বিলেত থেকে প্রথম প্রকাশিত সাহিত্যের কাগজ হচ্ছে হিরন্ময় ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'সাগর পাড়ে' (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৪)। ছাপা হতো কলকাতা থেকে। নব্বই এর দশকে ফারুক আহমদ রনি সম্পাদিত ''শিকড়'' বের হয় সাহিত্যপত্র হিসেবে। তবে তা ছিল ম্যাগাজিন আকারে। একটি পূর্নাঙ্গ ছোটো কাগজ হিসেবে ''শব্দপাঠ'' ই বিলাতের প্রথম ছোটো কাগজ।
''শব্দরূপ'' নয়।
এই তথ্যটি পরে আমি আমার সংশোধিত লেখায় শোধরে নেবার আশা করি। '' শব্দপাঠ '' প্রথম বের হয় জুন ১৯৯৪ সালে। প্রথম সংখ্যার
সম্পাদক ছিলেন , আতাউর রহমান মিলাদ। নির্বাহী সম্পাদক - আবু মকসুদ।
২য় সংখ্যা থেকে প্রধান সম্পাদক এর দায়িত্ব নেন- আতাউর রহমান মিলাদ, সম্পাদক- আবু মকসুদ আর প্রকাশক এর দায়িত্ব নেন
কাজল রশীদ।
এ বিষয়ে শামস শামীম সম্পাদিত লিটল ম্যাগ '' জাঙ্গাল '' ( ফেব্রুয়ারী -২০০৮) সংখ্যায় ''শব্দপাঠ''এর বর্তমান সম্পাদক আবু মকসুদ এর একটি লেখা ছাপা হয়। কালিক বিবেচনায় এই লেখাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এখানে আমি লেখাটি যুক্ত করতে চাই ।
শব্দপাঠ : প্রাণের তাগিদ
আবু মকসুদ
------------------------
তাগিদটা প্রাণের। দীর্ঘ দিন থেকে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চলছিলো।
কিন্তু সময়টা অনুকুলে আসেনা। প্রবাসে জীবিকার গলিতে হাঁটি, বারবার পরাজিত হই।
১৯৯৪ দেশে গেছি দীর্ঘদিন পর। চেনা জগতটা আগের মত নেই, কৌশরের দুরন্ত দিনগুলো খুঁজে ফিরি, খুঁজে ফিরি মনোরম বিকেলগুলো ছড়া কবিতা আর সাহিত্যের আড্ডায় যেগুলো কাটত। অনেকগুলোই স্মৃতি হয়ে গেছে।
এক এক করে চেনা মুখদের এক করি যাদের সাথে কেটেছে একটা সময় শিল্প জ্ঞানে বা বন্ধ্যা তর্কে। পুরোন আড্ডার টেবিলে বসেই ফিরে যাই বিগত দিনে। আড্ডার সুত্র ধরে কথাটা হাঁটে। ইচ্ছে প্রকাশ করি বিলেতে বসবাসকারী কবি সাহিত্যিকদের লেখা নিয়ে একটা সাহিত্য কাগজ প্রকাশের। সেই সাথে দেশের ছোটকাগজে যারা লিখছেন তাদের লেখাও এতে যোগ করার।
সবাই কথাটা নিয়ে লুকালুকি করে। পক্ষে বিপক্ষে এক পশলা তর্কের ঝড় শেষে সবাই ঐক্যমতে পৌছি। নাম দেয়া হয় ‘শব্দপাঠ‘।
উল্লেখ্য ইতিপূর্বে বিলেত থেকে বিভিন্ন সাহিত্য ও ছড়ার কাগজ বের করেছি কিন্তু এর কোন ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে বিষয়ভিত্তিক কাগজ প্রকাশ করেছি।
