অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
শ্রবন এবং দর্শন এই দুটো অনুভুতি না থাকলে ভাষা শিক্ষার কোনো সম্ভবনা নেই মানুষের। যুগপত দর্শন প্রতিবন্ধী এবং শ্রবন প্রতিবন্ধী মানুষ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারে না। এই ক্ষমতাই তাদের জন্মাবে না।
বিবর্তনের ধারনাটা সামনে এনেই বলতে চাই- প্রকৃতি কখনই এমন কোনো জীবের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে না, বিশেষত একটু উঁচু পর্যায়ের জীব, যাদের খাদ্যবৈচিত্র সীমাহীন। যাদের অস্তিত্ব পারস্পরিক ঐক্যের উপরে নির্ভরশীল এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে এমন কোনো জীবের জন্ম এবং তার প্রজাতির ধারাবাহিকতা প্রকৃতি নিজের হাতে ধ্বংস করবে- যেই প্রজাতি শ্রবন এবং দর্শন প্রতিবন্ধী।
এমিবা, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, এককোষী প্রাণীদের কিংবা অমেরুদন্ডী প্রাণীদের কথা আমরা আলোচনা করছি না।
অনুমাণ করে নেওয়া যাক একটা আদিম জনগোষ্ঠীর কথা, যারা পাস্পরিক ঐক্যের বিনিময়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, তারা যাযাবর, এবং তাদের সেই বাস্তুসংস্থানের অন্য মানুষদের নিয়মিত লড়াই করতে হয় খাদ্যের প্রয়োজনে-
এমন একটা সামাজিক পরিবেশে একজন শিশু জন্মালো- তার ২ বছরের মাথায় এটা নিশ্চিত হওয়া গেলো সেই ছেলে দর্শন এবং শ্রবন প্রতিবন্ধী- এখানে মানবিকতা এবং মমত্ববোধ কোনটা?
আমার অনুমাণ এমন একটা সমাজে মা নিজেই খুন করবে শিশুকে, কিংবা দলের সবাই মিলে এই বোঝাটাকে খালাস করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার প্রচেষ্টা করবে। মানবিকতা বোধ, উচ্চতর জীবনবোধ সভ্যতার একটা পর্যায়, সেই পর্যায়ে মানুষের পৌঁছাতেও অনেক সময় লেগেছে। অনেক খাদ্য নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়েছে- যখন নিজেদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে নয় তখনই প্রজাতির বিস্তারে কতটুকু বিকলাঙ্গ মানুষের বোঝা মানুষ টানতে পারে সেটা নির্ধারিত হয়েছে।
তবে অনগ্রসর সমাজে বিকলাঙ্গ কিংবা প্রতিবন্ধী মানুষের কদর নেই, তাদের সামাজিক ঘৃনা প্রাপ্য হয়ে থাকে।
আলোচনা মূল খাত থেকে অনেক দুরে সরে গেছে আদতে- সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাগুলোর একটা অনিবার্য অধ্যায় পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষমতা, এবং অন্য সব দৈহিক উপকরণের সাথে এই ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার একটা প্রজাতির বিকাশ নির্ধারণ করে থাকে,
শাররীক সক্ষমতা এবং দৈহিক সুষমার কদর এবং নিঁখুত বলিষ্ঠ প্রজাতির আগমন সবাই কামনা করে, সভ্যতা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলো না কোনো দিনই- সবাই মিলে মিশে যেটুকু জুটে ভাগ করে খাবো এই সাম্যবাদী সমগ্র তৈরি হয় নি ইতিহাসে, বরং স্বজাত্যবোধ, কিংবা আদিম পর্যায়ের জাতীয়তাবোধের অস্তিত্ব- গোত্রপ্রীতি মানব সভ্যতার অংশ।
সেখানেই একটা পর্যায় পর্যন্ত বিকলাঙ্গ শিশুদের হত্যা করা তাদের প্রতি মানবিকতার নিদর্শন ভাবা হতো। তারা সামাজিক পরগাছা হয়ে জীবন যাপন করবে এবং সভ্যতার অগ্রগতিতে বাধা হয়ে থাকবে এই ভাবনাটা সামষ্ঠিক উৎকর্ষতার বিপক্ষে ছিলো।
সেখানে কোনো ইশ্বরের ভাবনা কি ছিলো না? অবশ্যই ছিলো।
ভাষার চিত্রিত রূপ এবং মানুষ এবং মানুষের ভেতরে যোগাযোগের শব্দরূপ এই দুটোর ভেতরে যোগাযোগের শব্দরূপ প্রাচীন।
অন্তত আধুনিক জামানায় আফ্রিকার দিকে তাকালেও এটার উদাহরণ পাওয়া যাবে, তারা পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য শব্দ ব্যবহার করে কিন্তু অনেক উপজাতির নিজস্ব ভাষাজাতীয় চিহ্ন নেই- এমন কি কিউনিফর্মের মতো সফল প্রক্রিয়াও তারা আবিস্কার করতে পারে নি এত দিনেও,
