আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিচার



এবার টিচারদের কথা বলি। সেন্ট্রাল গার্লস স্কুলের বড়দি বলতেই চোখে ভাসে-‘অপর্ণাদি'’। উনি স্কুলের শুরু থেকেই যুক্ত। আমার মনে আছে ভর্তির পরীক্ষা দিলাম, তারপর পাপার সঙ্গে ওনার সাথে দু’তলায় বড় বিল্ডিংএ দেখা করতে গেলাম। উনি খুব গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন।

কি কথা প্রসঙ্গে(মনেহয় হোস্টেলে থাকাতাম বলে, হয়ত)বল্লেন- যাও দেখি ওই জানলার পর্দাটা তুলে দাও তো! আমি এমনি তুলে দিলাম। উনি উঠে এসে সুন্দর করে দেখিয়ে দিলেন। নিচের এককোন নিয়ে উপরের উল্টোদিকের এককোনে গুঁজলেন, অন্যদিকটা একই রকম করলেন। শেষে বললেন, -যেটুকু করবে, সুন্দর করে করবে। নিচে আমরা ক্লাস করতাম।

উনি আসছেন শুনলে পিন ড্রপ সাইলেন্ট হয়ে যেত পুর ক্লাস। উনি মাঝে মাঝে নিচে সব ক্লাস ঘুরে দেখতেন। বেশ লম্বা-চওড়া ছিলেন। পিছনে হাত জোর করে, সামনে সামান্য ঝুঁকে ধিরে ধিরে পুর স্কুল ঘুরতেন। একদিন কোন কারণে উনি ক্লাস নেন।

আমরা ওনাকে যেমন যমের মত ভয় পেতাম, তেমনি খুব শ্রদ্ধাও করতাম। এত ভয় কেন পেতাম কে যানে! কারণ ওনাকে কখনও উঁচু গলায় কথাই বলতে শুনিনি। খুব ব্যাক্তিত্বময়ী মহিলা ছিলেন। আমরা থাকতেই উনি রিটায়ার করলেন। মাঝে মাঝে আসতেন।

নতুন বড়দি অনেক ফ্রেন্ডলি ছিলেন। তবু বড়দি বলতে চিরদিন ‘অপর্ণাদি’ই চোখে ভাসেন। এ ছাড়া, কৃষ্ণাদি। বাংলা পড়াতেন। এমন ভাবে পড়াতেন ক্লাসেই সব পড়া হয়ে যেত।

তবে ওনার স্বভাবটা উৎপল দত্ত টাইপের, রাগলে আর জ্ঞান থাকত না, মারতেন না, কিন্তু খুব চেঁচিয়ে বকতেন। ছবিদি খুব ভাল ছিলেন। বন্ধুর মত মিশতেন। উনি একবার সীমাকে যে ভাবে নকল করতে গিয়ে ধরেন! শাড়ির কোঁচায় বেটি খাতার পাতা ছিড়ে আনে, খুলে টুকছে আর ছবিদি ধরে খুব বললেন। টুকলি করতে গেলেও বুদ্ধি দরকার-বা এমন কিছু বলেছিলেন।

অন্য কেউ হলে সীমার ইতি হয়ে যেত। ও আসলে কিছুই লিখে উঠতে পারে নি, তাই দিদি ছেরে দিলেন। রুনাদি নামকরা বাড়ির বৌ ছিলেন। মাঝে একটা বছর আমার সব সঙ্গীরাই অচেনা ছিল। আর সে বছর মনে আছে রুনাদি ক্লাস টিচার! খুব ফিট্‌-ফাট থাকতেন।

খুব উল-কাটা বুনতে ভালবাসতেন। একটি খুব এঁচোড়ে পাকা মেয়ে ছিল, নাম যতদুর মনে পরছে রাজশ্রী, কালোর উপর মুখশ্রী ভিষণ সুন্দর। তবে প্রচন্ড তর্ক-ঝগরা এসব করতে পারত, পড়া ধরলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর প্রাণপণে খোঁজার চেষ্টা করত। কি একটা অন্যায় করতে রুনাদি ওকে ঠাস্‌-ঠাস্‌ করে এতো জোরে মারেন যে ওর চুল খুলে যায়। ওই আমার স্কুল জিবনে প্রথম ও শেষ টিচারের পিটুনি দর্শণ।

