সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
ফাদার মারিনো রিগন বিশ্বে বাংলার দূত
"যখন অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে আছি এবং তার সুখের ও দুঃখের সঙ্গে মিলিত হয়েছি, যখন ভাষা আন্দোলন চলছিল তখন থেকে বাংলা সাহিত্যের প্রতি আমার ভালবাসা জেগে উঠেছে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সহভাগী হয়ে, আমার জীবন পণ করে জনসাধারনকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলাম; সে জন্য আমার ভালবাসা কেবলই বাংলাদেশের সাহিত্যের এবং সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত নয়; আমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত। এ অনুবাদ কোন গর্ব করতে চায় না, পারেও না, কেবলই বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতি আমার ভক্তির শ্রদ্ধাঞ্জলী তুলে দিলাম"।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের দশম বর্ষপূর্তিতে নির্বাচিত কিছু কবিতা ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ফাদার মারিনো রিগন। সেই সংকলনের ভূমিকায় ওপরের কথাগুলো লেখেন।
তিনি বাংলাদেশে এসেছেন সেই ১৯৫৩ সালে।
বয়স তখন ২৭। উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম প্রচার। প্রথমেই দায়িত্ব নিয়ে গেলেন মংলা বন্দরের উপকন্ঠে শেলাবুনিয়ায়। সেখানে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার পরিচয় ঘটছিল বাংলার গ্রামীন জনপদের সাথে। দেখে নিচ্ছিলেন দরিদ্র মানষের জীবন।
কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, কলেরায় শত শত মানুষের মৃত্যু। আয়ত্তে আনছিলেন বাংলা ভাষাটাকে।
বাংলার সাহিত্য দর্শনঃ
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "পন্ডিত মশায়" ছিল ফাদার রিগনের পড়া প্রথম বাংলা বই। পড়ে তিনি অভিভূত। এরপর তার হাতে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলী।
এ বই পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। শুরুতেই শুধুই রবীন্দ্রনাথ পড়তেন। পরে জসীমউদ্দিন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নজরুল। বাংলার সাহিত্য তাকে মোহিত করে। তিনি ঠিক করেন তার কাজের পাশাপাশি অনুবাদ করবেন এসব লেখা।
ইতালিয়ান ভাষায় প্রকাশের জন্য প্রথমে বেছে নিলেন গীতাঞ্জলী। তারপর প্রকাশের জন্যে ১৯৬১ সালে গেলেন দেশে।
ইতালিতে বাংলার দূতঃ
ইতালিতে এক প্রকাশক ফাদার রিগনকে কথা দিয়েছিলেন তার গীতাঞ্জলী অনুবাদ প্রকাশ করবেন। হঠাৎ করে সেই প্রকাশক মারা যাওয়াতে ফাদার বিপাকে পড়লেন। তিনি গিয়ে সেই প্রকাশকের স্ত্রী সিকিমা ওয়াংদাকে ধরলেন।
স্ত্রী সে বই প্রকাশ করতে রাজি না। তার ধারনা এ বই বিক্রি হবে না। ফাদার বললেন, আমি যার লেখা অনুবাদ করেছি আপনি সেই লেখা একটু শুনুন। এই বলে ফাদার পড়তে শুরু করলেন। প্রথমটা শুনেই প্রকাশকের স্ত্রী বললেন, আরেকটি শোনান।
তারপর আরেকটি। ফাদারের মতই এই প্রকাশকের স্ত্রীও রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়লেন। ১৯৬৪ সালে ইতালীতে প্রকাশিত হলো গীতাঞ্জলী। এ পর্যন্ত গীতাঞ্জলীর ৬টি সংস্করণ বেরিয়েছে। এরপর একে এক রবীন্দ্রনাথের ২৬টি বই অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ফাদার।
শুধু যে রবীন্দ্রনাথ তা নয় শরৎচন্দ্রের ১টি, জসীমউদ্দিনের ৩টি। এছাড়াও রয়েছে কবিতা সংকলন। অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে প্রায় ৫০টির মত বই। এসব বইয়ের কোন কোনটি ফরাসি, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষাতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন তিনি।
সাহিত্য চর্চাটা ছিল তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা।
কিন্তু মানুষের জন্যে কাজ করার ক্ষেত্রে তার অবদান কম নয়। মংলা বন্দরের উপকন্ঠে শেলাবুনিয়াকে কেন্দ্র করে তিনি যা করেছেন তা রূপকথাকেও হার মানায়।
