অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
উপদেশ দিতে গিয়ে একজন দার্শণিক, সম্ভবত সক্রেটিস বলেছিলেন, যদি বিয়ে করো, হয় তুমি সুখী হবে নইলে আমার মতো দার্শণিক হবে।
সম্পর্ক নির্মাণ নিয়ে ভাবছি অনেক দিন ধরেই, সম্পর্ক স্থির থাকছে না, প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, এই পরিবর্তনশীনতাই জীবনের ধর্ম, সুতরাং সম্পর্কের পরিবর্তন মেনে নিতেই হবে। তবে সম্পর্ক জৈবিক নয় মোটেও, সম্পর্ক আমাদের সামাজিক নির্মাণ। যুথবদ্ধতা কিংবা প্রয়োজনীয়তাই আমাদের সম্পর্কগুলো নিয়ন্ত্রন করে, নির্ধারণ করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সেসবের বিবর্তন ঘটায়।
সম্পর্ককে একটা পরিচয় দিতে হয়, মূলত আমাদের নির্ভরতাগুলোকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি, এসবের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারি।
কৌশলগত মিত্রতা, কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ঠতার বাইরে গিয়ে, অথবা অন্য ভাবে বললে, আমাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার বাইরে গিয়ে মিত্রতার ধারণা নিয়ে আমরা সম্পর্ক তৈরি করতে শিখেছি খুব বেশী দিন নয়। আমাদের সাবলম্বীতা আমাদের নির্ভার করেছে বলেই আমরা সম্পর্কের নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছি।
যদিও বাঙালী সমাজে পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে সই সখা মিতা পাতানোর একটা প্রবণতা ছিলো আগে থেকেই, তবে ব্যপক পর্যায়ে চর্চিত হয় নি সবসময়। পারিবারিক সম্পর্কগুলো জৈবিক সূত্রে পেয়েছি কিন্তু সেসব মূলত আমাদের নিজস্ব সামাজিক নির্মাণের জায়গা থেকেই আমরা চিহ্নিত করেছি কিংবা বুঝতে শিখেছি।
আমাদের জন্মসূত্রে বাবা এবং বাবার পরিবার, মা এবং মায়ের পরিবারের সাথে জড়িয়ে পড়তে হয়।
এই অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো অতীত থেকেই সামাজিক বিধি দিয়ে নির্ধারিত হয়ে আছে। আমরা বাড়তি কিছু চাপিয়ে দেই এই সম্পর্কের সাথে। মায়ের স্নেহশীলতা, মামাদের প্রশ্রয় এবং আশ্রয় আমাদের সামাজিক নির্মাণের একটা জায়গা।
সম্পর্ক বিশেষত বৈবাহিক সম্পর্কগুলো বদলে যাচ্ছে, এই পরিবর্তন নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সাথে জড়িয়ে আছে, সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর পুরুষের অধীনস্ততা মূলত অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। নারী উৎপাদনশীল হলেও একক জীবন যাপনের নিরাপদ পরিবেশ খুঁজে না পাওয়ায় এত দিন পুরুষের সাথে সম্পর্কিত হয়ে ছিলো।
সেই নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠেছে নারী, আধুনিক বিশ্বে ইদানিং এই নির্ভরশীলতা অপ্রয়োজনীয়। স্বীয় যোগ্যতায় নারী এখন নিজেই নিজের অর্থনৈতিক চাহিদা পুরণে সক্ষম এবং এ কারণেই সম্ভবত বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে ।