মেয়েটিকে ভাল লাগত না, কিন্তু সেদিন ওর জন্য খুব খারাপ লেগেছিল। ইংলিশ টিচারের নাম ভুলে গেছি। ভিষণ শান্ত ছিলেন। ওনার ক্লাসে সবাই অন্যমনস্ক থাকত। তবে দিদি আমায় বেশ স্নেহ করতেন।

একবার নতুন লাইব্রেরি টিচার এলেন। ওনার স্বামী মারা গেছিলেন। দু’টি বাচ্চা ছিল। উনি আমাদের ক্লাসে প্রথম দিন এসে আধুনিক কবিতা শুনিয়েছিলেন। কেউ কিচ্ছু বুঝিনি।

আমরা ক্লাস সিক্সেই পড়তাম মনে হয়। উনি যেতেই ওনারই পড়া কি একটা কথা নিয়ে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়। ওদিকে দিদি তা জানেন না! পরেরদিন উনি নিজের লেখা আধুনিক কবিতা যেই শুরু করেছেন অমনি পেছন দিক থেকে আওয়াজ। ব্যাস তারপর থেকে উনি আর কবিতা পড়ার চেষ্টা করতেন না। আমি যখন নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম একই সঙ্গে একজন খুবই কম বয়সী টিচার এলেন।

খুব সুন্দরী! সদ্য কলেজ পাশ করেছেন। আমাদেরই ক্লাস টিচার হলেন। উনিও নতুন ক্লাস টিচার! আমাদের খুব উৎসাহ দিতেন অন্য সেকসনকে টেক্কা দিতেই হবে। নিজের সাবজেক্ট ছাড়াও অন্য বিষয়ও দেখতেন। আমরা ওনাকে বন্ধুর মত পেয়ে গেলাম।

কানাঘুসো ছিল ওনাকে একজন স্কুলে ছেরে যায়। উনি বড়দির চেনাশোনা ছিলেন আর ওনার বাবা সম্ভবত প্রফেসর ছিলেন। তো, নতুনদিদিকে নিয়ে খুব আমাদের মধ্যে আলোচনা হত। আমাদের সেকশন ওনার জন্য গর্বও বোধ করত। শেষে যানা গেল যিনি ছেরে যান তিনি একজন শিল্পী, আরো উৎসাহ বেড়ে গেল! উনি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসতেন।

অতি উৎসাহী কিছু মেয়ে তারও আগে এসে গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকত। আমাদের এখানকার মত এত্ত বাবা-মারা স্কুলে দিতে আসত না। রিক্সা থাকত। নয় পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে আসত। বড়দি প্রার্থনার সময় বার বার বলতেন কেউ একা আসবেনা, মেয়েরা দলবদ্ধ ভাবে থাকবে।

বুলবুলদি ভূগোল পড়াতেন। কিন্তু খুব বেশি বোঝাতে পারতেন না। কিন্তু ওনাকে এত সুন্দর আদুরে আদুরে দেখতে ছিল! খুব ভাল লাগত। মাঝে মাঝে দিদিরা তাদের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসতেন। ওনার বেশ বড় ছেলে দেখে অবাক হয়ে যাই! আর একজন ছিলেন আমার অতি প্রিয়-‘পর্ণাদি'’।

নাম অপর্ণা কিন্তু বড়দির নাম ধরে কেউ ডাকবেনা বলে বোধহয় স্কুলে নতুন নাম হয়। ওনাকে ক্লাসে পাই নাইনে উঠে কিন্তু বহু আগে থেকে ওনাকে আমার খুব ভাল লাগত। প্রচন্ড গম্ভীর। কেউ কক্ষণ ওনাকে হাসতে দেখেনি। অথচ রাগও করে থাকতেন না।

আপন মনে থাকতেন। টিচারদের সাথেও যে খুব ভাব ছিল তা না। সীমা আবার গসিপ মাষ্টারও ছিল। ও কি সব যেন বলতো। ওনার কিন্তু খুব সুন্দর দুটি বাচ্চা বাচ্চা ছেলে ছিল।