’’শব্দপাঠ’’কে নিখুঁত সাহিত্য কাগজ হিসেবে একটা লক্ষ্য ও গন্তব্য নিয়ে যাবার জন্য প্রথম থেকেই কাজ করি। বিলেত থেকে বিলেত ভিত্তিক অনেক সাহিত্য প্রকাশনা সবসময় আছে। আমরা চাইছি একটু ভিন্নভাবে-স্বদেশ এবং বিলেতের সমন্নয়ে গড়ে উঠবে ’’শব্দপাঠ’’। বিলেতে একটা শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, আমরা প্রথম থেকেই চেয়েছি ’’শব্দপাঠের’’ মাধ্যমে এদের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে। ’’শব্দপাঠ’’ ঘিরেই উঠে আসবে বা আবর্তিত হবে প্রবাসী লেখক চক্র।
কড়ির দেশে সময়ের শ্রাদ্ধ করে যারা সাহিত্য চর্চায় নিবেদিত তাঁদের এক সূত্রে গেথে দেবার চিন্তা থেকেই ’’শব্দপাঠ’’ এর আত্মপ্রকাশ।
’’শব্দপাঠ’’ প্রকাশের লক্ষ্য সম্পর্কে সূচনা সংখ্যা সম্পাদকীয় কথনে এভাবে উল্লেখ- প্রবাসে প্রতিটি বাংগালীই বাংলার প্রতিনিধি। এই বাংগালী পৃথিবীর যেখানেই আস্তানা গেড়েছে সেখানেই মেলে ধরেছে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাল। বৈপরীত্য সংস্কৃতির জটিল পরিবেশে ঘর করেও বাংগালী বাংগালই। --- এটি মুলত সাহিত্যের কাগজ।
সৎ সুস্হ সাহিত্য সৃষ্টি আমাদের মুল লক্ষ্য। আমরা বাংলাদেশ ও বিলেতের নবীন প্রবীন লেখকদের লেখা নির্বাচন করেছি সম্মিলনের লক্ষ্যে। স্বদেশ এবং প্রবাস এর লেখক যোগ সূত্রতা সৃষ্টি এতে কাজ করেছে। লেখক নয় লেখাই বিচার্য্য। মুখচেনা সাহিত্য প্রীতিতে আমরা বিশ্বাস করিনা।
এই গন্ডি ভাঙ্গার শব্দ শুনবো বলে আমাদের যাত্রা।
’’শব্দপাঠ’’ প্রকাশের শুরুতে যাত্রাটা মসৃন ছিলোনা। স্বদেশ বিছিন্নতার ফলে ছোটকাগজ লিখিয়েদের সাথে যোগাযোগ বিছিন্নতা ছিলো প্রবল। নতুন যারা লিখছে অনেকের সাথেই কোন যোগাযোগ ছিলোনা। স্বভাবতঃই শুরুতে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ’’শব্দপাঠ’’ প্রথম সংখ্যার লেখা সংগ্রহ করতে হয়।
ভালো লেখা পাওয়া সব সময়ই সময় সাপেক্ষ এবং লেখা আদায় দুরুহ, তাছাড়া ’’শব্দপাঠ’’ যেহেতু নতুন জন্ম নেবে, অনেক লেখকই লেখা দিতে চাননি। আনকোরা কাগজে অনেকেই লেখার আগ্রহ দেখান না।
প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর আমরা দীর্ঘ বিরতিতে চলে যাই। কড়ির দেশে রুটি রুজির ধান্ধায় ব্যস্ত হয়ে পরায় ’’শব্দপাঠের’’ যাত্রা থেমে যায়। তবে জন্মের দাগ সহজে কি যায় মোছা ? ’’শব্দপাঠ’’ পুনর্জন্ম লাভ করে ২০০২ সালে।
পরিকল্পনা ছিলো বছরে অনন্ত তিনটা সংখ্যা প্রকাশের, কিন্তু স্বদেশ, প্রবাস, যোজন মাইলের দুরত্ব, ভালোলেখা সংগ্রহের দুরুহতা ইত্যাদি বিবেচনায় এনে বছরে একটা সংখ্যা প্রকাশের সিদ্ধান্তে পৌছি। প্রথম ২/৩ সংখ্যা ’’শব্দপাঠ’’ ছোট আকারে বের করতে হয়েছে লেখা স্বল্পতার জন্য। অবশ্য ২/৩ সংখ্যার পর লেখার জন্য সীমিত আকারে বের করতে হয়নি। সর্বশেষ নবম সংখ্যা ’’শব্দপাঠ’’ ৪৪৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত গড়িয়েছে। ফেব্রুয়ারী/০৮ এ আসছে ’’শব্দপাঠ’’ দশম সংখ্যা আরো বড় হয়ে।