অর্থনৈতিক সাবলম্বী নারীদের বৈবাহিক সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠবার কারণ অন্য কোনো সামাজিক দায় কিংবা নিছক আনন্দ ও পছন্দ । সমাজ নিজস্ব প্রয়োজনেই সম্পর্কের উপরে মানবিক আবেগ স্থাপন করেছে। মানব শিশু যেহেতু অরক্ষিত এবং পরনির্ভর তাই তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য হলেও এই আবেগীয় নির্মাণ প্রয়োজন ছিলো, জৈবিকতার তাগিদে শিশুকে স্তন্য দিলেও সমাজ নিজেই একটা পর্যায়ে এই স্তন্য চাহিদাকে অন্যভাবে পুরণ করবার ব্যবস্থা করেছিলো।
সেই স্তন্যপ্রদানের সম্পর্কগুলো, আমাদের পিতার কর্তব্য, মাতার দায়িত্ব কর্তব্য এবং এরই সাথে সংযুক্ত সন্তানদের পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য, পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্য এবং বয়োকনিষ্ঠদের সাথে শ্রদ্ধা এবং স্নেহের সম্পর্ক- সবগুলোই সামাজিক শিক্ষার প্রভাব।
আমাদের সামাজিক কাঠামো অক্ষত রাখবার জন্য এইসবের চর্চা প্রয়োজন। সুতরাং আমাদের মাতাপিতা সন্তান এবং বয়োজেষ্ঠ্য এবং বয়োকনিষ্ঠদের সাথে আচরণগুলো সামাজিক শিক্ষার প্রকাশ, মোটেও জৈবিক কারণে নিঃসরিত কিছু নয়। তবে মানুষের সামাজিক প্রশিক্ষণের কারণে বাড়তি ছিলো ভ্রান্ত ধারণা নির্মিত হয়েছে, মায়ের গর্ভকালীন সময়ে থাকা স্মৃতি সন্তান কি স্মরণ করতে পারে?
তবে রক্তের সম্পর্ক কিংবা জেনেটিক ইফেক্টকে সামাজিক মানুষ মানতে আগ্রহী, সেটা মোটেও বাস্তবসম্মত কোনো ধারণা নয়। একজন মা তার নিজের সামাজিক শিক্ষা এবং অবচেতন ধারণা থেকে এই প্রভাবটা আশা করে, কিন্তু সেটা সন্তানের উপরে তেমন প্রভাব ফেলে না।
সমাজবিচ্ছিন্ন যেকোনো শিশুই এইসব সামাজিক সম্পর্কের তোয়াক্কা করে না, তাকে পরিবার এবং সমাজ থেকে শেখানো হয় একজন মায়ের উপস্থিতি একন পিতার উপস্থিতি এবং এসবের প্রয়োজনীয়তার কথা।
সুতরাং সামাজিক কাঠামো থেকেই এতিম কিংবা পারিবারিক সম্পর্কবঞ্চিত একজন শিশু তার পরিবারের চাহিদা উপলব্ধি করতে শিখে। মাতৃহীনতার বোধ কিংবা পিতৃহীনতার বোধ সমাজ থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটা বিষয়। এটা একজন মানুষ স্বাভাবিক ভাবে জৈবিক কারণে উপলব্ধি করতে শেখে না।
শিশু তার শৈশব থেকে এটার চর্চা করে, এটা বাবা, এটা মা, বাবা শাসন করবো প্রশ্রয় দিবে, মা স্নেহ করবে, প্রয়োজনে শাসন করবে, সমাজ এবং অন্য সবাই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মানুষের বৃদ্ধির সময়টাকে এইভাবেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণে নির্ধারণ করে দেয়।
সমাজ মানুষের উপস্থিতি চায়, সমাজে মানুষের অর্থনৈতক প্রয়োজনীয়তা আছে, কিন্তু স্বাধীন মানুষ কিংবা সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ এইসব প্রয়োজনীয়তার শেকলে আবদ্ধ নয় মোটেও।