কিউনিফর্ম সৃষ্টির আগেই মানুষের ভেতরে এই ঐশ্বরিক চেতনা হয়তো ছিলো, তবে ইশ্বরকে ইশ্বর নামেই অবহিত করবার প্রবনতা হয়তো ছিলো না তাদের।
প্রতিটা মৌখিক ভাষায় এর উপস্থিতি একটা সত্য প্রকাশ করতে পারে, মানুষ সভ্যতার একটা পর্যায়ে নিজের অস্তিত্বের ইতিহাস খুঁজতে চায়। এই অস্তিত্বের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে তারা দেখতে পায় তাদের কাছাকাছি অন্য কোনো জীব নেই, এবং তাদের অভিজ্ঞতাও থাকে না যে তারা স্বয়ম্ভু, যোনীজাত জন্মের সুদুর অতীতের ইতিহাসে যোনিবিহীনতাও থাকে- সেটাকে গোঁজামিল দেওয়ার জন্য হলেও একটা ইশ্বরকে প্রয়োজন হয় যিনি প্রথম একজোড়া যোনী এবং শিশ্ন নির্মান করেন।
আমরা বিবর্তনকে যেভাবেই দেখি না কেনো, ভাষার বিবর্তন অনেক বেশী দ্রুত এবং সাবলীল ভাবে ঘটতে থাকে, শাররীক এবং প্রজাতিক বিবর্তন ধীর গতির প্রক্রিয়া- এবং খাদ্য ও পুষ্ঠির সাথে এটা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমি প্রাকৃতিক নির্বাচনকে সব সময় গ্রহনযোগ্য ভাবতে চাই না।
এমন কি প্রাকৃতিক নির্বাচন সব সময় মানবিক নয়, প্রাণী জগতে দৈহিক্য বৈকল্য অস্তিত্বঘাতী। এমন কি দৈহিক বৈকল্য কোনো ভাবেই একটা সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। যৌনসংসর্গবিহীন জীবন যাপন, নিজের জীনকে স্থানান্তরের কোনো সম্ভবনাই থাকে না।
তবে এখন ভাষাকে মানুষের মৌলিক আদিম বোধের সাথে সম্পর্কিত করে এক ধরনের ভাবনাধারা গড়ে উঠেছে। মানুষ প্রাকৃতিক ভাবেই ভাষা শিখতে পারে, সেই সক্ষমতা মানুষের আদিম জীনে বিদ্যমান- এমন একটা উপসংহার আমার পছন্দনীয় নয়, কারণ ভাষা শিখবার ক্ষমতা পারিপার্শ্বিক থেকে জন্মায়।
বাঙালী একটা বাচ্চাকে মেক্সিকো রেখে আসলে সে কোনোদিন বাংলা বুলি বলবে না, সে মেক্সিকান ভাষাই ব্যবহার করবে, ভাষা উচ্চারণের সহায়ক কাঠামো বিদ্যমান, এই প্রাকৃতিক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষ গিয়েছে। মানুষের কণ্ঠনালী এবং মানুষের ভোকাল কর্ড শৈশব থেকেই বিভিন্ন ভাবে এটা ব্যবহার করে এবং শিশু একটা পর্যায়ে এটা ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করে।
এটা যেকোনো অঙ্গ ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের মতোই। এখানে মূল ইনসটিংক্ট আমি স্বীকার করি না। এটা প্রায়োগিক দক্ষতার বিষয়।
তবে ইদানিং জেনেটিযের অগ্রগতির সাথে বিভিন্ন রকম বিভাজনবাদী ভাবনার জন্ম হচ্ছে- একাডেমিক্যালি যখন কেউ কেউ জেনেটিক কোড দেখে ঘোষণা দিচ্ছে ৪৫ শতাংশ খুনীর ভেতরে একটা জীব বিদ্যমান, তখন মানুষের খুনী হওয়ার প্রবনতাকে তার জন্মগত ত্রুটি বিবেচনা করা হচ্ছে, আমি এমন ভাবনাকে অমানবিক ভাবি।
আমার মনে হয় এইসব একাডেমিক আলোচনা আসলে আমাদের মানুষের অর্জন হীন ভাবতে শেখায়- মানুষের সংগ্রামকে নাকচ করতে অনুপ্রাণিকত করে, তাই আমি বরং প্রাকৃতিক বিবর্তন এবং জেনেটিক কোডের নির্দিষ্ট অংশের উপস্থিতিকে খাদ্যাভাসের ফসল বলতে রাজি, কখনই বলবো না খুনীর সন্তান খুনী হবে, তাই আমাদের প্রথমে খুনীদের খতম করতে হবে, এর পর সবার জেনেটিক কোড বিচার করে যাদের ভেতরে এই জীনের উপস্থিতি পাওয়া যাবে তাদের খুন করতে হবে এমন উন্নত সমাজ ব্যবস্থা চাই না।
আমি সম্মান করতে চাই সেই মানুষটাকে, দৈহিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে যারা এই অলিম্পিকে লড়াই করছে, যারা বাদ পড়েছে এবং এখন যারা অলিম্পিকে অংশগ্রহন করছে তাদের সবাইকেই সম্মান করতে চাই, সম্মান করতে চাই সেই মেয়েটাকে যার জন্মগত ত্রুটির কারণে একটা হাতের কব্জি নেই কিন্তু সে বিশ্ব টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় ষষ্ঠ হয়েছে তাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।