আসলেই সারা স্কুল দৌড়ে বেরাত। দিদি শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে দেখতেন। আগে বিজ্ঞানটা অত ভাল লাগত না। কিন্তু টিচার পছন্দ মত হলে কত কাজ দেয় আমায় দেখতে হত! কেবল উনি আমায় দেখুন এই জন্য আমি খুব ভাল করে প্রতিদিন ওনার পড়া করে যেতাম। কিন্তু কেন যানি, অন্যরা খুব ভয় পেত বলে নাকি ওনাকে বেশি পছন্দ করত না।

উনি ক্লাসে আসার থেকেই সবাই কেমন দমবন্ধ করে বসে থাকত। গেলে হাঁফ ছেরে বাঁচত, মনেহত। উনি খুব যে শাস্তি দিতেন তাও না। আসলে ওনার সুন্দর মুখের এক্সপ্রেসন ছিল মারাত্মক! যে পড়া পারত না তাকে আর বসতে বলতেন না। জোর করে কাউকে পড়াও ধরতেন না।

প্রশ্ন করতেন। যে পারবে হাত তোল। আমি সব সময় লাফিয়ে লাফিয়ে হাত একরকম তুলেই বসে থাকতাম। উনি প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ পেতেন, হ্যা হ্যা, তুমি বল। তারপর কিছু একটা আঁচ করে আমার হাত তোলা দেখলেই অল্প মুচকি হেসে অন্য কাউকে ধরতেন।

আমারও অভিমান হত। পরে যদিও আমাকেও মনে হয় ধরতেন। পরে আমি যখন সদর গার্লসে গেলাম উনিও কিছুদিন পর সেখানের বড়দি হয়ে এলেন। সবাই একটু অবাক হল। বড়দি বলতেই একটু বয়স্ক কেউ মনে হত।

উনি কিন্তু খুবই ইয়াং ছিলেন। সদরে ওনাকে ক্লাসে পাইনি। তবে দরকারে ওনার ঘরে গেলে কখনও খুব কিছু উচ্ছাস দেখাতেন না। শুধু ঠোঁট চেপে অদ্ভূত সুন্দর হাসতেন। তাতেই আমরা ধন্য হতাম।

স্কুল ছারার পরও বিভিন্ন কাজে সম্পার সাথে যেতাম, আর ঠিক ওনাকেই দরকার হত। সম্পা ঘরে যেত না। আমিও মাথা নিচু করেই যেতাম। খুব ভাল লাগত ওনাকে দেখতে। এবার আমার বাড়িতে যারা পড়াচ্ছেন তাদের দিকে একটু তাকান যাক।

আসাম মোড়ে গিয়ে আমার টিউটার খোঁজা হচ্ছে। পাপার চেনাশোনা কেউ সুমিতদার খবর দিল। উনি একদিন দেখা করতে এলেন। সেদিন আমি আবার শাড়ি পরে বোধ হয় খেলছিলাম। টুকটাক কথা বলেই পরদিন থেকে পড়ান শুরু হল।

সুমিতদা ছোটখাট কিন্তু বেশ সুন্দর মুখশ্রী, প্রচন্ড সৌখিন গোছের ছিলেন। আর টিউশন করে করে কাকে কি করে পড়িয়ে নম্বর তুলে দিতে হবে খুব জানতেন। একদিনেই বুঝে নিলেন আমার মাথায় গোবোর পোড়া। ব্যাস! এরপর শুরু হল শাস্তি। গায়ে হাত তুলতেন না মেয়ে বলে।

খালি কান ধরে, নয় এক পা তুলে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। আমায় আবার ভয় দেখাতেন না পড়লে রাস্তায় ওভাবে দাঁড় করিয়ে রাখবে। প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগত। পরে গা সওয়া হয়ে গেল। উনি এলেই আমি যানতাম কোনদিন কোন শাস্তিটা হবে।

বিনদাস টান টান করে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অন্তত অঙ্ক তো করতে হল না! এই লাভ গুনতাম। উনি অবাক হয়ে যেতেন। শেষে হাল ছেরে দিয়ে বাবা-বাছায় এলেন। এদিকে পাশের বাড়ি এক দিদি থাকত।