সমাজ নিজের নিরাপত্তার জন্যই এইসব মিথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। তাই আমরা সাহিত্যে শিল্পে এসবের প্রয়োগ দেখি- তবে এই প্রয়োজনীয়তা কিংবা আবশ্যিকতা হয়তো অন্যভাবেও প্রকাশ করা যায়। একটা নিরেট কলাগাছকেও যদি পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় স্নেহশীল বলে, এবং স্নেহ এবং অন্যান্য সম্পর্কের সামাজিক ধারণাগুলো শিশুর ভেতরে স্থাপন করা হয়, তবে শিশু কলা গাছকেই মাতৃপূজা করবে , এসব বোধের চর্চার জন্য তেমন জৈবিক কিংবা জেনেটিক সম্পর্কের প্রয়োজন নেই।
এই চর্চাগুলোর বাইরে মানুষের অন্যসব নির্মীত সম্পর্কের একাংশ নিজের স্বার্থ পুরণের উপায়, সেইসব স্বার্থসংশ্লিষ্ঠতা সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করে, সময় সময় এইসব সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধার কাজ করে।
আমাদের প্রেম ও কামজ সম্পর্কগুলোও নিছক শাররীক প্রয়োজন মেটানোর একটা উপায়,
শুধুমাত্র সামাজিক স্বীকৃতি নেই কিংবা সামাজিক প্রশিক্ষণ নেই বলেই আমাদের সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো কখনই সমকামিতাকে গ্রহনযোগ্য ভাবছে না, এটা যে নিছক শাররীক চাহিদা পুরণের জন্য পছন্দসই একজন যৌনসঙ্গী বাছাইয়ের প্রচেষ্টা এটা মেনে নেওয়ার সামাজিক প্রশিক্ষণ নেই এই সমাজে বেড়ে ওঠা অধিকাংশ মানুষের। সুতরাং তার নিজস্ব দ্বিধায় সখার হাত ধরে বসে কিন্তু শাররীক সম্পর্ক স্থাপন করে বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে, এটাই প্রচলিত সামাজিক বিধি।
আমাদের নিয়মিত শাররীক চাহিদা পুরণের উদ্যোগ নিতে হয়, ক্ষিধে পেলে খেতে হয়, যৌন চাহিদা উপশমের জন্য বিভিন্ন রকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়, প্রেম এবং এর চর্চাও একই রকম ছলচাতুরি। সেখানে আমার নিজস্ব শরীরের দায়ই প্রধান, এবং আমি নিজেই পছন্দসই কাউকে যৌনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করি, তার সম্মতি আদায়ের বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহন করি,
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে বিবাহের প্রতিশ্রুতিও এমনই একটি পদক্ষেপ, অধিকাংশ সময়ই এই নিশ্চয়তা অন্তর্গত দ্বিধা কাটাতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে, অসংখ্য প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং নিয়মিত সেসব প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি আদতে সম্পর্ককে নিশ্চিত রাখে।
অন্য একটা ইস্যু হলে সামাজিক ভাবে নিজের মূল্য বৃদ্ধি করবার নানাবিধ প্রচেষ্টা।
হয়তো বিষয়টা সেক্সিট হয়ে যাবে তবে, এখনও সময় করে দেখা করতে যাওয়া কিংবা সময়ের মূল্য দেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের উদ্যোগ সীমিত, তারা নির্ধারিত সময়ের একটু পরেই উপস্থিত হবে, নিজের ঘর থেকে পাশের ঘরে পৌঁছাতেও অনাবশ্যক বাড়তি সময় নিবে, কারণ সে চাইছে তার জন্য সমস্ত কিছু অপেক্ষা করে থাকুক, একজোড়া চোখ এবং একটা মানুষ তার আগমনের প্রত্যাশা করে আছে এই ছদ্ম নিয়ন্ত্রন এবং ক্ষমতার বোধ তাকে আশ্বস্ত করে। কিংবা তাকে হয়তো নিশ্চিত করে রাশ আদতে তার হাতেই।
