তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়
প্রাক স্কুল পর্যায়েই আমি টের পেয়ে যাই আমি আশে-পাশের সবার চাইতে বোকা। আমাদের বাড়িতে কিছু আত্মীয় থাকত, আমার চাইতে বয়সে বড়। তারা তখন অনেকে স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবার দু তিন জন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য। একেক জনের জ্ঞান দেখে আমি অভিভূত হয়ে যেতাম।
ফলে যা হয়, তাই হলো। বাংলা অক্ষরজ্ঞানের আগেই পরিবারে আরবী কয়েকটি সুরা মুখস্থ করার এবং কোরান পড়া শুরু করার রেওয়াজ ছিল। আমি দেখলাম কোন সুরা আমার মনে থাকে না। এত চমৎকার সুরেলা ছন্দবদ্ধ আয়াতগুলো আমি ওলট-পালট করে ফেলি। বহু কষ্টে ফাতেহা শেষ হলো, এবং আলিফ লাম মীমের পরে লা রাইবা ফীহে পর্যন্ত।
তার পরে আমি বেঁকে বসলাম। বললাম, আবার পরে চেষ্টা করব।
অন্যদিকে আমার বড় বোন আমাকে যে সব বাংলা নন্সেন্স রাইম বা ছড়া মুখে মুখে শেখাত, সেগুলো দু বার শুনলেই আয়ত্ত হয়ে যেত। আমি যে একেবারে গাধা নই, মা আর বোন এটা আত্মীয়দের কাছে প্রমাণ করতে বার বার ছড়াগুলো শোনাতে বলত। ফলে আমি আবৃত্তিতেও পারদর্শী হয়ে উঠলাম।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেও দেখলাম, শিক্ষকবৃন্দ আমার চেহারা মুবারক দেখেই বুদ্ধি ও সম্ভাবনা টের পেয়েছেন। অনেক দিনই নামতা না পারার জন্য বা শ্রুতি লিখনে বেশী দেরী করার জন্য দাঁড় করিয়ে রাখত; তার পরে পরীক্ষার ফলাফল দেখে নিজেরাই অবিশ্বাসে মাথা দোলাত। পরীক্ষার সময় আমার সুবিধা ছিল যে থেমে থেমে ভেবে চিন্তে উত্তর লেখা যায়। এটা মৌখিকের মত কন্ট্যাক্ট স্পোর্টস ছিল না, ফলে ভয় পেতাম না।
যদিও আজীবন শহরবাসী, একবার আমার বাবা রাজনৈতিক কারণে পুরো পরিবারকে গ্রামের বাড়ীতে রেখে আসতে বাধ্য হন।
আমার কি আনন্দ। স্কুলের শিক্ষকদের খুশী করার আর বালাই নেই। চাচাতো ভাইদের সাথে গ্রামের দু ধারে দুই হাটে গিয়ে সপ্তাহে মোট চার দিন মজা করে চা খাই আর বিভিন্ন রকম মানুষ দেখি। বাকি দিন গুলোও চাচাত ভাইদের সাথে অফুরন্ত আড্ডা। শুধু মনটা একটু দমে যেত যখন সবাই বাবার ছাত্রজীবনের প্রশংসা করত।
মনে হতো বলতে চাইছে, আমি তাঁর একমাত্র ছেলেটি তাঁর সম্মান রাখতে পারব না। আমার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে।
এই ধারণার সঙ্গত কারণ ছিল। আমার চাচাতো বা দূর সম্পর্কিত বোনেরা আমাদের বাড়িতেই আমাদের মাস্টার সাহেবের কাছে কোরান পড়তে আসত। দেখা গেল আমার চাইতে অনেক ছোটগুলোও দুবার কোরান শেষ করে ফেলেছে।
কিন্তু আমি লা রাইবা ফীহে পার হতে পারছি না। মাস্টার সাহেব দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়তেন, আর আমার সেই বোনেরা খিক খিক করে হাসত।
এই মাস্টার সাহেব অনেক গুণী ছিলেন। তাঁর কাছে অনেক দূর থেকে অনেকে অঙ্ক শিখতেও আসত। আরবীতে আমার উন্নতির আশা ছেড়ে দিয়ে তিনি অংক ধরলেন।
অংক জিনিসটা যে কত কঠিন সেটা বোঝাতে আমাকে এক দিন গসাগু আর লসাগু ব্যাখ্যা করলেন। এই সব জিনিস আমি আগে কখনো দেখি না। ভয় পেলাম। তিনি আমাকে একটা বেশ জটিল অংক দিয়ে বাজারে গেলেন, বললেন ফিরে এসে আবার বসবেন।
আমার মাথায় গসাগু আর লসাগুর সংজ্ঞা পরিষ্কার হতেই এক ঘন্টা লেগে গেল।
তিনি অংক দিয়েছেন, নিয়ম বলে যান নি; এসে বলবেন। আমি অনেক কষ্টে একেবারে ফার্স্ট প্রিন্সিপল থেকে অংকটা করার চেষ্টা করলাম।
ফিরে এসে তিনি বললেন খাতা আনো, আবার দেখাই। আমি বললাম , ওটা তো আমি শেষ করে ফেলেছি। তিনি চোখ গোল করে খাতা চাইলেন।
আমার অভিনব পদ্ধতি কিছুই বুঝলেন না। কিন্তু উত্তর তো ঠিক! বললেন, কে করে দিয়েছে? বললাম, আমিই করেছি। কিভাবে? আমি আমার পদ্ধতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি নিয়মে করতে অভ্যস্ত, সংজ্ঞা ব্যবহার করে নতুন কায়দায় নয়। অনেক বার আমার মুখ থেকে এ কথা আদায় করার চেষ্টা করলেন, কে আমাকে সাহায্য করেছে। তারপরে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন।
শেষে যে কথাটা বললেন সেটা আমাকে বহুদিন প্রেরনা দিয়েছে - বাবা, মনে হয় তোমাকে আমি অংক শেখাতে পারব না। তুমি এ বিষয়টা আমার চাইতে ভালো বোঝ।
এটা তাঁর বিনয় ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু একটি শিশুর মনে এ ধরণের কথা যে কত উৎসাহ যোগায়, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক তা জানেন না।
আমি গ্রামের ঘরোয়া স্কুল থেকে পুরোপুরি নিষ্কৃতি পেলাম।
নিজের খুশী মত বাড়ীর পুরোনো লাইব্রেরী থেকে অনেক বই পড়লাম।
আমি ভালো ছাত্র হয়ে গেলাম, শহরের বনেদী স্কুলেও। তবে কিছুই মনে থাকে না, সব ফার্স্ট প্রিন্সিপল থেকেই বের করে নিতে হয়।
হ্যাঁ, আপনার নামটা জানি কি বলেছিলেন? ও, বলেন নি? দেখা যাক, কি হতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।