তাকে ও তার বন্ধুকেও সুমিতদা পড়াত, এদের বাড়িতেই। পাশের বাড়ি যতদুর সম্ভব ইচ্ছে ছিল সেই দিদির সাথেই বিয়ে দেয় সুমিতদার। এদিকে তীর অন্য দিকে ঘুরে বসে আছে। অন্য যে মেয়েটি পড়তে আসত তাদের নাকি অবস্থা খুবই খারাপ। এসব আমরা যানতে পারতাম না।

আমাদের বাড়ি দূর্গের মত বড় পাঁচিলে ঘেরা। শেষে শুনলাম সুমিতদার বিয়ে হয়ে গেছে। পাশের বাড়ির সবাই আগ বারিয়ে দাদুর কাছে সুমিতদার নিন্দে করে গেল। সবাই ওনার কাছে পড়াতে বারণ করল। আমি আনন্দে ধেই ধেই করে নাচছি।

সেটা বেশ কিছুদিন পরের কথা। এতদিনে সুমিতদা নিজেই কেমন যেন আমাদের বাড়ির হাওয়া বুঝে পড়ার দায়িত্ব প্রায় নিজেই তুলে নিয়েছে। বাপ্পা মাঝে মাঝে ছুটিতে এলে সেও কাচু-মাচু হয়ে বসত। পরে বড় হতে আর সুমিতদা মুখো হত না। তো, আমরা খুব ঘুম কাতুরে।

ভাবলে অবাক লাগে সুমিতদা একদিন বাড়ি এসে বাপ্পার ঘরে ঢুকে খুব বকছেন, পাশে আমার ছোট্ট ঘর। আমিও তখন শুয়ে, কেউ ডাকেনি। সুর সুর করে এসে দেখি উনি বাপ্পার মশারির দড়ি টেনে টেনে ছিড়ছেন। কতদিন পড়া হয়েগেছে, মানে সুমিতদা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়াতে পারতেন। কিন্তু আমার আবার পেট ব্যাথা, চোখ ব্যাথা এসব দু’ঘণ্টার বেশি বসে থাকলেই শুরু হত।

এদিকে তুমুল বৃষ্টি বাইরে। উনি ওই বৃষ্টিতে যাবেন না। জামা খারাপ হতে পারে বলে হয়ত। হাঃ...হাঃ। আমি ভুলোকে নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছি আর উনি বাপ্পাকে নিয়ে দাবা খেলতেন।

ওই ঘটনার পর সুমিতদা নিজে পাপার কাছে দেখা করে সব বললো। হ্যা, তাদের ভালবাসার সম্পর্ক হয়। এদিকে সুমিতদা শুধু টিউসানি করে তাই জোর করে দিদিটার বিয়ে দিচ্ছিল। সে রাতে বাড়ি পালিয়ে সুমিতদাদের বাড়ি ওঠে। সব শুনে সুমিতদাকে আবার রাখা হল।

আমার খুব দুঃখ হল, আবার পড়তে হবে জোর কদমে, এই ভেবে। একটা রিলিফ ছিল। সুমিতদা সায়েন্সটা দেখত আর আর্টস এর জন্য নিজের বন্ধুকে দিয়েছিল। তিনি আবার আরেক জন! পড়ার ফাঁকি আমি খুব দিতাম। একবার কিন্তু সত্যি খুব জ্বর হল সেই দাদাটা শুনবে না।

আমার সত্যি অসুখ হয়েছে কিনা একেবারে আমায় দেখেই যাবে। সেদিন পাপা বাড়ি ছিল। পাপা বলতেও শুনছে না। তখনই সুমিতদাকে ডেকে তাকে আসতে বারন করা হল। সুমিতদা এবার বুড়ো স্যারকে আনলেন।

উনি প্রায়ই পড়াতে পড়াতে ঘুমিয়ে পরতেন। আমার তাই ওনার কাছে পড়তে খুব ভাল লাগল। কিন্তু পরীক্ষার সময় খুব রাগ উঠত, আবার ওনার অসহায় অসহায় মুখ দেখে চুপ করে যেতাম। ওনার বাড়ি সরস্বতী পূজোয় গেলে খুব খাতির করতেন। মাঝে খুব অসুবিধায় পড়ে সুমিতদা পাপাকে আমায় ওনার বাড়ি পড়তে যাবার জন্য অনুরোধ করল।