সুতরাং সে সেজেগুজে উপস্থিত হয়েও আড়ালে থাকে, প্রেমিক দেখা করতে আসবার পরে তাকে অপেক্ষা করতে দেখে নিশ্চিত হয়ে যায় আড়াল ছেড়ে সামনে। খুব কম সময়ই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
১০টায় দেখা করবার কথা বলে ১১টায় উপস্থিতি হয়তো মেয়েদের একান্ত বৈশিষ্ঠ্য নয়, তবে এটাই স্বাভাবিক ভাবে চর্চিত একটি বিষয়।
সময়ানুবর্তিতা নেই এমন নয়, বরং এই ক্ষমতা এবং লাগামের বিষয়টি এখানে প্রধান। তুমি আমার শরীর চাইলে এই অপেক্ষা এবং নির্যাতন তোমাকে মানতে হবে, সেটা মানতে না পারলে তুমি কিস্যু পাচ্ছো না।
মানুষ হয়তো নিজেকে প্রত্যাশিত ভেবে বাড়তি আনন্দ পায় কিংবা পেতে চায়। মানুষের প্রেমের সম্পর্ক মূলত তার নিজস্ব শাররীক চাহিদাকে পুরণের একটা শোভন পন্থা, সে ধর্ষণ করছে না, বরং সে বিভিন্ন কৌশলে তার এই চাহিদা পুরণের চেষ্টা করছে। যখন শরীরের চাহিদা মানুষের যৌনদায় হয়ে যায়, তখন অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করেই মানুষ প্রেম করে, সম্পর্ক করে, তবে সেটা পুরণের নিশ্চয়তাই হয়তো প্রেমকে স্থায়িত্ব দেয়, পরবর্তী নিশ্চিত যৌনসঙ্গী খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত মানুষ প্রেমিকাকে চটানোর সাহস রাখে না, প্রেমিকাও প্রেমিকের পায়ে পড়ে একই কারণে।
প্রেমিকা কিংবা প্রেমিকের যেকোনো একজন পরবর্তী নিশ্চিত যৌনসঙ্গী খুঁজে পেলে সম্পর্ককে বিদায় জানায়, নতুত শরীরি অভিজ্ঞতা এবং রোমাঞ্চে জড়িয়ে পড়ে।
নিজস্ব চাহিদা, শাররীক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বাইরে গিয়ে মানুষ মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করে, এই সম্পর্কগুলো নির্মিত হয় কিংবা সকল সম্পর্কই নির্মিত হয় আমাদের কথায়। আমরা নিজেদের মানসিক চাওয়া পাওয়া প্রকাশের জন্য একজন সঙ্গীকে বেছে নেই, তার সাথে নিজস্ব দুঃখ সুখ ভাগাভাগি করে নিতে চাই। এবং এই মানসিক অনুভুতির ভাগবাটোয়ারার সম্পর্কগুলোই দীর্ঘ মেয়াদে অবিকৃত টিকে থাকে।
আমাদের যেসব দম্পতি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়েও বছরের পর বছর এক সাথে রয়েছে, তাদের এই সাফল্যের কারণ তাদের নিজস্ব শাররীক চাহিদার পরিতৃপ্তি নয়, বরং নিয়মিত শাররীক চাহিদা পুরণের সাথে সাথে তাদের মানসিক অনুভুতি ভাগবাটোয়ারা করবার মানুষও সেই একজনই।
কিংবা এটা একটা সমঝোতা, হয়তো তাদের প্রতিটা সঙ্গম শাররীক রোমাঞ্চের তুঙ্গে উঠে না ,সঙ্গমকালীন ক্লান্তি এবং যৌনসঙ্গীর অসারতা তাদের পীড়া দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে নতুন কোনো কিছুতে জড়াতে চায় না তারা, এই আপোষটুকুও হয়তো সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে।
মানুষের যৌনদায় বড় দায়, সুতরাং জৈবিক সম্পর্ক কিংবা গর্ভজ সম্পর্ককে অবহেলা করে পরকীয়ার কারণে পিতা সন্তানের গলায় ছুড়ি চালায়, কন্যাকে হত্যা করে, মাতা নিজস্ব প্রেমিকের সহযোগিতায় পূত্র কন্যাকে হত্যা করে ফেরার হয়। আমাদের সামাজিক নির্মাণ, এই মিথ এবং আমাদের আশ্বাস ও আশ্রয় ভেঙে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।