শেলাবুনিয়ার রূপকথাঃ
মংলার উপকন্ঠে শেলাবুনিয়া একটি ধর্মপল্লী। সেই ধর্মপল্লীকে কেন্দ্র করে ফাদার মারিনো রিগন শুরু করেছিলেন তার কর্মযজ্ঞ।
১৯৫৭ সালে চালু করেন সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ের।
এখন এ বিদ্যালয় দক্ষিণবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় স্কুলগুলোর একটি। এর সাথে সাথে গড়ে তুলেছেন ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল, শিল্প ও নাটক শিক্ষালয়, সেন্ট পলস হাসপাতাল, রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র ও সেলাই কেন্দ্র। সেলাই কেন্দ্রের কথা বলতে গিয়ে ফাদার খানিকটা উত্তেজিত। বলছিলেন, সেলাই কেন্দ্রটি ১৯৮২ সালে চালু হওয়ার পর সেখানকার কর্মীদের ও যারা শিখছিল তাদের কাজ দেয়ার ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল না। আমরা তখন ঢাকায় সুরাইয়া রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
তার তত্বাবধানে আমরা নানা ধরনের সূচিশিল্পের কাজের পাশাপাশি নকশী কাঁথা তৈরি করি। পরে সেসব নকশী কাঁথা নিয়ে ইতালিতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করি। প্রথম প্রদর্শনীটি হয় ১৯৮৬ সালের ২-১০ সেপ্টেম্বর ইতালির ভিসেনজা শহরের "মনতে ন্ডি পিয়েত্রা হলে"। এ প্রদর্শনীর পর আমরা ব্যাপক সাড়া পাই। এখানকার সেলাই কেন্দ্রের মেয়েদের একটি নিয়মিত উপার্জনের ব্যবস্থা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে ভেনিসে, ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে রোমে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এছাড়া বাংলার নকশী কাঁথা নিয়ে কয়েকটি প্রকাশনাও করা হয়। যা ইতালির মানুষকে নকশীকাঁথার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে।
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডঃ
১৯৯১ সাল থেকে ফাদার মারিনো রিগন তার ভাই-বোন ও শুভানুধ্যায়ীরা মিলে ইতালিতে দান্তে ও টেগোর ডে পালন করা শুরু করেন। যা এখন পর্যন্ত নিয়মিতভাবে পালিত হয়ে আসছে।
এছাড়াও ফাদারের উদ্যোগে ১৯৮৬ সালের ২০ নভেম্বর ইতালিতে আন্তর্জাতিক শিশু সঙ্গীত প্রতিযোগতায় অংশ নেয় বাংলাদেশের শিল্পী অরিন হক। সেই প্রতিযোগিতায় অরিন ১ম স্থান অধিকার করে।
১৯৮৭তে ইতালির ফোরেন্স, ফায়েঞ্জা, চেরনুসকো, মিলান, ভেনিস ও ভিসেঞ্জাতে জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ অবলম্বনে নৃত্যনাট্যের দল নিয়ে সফর করেন। যা দেখে ইতালির দর্শকরা অভিভূত। এছাড়া পরপর দুইবার তিনি শামীম আরা নিপার নেতৃত্বে নাচের দল পাঠান।
ইতালির মানুষ হয়েও ফাদার মারিনো রিগন হয়ে উঠেছিলেন মনে প্রাণে বাঙালী। এসব উদ্যোগ তারই প্রকাশ।
উপরের বর্ননাগুলো ফাদার মারিনো রিগনের বিশাল কর্মযজ্ঞের খন্ডিত অংশ। তার ৮০ বছরের জীবনে ৫৩ বছর কাটিয়ে দিলেন এই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল শেলাবুনিয়ায়। বাংলার ভাষা, বাংলার মানুষ, এদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারন করেই বেড়ে উঠেছেন তিনি।
বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে পরিচয় করিয়েছেন নানা দেশে। শুধু তাই নয় এদেশের মানুষের উন্নতির জন্যেও কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন আগুপিছু না ভেবেই। এত বছর বাংলাদেশে থাকার পরও তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন।
অবশ্য তা নিয়ে আক্ষেপ নেই তার। নাগরিকত্ব তো আনুষ্ঠানিকতা। যিনি কাজ করেন তার আনুষ্ঠানিকতার যে প্রয়োজন হয় না - তার উদাহরন তো তিনি নিজেই।
তাকে জানাই শুভেচ্ছা। প্রার্থনা করি তার দীর্ঘ জীবনের।
( ফাদার মারিনো রিগন ২০০৪ সালে জাহান আরা মেমোরিয়াল অরফ্যানেজ ট্রাস্ট'র কার্যক্রম দেখতে এলে এই মহান ব্যক্তির সাথে আমার আলাপচারিতা প্রসঙ্গে এই লেখাটা দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।