রিক্সা ঠিক হল। সে সময় সুমিতদার বৌকে দেখলাম। একটু ভারি চেহারা কিন্তু খুব সুন্দরী, জমিদার-গিন্নী লাগত। বাড়িতে কোন কাজ করতে হত না। সারাদিন টিভি দেখত।

সুমিতদার বাড়ি সুমিতদার মতই একদম পরিপাটি। ওনার বাবা অসম্ভব লম্বা, সুমিতদা ওর মার মত। বোনরাও সুন্দরী। তবে আমার বৌদির সাথে পটে গেল। আমি যেদিন পড়া করে যেতাম না, টুক করে ওর ঘরে ঢুকে আড্ডা দিতাম।

সুমিতদা বৌকেও বকতে পারত না, ওনার বাড়ি আমাকেও না! আমার সাথে আমার ক্লাসের দুটি ছেলে আর কিছু অন্য ক্লাসের বাচ্চারা পড়ত। ছেলে দুটি বোধ হয় মোহিত নগরের ওদিকে থাকত। ফেরার সময় সাইকেলে রিক্সার সাথে সাথেই যেত। আমার বাড়ি থেকে সাইকেল কমপিটিসন শুরু করত। ওরা বেশ ভাল ছিল।

একটার নাম বোধহয় গৌতম ছিল। নামটা শুনলেই আমার সেই ছেলেবেলার ভেব্‌লা বন্ধুকে মনে পরত। ওরা খুব শান্ত ছিল। সুমিতদা আমাদের পড়া দিয়ে বাড়িরই কাজে ব্যাস্ত থাকলে আমিও কাট্টি মেরে বৌদির কাছে বসে থাকতাম। পরে সুমিতদা দু’জনকেই বকত।

হাতে বেত থাকত, বলত আমি ওনার সব ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করছি। আমিও সুর সুর করে আবার সেই পড়ার ঘরে যেতাম! তো, পরেরদিকে সুমিতদাকে আসতে দেখলেই ছেলে দুটো টুক করে আমায় ডেকে আসত। আমিও খুব ভাল মানুষের মত মুখ করে পড়তাম। আর সুমিতদা ভাবত খুব ওনাকে ভয় পেয়েছি! হাঃ, হাঃ। উনি বলতেন আমার বাড়িতে উনি বোঝেননি আমি এত্ত তিইরিং-বিরিং করি।

ওনার বাড়ির চেয়ে আসলে আমার বাড়িতে উনি আমায় বেশ শাস্তি-টাস্তি দিয়ে দাবিয়ে রাখতে পারতেন। সুমিতদা বড় বড় বাসে আমাদের পিকনিক নিয়ে যেতেন। মাধ্যমিকে আমার ফল তুলনামূলক ভাবে বেশ খানিকটা ভাল হল। স্কুলেও টিচাররা ডেকে আদর-টাদর করলেন। পাপা, সুমিতদা আর বুড়ো স্যার আমায় মোটামুটি পাশ করাতে চেয়েছিলেন।

পাপা খুব খুশি হয়। এবার সুমিতদা আমায় পিওর সায়েন্স পড়াবেন বলে উঠে পরে লাগলেন। এসব ব্যাপারে পাপা কখনও কিছু বলত না। আমি একেবারে বেঁকে বসলাম! আবার সুমিতদার কাছে! পরে দেখেছি আমার অনেক বন্ধুর পিওর সায়েন্স নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। সুমিতদা খুব বোঝালেন, বকলেন, কিন্তু আমি ঘাঁড় বেঁকিয়েই বসে রইলাম! উনি খুব বিরক্ত হয়েছিলেন।

তারপরও আমার ম্যাথস্‌ ছিল। কিন্তু উনি আর করাতে চাইলেন না। তবে পাপা বল্লে আসতেন। আমি বরাবর সুমিতদার সাথে যোগাযোগ রাখতাম। বিশেষ করে বৌদির সাথে।

সুমিতদা খুব ব্যাস্ত তখন। কলেজের কাছে ওনার বাড়ি হওয়ায় প্রায়ই সম্পাকে নিয়ে চলে যেতাম। বৌদি খুব আপসোস করত ওদের ছেলে-মেয়ে হচ্ছে না বলে। শেষে অনেকদিন পর মেয়ে হল। খবর পেয়ে খুব আনন্দ হল।

