। রিক্সায় উঠলে আমি নাকি ভাবুক হয়ে যাই- এটা আমাকে অনেকেই বলেছে তাই ইদানিং কিছুটা সচেতনভাবেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি।
যাহোক, সচেতনভাবেই হোক আর অচেতনভাবেই হোক হঠৎ দেখলাম একটি কাঁক(পাখি) আহত হয়ে রাস্তায় পড়ল। কাঁকপক্ষিটি উড়বার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রাস্তার ওপাশ থেকে ৪-৫ বছর বয়সি একটি ছেলে উৎসাহের অতিশয্যে দৌড়িয়ে রাস্তা পার হয়ে আমার রিক্সার অদূরে পড়ে থাকা কাঁকপক্ষিটিকে তুলে নিল হাতে। রাস্তার ওপাশে তার আরও কয়জন খেলার সাথি তার গতিবিধি লক্ষ্য করছে। আমি মনে মনে বললাম বাছা কাঁক পড়েছো মোগলের হাতে।
ভাবলাম প্রথমে এর পায়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা হবে এরপর শুরু হবে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট; যতক্ষণ না ঐ বালকের আন্তরিক পরিতৃপ্তির সুম্পূর্ণতা পাচ্ছে অথবা কাঁকপক্ষি নিজেই নিজের পলাবার পথ খুঁজে না নিচ্ছে। সাধারনত কাঁক কে আমরা পাখি হিসেবে মেনে নিতে পারি না। দেখতে কুৎসিত তার উপর গলার স্বর একেবারেই সুমিষ্ট না। কিন্তু আমার চিন্তা-ভাবনাকে একেবারে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সেই বিস্ময় বালক পাখিটাকে আদর করে হাতে তুলে নিল যেন এ কোন এক হিরামন পাখি। হাত বুলিয়ে আদর করে দিল কয়েকবার।
আমি সম্ভবত কাঁকপক্ষিকে এভাবে আদর করতে কাউকে দেখি নি। কাঁকপক্ষিটি তখনও উড়বার শক্তি লাভ করেনি। সে-ও বিস্ময় বালকের আদর পেয়ে মনে হল যেন পোষ মেনে গেল। এবার বিস্ময় বালক সজতনে ঐ কাঁকপক্ষিটিকে ডিভাইডারের গাছের উপর একটি ডালে রেখে দিল । কয়েক সেকেন্ড- তারপর আবার উড়ে গেল কাঁকপক্ষিটি আকাশের উদ্দেশ্যে।
ততক্ষনে সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে, রিক্সা চলতে শুরু করেছে, দেখলাম বালকটি আবার ফিরে যাচ্ছে রাস্তার ওপাশে তার খেলার সাথিদের কাছে।
নাহ! এই ছেলেটির তো এরকম করবার কথা ছিল না। তার তো বয়সি সঙ্গি-সাথিদের নিয়ে আর কাঁকপক্ষিটিকে নিয়ে অন্যরকম কিছু করবার কথা ছিল। ছেলেটি পাখিকে পাখির মত করে ট্রিট করেছে- কাক আর হিরামন-এর মধ্যে সে কোনো পার্থক্য করে নি। হয়ত সেই কাঁকপক্ষিটির আঘাত এতটা গুরুতর ছিল না, হয়ত সেটির কারো সহায়তারও দরকার ছিল না, হয়ত সেই বালকের হাতে কোন আশ্চর্য ক্ষমতাও ছিল না, তুবও সেই ছেলেটি সাহায্য করেছে যতটুকু তার সাধ্যের মধ্যে ছিল সবটুকু দিয়ে।
হয়ত সে আর্থিকভাবে দরিদ্র হতে পারে কিন্তু মনের দিক থেকে সে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছল। তার পিতা/মাতা হয়ত ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে কিন্তু ঐ ছেলেটির এই যে মানসিকতার পরিচয় সেদিন আমি পেলাম তা ক’জনের মধ্যে রয়েছে?
আমাদের মধ্যে কেউ সমস্যায় পড়লে কি আমরা এগিয়ে যাই? আমারা কি সবাইকে সমান করে দেখতে পারি? আমি তো মনে হয় পারি না বাকিদের টা জানি না।
‘অগ্নিশিখা’ নামের একটি গানের কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে; সম্ভবতঃ এরকম- “আমরা সবাই আগুনের শিখা জ্বালাবো আগুন গড়ব নিশানা...নতুন দিন নতুন প্রান্তে জন্মের শেষ চিৎকার, ভেঙ্গে যাবে সব দেয়াল ছিটকে পড়বে অহংকার...”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।