আমি সেই দিন হব শান্ত. . .
ঢাকা শহরে বাসে চলাচল বিভীষিকা হয়ে উঠেছে। লোকাল বাস তো বটেই টিকেট কেটে যেসব বাসে উঠতে হয় সেগুলোর অবস্থাও বহুদিন ধরেই খুব খারাপ। জ্যাম আর বাসের স্বল্পতার কারণে এসব বাসে যাতায়াতকারী প্রত্যেক যাত্রীরই জীবন ওষ্ঠাগত হয়। সকালে অফিসে আসা বা কোন কাজে যেতে হলেই যে কথাগুলো মনে হয় তা হলো, 'আজ সময়মত বাস পাব তো', 'বাসে উঠতে পারবো তে', 'সময় মতো পৌছতে পারব তে', ইত্যাদি। মহিলাদের জন্য তো বাসে ওঠা আরো কঠিন।
মোটের ওপর সকলের জন্যই (যারা এসব বাসে যাতায়াত করি) অফিস টাইমে বা ঘরে ফেরার সময় বাসে ওঠাটা বেশ হয়রানিমূলক।
এসবের মধ্যেই একেক বাসের যাত্রীদের ব্যবহার, চরিত্র একেক রকম। টিকেট কেটে ওঠা বাস আর লোকাল বাসে ভীড়, ঠেলাঠেলি, ইত্যাদি একরকম হলেও বাসের ভিতরের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। বলাই বাহুল্য, এই পার্থক্য অবশ্যই শ্রেণীগত।
টিকেট সিস্টেমের বাসগুলো যাত্রীরা বেশ সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবেই বাসে ওঠার চেষ্টা থাকে।
তবে বাসের অবস্থা ভেদে এই শৃঙ্খলার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। অন্যদিকে, লোকাল বাসে লাইন বলতে কিছু নেই। আগলে পারলে, আগে পাবেন ভিত্তিতে বাসে উঠতে হয়। তাই বাস আসলে হুড়োহুড়িটা লোকাল বাসের ক্ষেত্রে একটু বেশিই হয়। তাই টিকেট সিস্টেমে লোকালের চেয়ে ভাড়াও অনেক বেশী।
লোকাল বাসের একটা বিষয় ভালো টিকেট বাসের চেয়ে। টিকেট সিস্টেমের বাসে লোকজন সাধারণত লাইনে দাঁড়িয়ে ১০/১৫ (বা তারও বেশী) মিনিট অপেক্ষা করে বাসে উঠে। এই বাসগুলোতে বাসের দরজায় যত ভীড়ই থাকুক না কেন, এমনকি গেটের হ্যান্ডেলে লোকজন ঝুলে থাকলেও, বাসের মাঝামাঝি (টু-ডোরের ক্ষেত্রে) বা মাঝ হতে পেছন পর্যন্ত (ওয়ান ডোরের ক্ষেত্রে) মানুষের ঘনত্ব বেশ হাল্কা থাকে এবং মানুষজন সামনের দিকের তুলনায় বেশ আয়েশেই দাঁড়িয়ে থাকে বলতে হয়। সামনে থেকে বা বাসের সামনের লাইন থেকে যতই ভিতরের লোকজনকে একটু চেপে দাঁড়াতে বলা হোক না কেন কেউই তাতে কর্ণপাত করেন না। হয়ত সামান্য নড়েচড়ে দাঁড়ালেও, নিজে দাঁড়িয়ে আরকজনকে জায়গা করে দেওয়ার অভ্যাসটা আমাদের একেবারেই নেই।
যে ব্যক্তি কিছুক্ষণ আগে হ্যান্ডেলে ঝুলছিলেন, বাসের ভেতরে এসে তিনি তা বেমালুম ভুলে যান এবং তিনিও তার চিৎকার (ভাই একটু চেপে দাঁড়ান) শুনতে পান না। যাত্রীরা আবার ভদ্রসমাজে বসবাসকারী হওয়ায় হেলপার বা কাউন্টারম্যান ধমক দেওয়ার সাহস দেখায় না, বরং অনুরোধ করে চেপে দাঁড়াতে বলে। কিন্তু যাত্রীরা তা খুব একটা পাত্তা দেই না। যার ফলে, অনেক সময় বাসে দু'একজন বেশি উঠতে পারলেও যাত্রীদের অসহযোগিতামূলক অন্যদিকে, লোকাল বাসও সংখ্যায় অপর্যাপ্ত। ফলে ভীড়, অপেক্ষা, অনিশ্চয়তা সবই বেশী।
কিন্তু লোকাল বাসে দরজা এবং ভেতরের ভীড় সমান। কেউই ঝুলে আর কেউ কিঞ্চিত আরামে যেতে দেখা যায় না। একজন বাসে উঠলে তাকে যথাসম্ভব চেপে দাঁড়াতে হয় যাতে আরেকজন উঠতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কন্ডাক্টারদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কারণ তারা লোকাল বাসের যাত্রীদেরকে ধমক দিয়ে চেপে দাঁড়াতে বলতে পারে।
এই পার্থক্যটা মূলত এই দুই ধরনের বাসে যাতায়াতকারী যাত্রীদের শ্রেণীগত পার্থক্যের মধেই নিহিত। সাধারণত, টিকেট সিস্টেমের বাসে মধ্যবিত্ত (ক্ষুদে বুর্জোয়া) শ্রেণীর মানুষের আধিক্য। এই শ্রেণী বরাবরই স্বার্থপর হয়। এর কারণ হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থা কর্তৃক তাদের মধ্যে সামষ্টিক চর্চার পরিবর্তে ব্যক্তি চর্চা গড়ে তোলা। আবার এই শ্রেণী যে ধরনের উৎপাদন কর্মকান্ডের মাধ্যমে জীবীকা নির্বাহ করে তা অনেক বেশি ব্যক্তিনির্ভর বা ব্যক্তিনির্ভর হিসেবে দেখানো হয়।
তাই ব্যক্তি চর্চা এই শ্রেণীর অভ্যস্ততায় পরিণত হওয়ার ফলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর প্রতিফলন পাওয়া যায়। অন্যদিকে, লোকাল বাসের অভ্যন্তরের মানুষগুলোর মধ্যে নিম্নবিত্ত (প্রলেতারিয়েত)-এর আধিক্য বেশি। এদের উৎপাদন কর্মকান্ড সামষ্টিকতার ওপর নির্ভরশীল। যেমন, এসেম্বলি উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন পণ্য এককভাবে কোন শ্রমিক উৎপাদন করে না। একটি পণ্য উৎপাদনে অনেক শ্রমিকের শ্রম প্রযুক্ত থাকে।
আবার একজনের কাজ আরকজনের কাজকে প্রভাবিত করে। উৎপাদন কর্মকান্ডের এই অভ্যাসই তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি হিসেবে গড়ে ওঠে। তাই প্রলেতারিয়েত শ্রেণী ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী অপেক্ষা অনেক বেশি সুশৃঙ্খল এবং সামষ্টিক। এর প্রতিফলন আমরা আমাদের যাতায়াতের পথ কিংবা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখতে পাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।