আমি-সম্পা দেখতে গেলাম। বাচ্চাটা খুব স্বাস্থ ভাল, গোল্লু। কিন্তু বৌদিকে দেখে চমকে গেলাম। যানতে পারলাম এত কম বয়সেই বৌদির শরিরে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। বৌদি কিন্তু খুব খুশি।

ক’দিন পর সাংঘাতিক খবরটা শুনলাম। বৌদি নেই! শুনেই আবার সম্পার সাথে সুমিতদার বাড়ি গেলাম। কি বলব! সুমিতদা বরাবর আমায় শাসন করেছেন। খুব স্নেহ করতেন। সে দিন কি অভিমান বৌদির উপর! সম্পাকে সেদিনই হয়ত উনি দেখেন।

কোন হুস্‌ নেই। কত কথা বলেই চলেছেন! বলছেন, আমায় ছেরে চলে গেল! যান! পঁচিশেও পরল না! তারপর আত্মস্থ হয়ে উঠে চলে গেলেন। মনে হল উনি ডুঁকরে কাঁদতে পারলে হয়ত একটু শান্তি পান। সেদিন আমি আর সম্পা অভিভূত হলাম সুমিতদাকে দেখে। বৌদিকে কি প্রচন্ড উনি ভালবাসেন! যদিও বছর ঘুরতেই খবর পেলাম আবার ওনার জন্য মেয়ে খোঁজা হচ্ছে।

মাধ্যমিকের পর সুমিতদাই আমার টিচার ঠিক করে দিতেন। এবার আমার খুব মজার মজার টিচার আসতে লাগল। তখন পাপা টাউনে পড়াতে নিয়ে যেত। অঙ্কের জন্য কেবল টিচার আসত। প্রথমে একজন শান্ত বয়স্ক টিচার এলেন।

কিন্তু প্রথমদিনই ভুলোর প্রচন্ড গম্ভীর মুখ দেখে তিনি আর আসতে চাইলেন না। ওনার চার ছেলেই সোনার টুকরো। সবাই অঙ্ক নিয়েই পড়াশুনা করে। সুমিতদা বড়জন বাবলাদাকে নিয়ে এলেন। বাবলাদাকে দেখলেই বোঝা যেত সারাদিন পড়াশুনা করে।

বেশ একটু ট্যারাও। উনি আপন মনে অঙ্ক করতেন। দেখে মনে হবে আমি বুঝি ওনাকে পড়াচ্ছি। কখনও মুখই তুলতেন না। প্রথম প্রথম চুপ করে বসে উসখুস্‌ করতাম।

একটু ঘুরে আসি! জিজ্ঞেস করলে মাথা নিচু করেনই মাথা নারতেন। কারণ জিজ্ঞেস করতেন না। আমিও ভুলোকে নিয়ে বাগান থেকে একটু ঘুরে আসতাম। মাঝে মাঝে দেখে যেতাম টিচার ঠিক ঠিক অঙ্ক করছে তো! হাঃ হাঃ হাঃ! বাবলাদা আমাদেরই চেনাশোনা আরেকটি মেয়েকেও অঙ্ক করাত। সে অপুরূপা সুন্দরী ছিল।

আর খুব টরেটক্কা! মানে কথা শুরু করলে আর থামতোই না! তো, কি মাথায় ব্যামো হল বাবলাদার! তাকে একদিন বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে বসল। আর মেয়েটি তো সে গল্প আমায় বলতে বলতে হেসেই খুন! তবু আমার বাবলাদার জন্য মায়া হচ্ছিল, ওর হাসি দেখে। আহাঃ, নিশ্চয়ই খুবই ভালবেসে ফেলেছিল! নইলে ওই লোক এই কান্ড করে! লজ্জায় উনি আর এলেন না। তার ভাই এবার আসল। সে অঙ্কে গোল্ড মেডেল পেয়েছিল।

কলেজে পড়ত বোধ হয়। এও বেশি কথা বলত না। কিন্তু কি একটা গাম্ভীর্য ছিল। চুপচাপ অঙ্ক করতাম। (সকল চরিত্রের নাম পরিবর্তন করা হল)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।