বিলেতেও ছোট কাগজের লেখকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে ক্রমশ। এটা আমাদের জন্য শুভ লক্ষণ।
’’শব্দপাঠ’’ প্রকাশে সন্তুষ্টির পাশাপাশি অসন্তুষ্টি অনেক। প্রকাশনার কাজ সবসময়ই দেশ থেকে করাতে হয়, এখানে প্রকাশনা অত্যান্ত ব্যয়বহুল। দেশ থেকে করাতে গিয়ে অনেক ক্রটি বিচ্যুতি থেকেই যায়।
সামনে থেকে নিজের পছন্দ মাফিক করার তৃপ্তি, কিংবা শেষ মুহুর্ত্বে কোন পরিবর্তন সেটা দূর থেকে সর্বোতভাবে রক্ষা করা যায় না। নান্দনিক দিকটা ফুটিয়ে তুলতে যে সার্বক্ষনিক তুখোড় চোখ থাকা চাই-দুর থেকে কিছুটা হলেও হারাই।
’’শব্দপাঠে’’র মাত্র যাত্রা শুরু। গন্তব্য অনেকদুর। ’’শব্দপাঠ’’ ধারণ করে চলেছে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষী কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীল আকাংখা।
পরিশেষে বলি, আমরা আগুন পেলে ছড়িয়ে দেব আমাদের সাধ্যের সীমিত আঙ্গিনায়।
...............................................
একজন আবু মকসুদ কিংবা একজন ওয়ালী মাহমুদ যে এই বীজ বিলাতে
বপন করে যাচ্ছেন - এর মূল উদ্দশ্য কি ? মূল ইচ্ছা হচ্ছে - বাংলা সাহিত্যের বিপণন। আর এই বিপণন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত।
এই স্বপ্নের অনুকূলে একটি প্রিয় কবিতা এখানে লিপিবদ্ধ করছি
আকাশের দামী মেঘ চিরে, হেলে থাকে সূর্য্যালোক
এ বেলা দেখে আসা দিগন্তে খুঁটিহীন নীল ছাদ
শষ্য’র অনির্ধারিত উৎসমুখ, সত্য প্রবাদ।
সুস্পষ্ট আলোয় থাকা সুদূর, দুর্বিনীত সবাক।
নাতিশীতোষ্ণ নিম্ন অঞ্চলের পৌষমাস এখন
রচনা দৃশ্যে অভিমানের ঘোমটা তোল- সুকৃতি
এখানেও হাড়ভাঙ্গা দর্পন ছিল, ছিল বিস্মৃতি।
বুনিয়াদী সম্প্রীতি গড়ে যৌবন; করে মেহমান।
পথের ধারে সেইসব জন বাসা বদল করে
দ্বীনতার মধ্যে পুরান মধ্যমা নেই, বিলক্ষণ
অবদান সকলের হাতে দিয়ে, দাঁড়ায় প্রবীণ।
লোকালয়ের লোকায়ত আকুতি, নিত্য সরে।
জনম মাটির শত নিবেদন, পড়ে থাকে খাঁজে
পরগনা যে তলিয়ে যায়, ভাসান মাটির মাঝে।
[ ভাসান পরগনায় / ওয়ালি মাহমুদ ]
........................................................
কবিতা বলে যায়, জীবনের পাঁজর ছুঁয়ে কেমন হয় যাপিত জীবন।
মানুষ তা পড়ে। আর শুদ্ধ করে কালের পরিভ্রমণ ।
(চলবে ..........)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।