প্রণয় মধুর, যদি না তা পরিণয়ে পরিণত হয়। র-ফলাকে বর্ণে বাড়তে দেওয়ার পরিণতি বেশিরভাগ সময়ই সুখকর হয় না। পুরোপুরি না পাওয়ার বেদনা আর হারাবার শঙ্কা প্রণয়কে মাধুর্য দেয়। কিন্তু এমনসব আনন্দিত বেদনাকে গলা টিপে মারে পরিণয়।
সংসারজীবনে অতিষ্ঠ অনেক পুরুষই হয়তো এবার স্বগতোক্তি করবেন, “সে কথা আর বলতে!” আসলেই তো, এককালের কত চঞ্চল রোমিও আজ পরিণয়ের পাঁকে পড়ে গৃহপালিত অবোধ স্বামীতে পরিণত হয়েছেন।
তাই এ ব্যাথা তারাই তো বুঝবেন! কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এই যে, যে মানুষটি এই মতের প্রচারক, সে জাতিতে পুরুষ নয়, সে নারী এবং অবিবাহিতা। সে আমাদেরই এই গল্পেরই নায়িকা। সে হল অদিতি হাসান, পেশায় দর্শনের প্রভাষিকা।
অদিতির মায়ের ধারণা, মেয়েকে দর্শন পড়তে দেওয়াই কাল হয়েছে। একেকটা মাথাপচা দার্শনিকের নাহক তর্কাতর্কি মুখস্থ করেই মেয়েটার মাথাটা বিগড়ে গেছে।
অদিতিও তাই বিশ্বাস করে, তবে একটু অন্যভাবে। তার ধারণা, দর্শনই তাকে দিয়েছে বিশ্লেষণী ক্ষমতা। দর্শন পড়েছে বলেই সে অলস কল্পনা আর নিরেট বাস্তবের তফাৎটুকু ধরতে পারে।
অদিতির এসব ধ্যান-ধারণা তার বন্ধু এবং ছাত্রদের মধ্যে এক ধরণের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। একটা মেয়ের মুখ থেকে এসব কথা অনেকের কানেই একটু অদ্ভূত ঠেকে, কারো কারো কাছে আবার এগুলো একটু অতি বৈপ্লবিক বলেও মনে হয়।
তারা বলেন, দর্শনের দোহাই দিয়ে এরকম অযৌক্তিক যুক্তি খাড়া করার কোন মানে হয় না। যে অভিজ্ঞতা তুমি নিজে নাও নি, সেটা সম্পর্কে একরম ঢালাও মন্তব্য করা ভীষণভাবে দর্শন পরিপন্থী নয় কি? অন্য দল অদিতির পক্ষ নিয়ে বলে, অভিজ্ঞতাবাদই দর্শনের একমাত্র মতবাদ নয়। যুক্তিবাদ বলেও একটা কথা আছে। চারপাশের ঘটনাগুলো ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সেগুলো দিব্যি syllogism-এর সূত্রে ফেলে দেওয়া যায়। syllogism-এর সূত্র অনুযায়ী বলাই যায়, স্বপ্নবিলাসী প্রেমের পরিণতি বিয়ে, বিয়ের পরিণতি আজীবন দ্বন্দ্ব।
অতএব, স্বপ্নবিলাসী প্রেমের পরিণতি আজীবন দ্বন্দ্ব। অদিতির এইসব অতি উৎসাহী সমর্থকদের এই যুক্তিপ্রণালীর কোথায় কী ফ্যালাসি আছে তা দার্শনিকরাই ভাল বলতে পারবেন। আমরা এসব যুক্তিপ্রবাহে ভেসে যাওয়ার চাইতে গল্পের শেষটা কী হয় সেদিকেই বেশি মনোযোগ দেব।
আমাদের মতই, অদিতিরও এসব অকারণ তর্কাতর্কির প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই। নিজের বিশ্বাস নিয়ে থাকতেই সে ভালবাসে, তা নিয়ে তর্কাতর্কি করতে তার খুব একটা ভাল লাগে না।
আর কলেজের কিছু ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে অদিতির চরিত্রের ঋজুতা একধরণের সম্মোহনী প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাই এইসব ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে অদিতির এক রকম ভালই দিন কাটছিল। কিন্তু মুশকিল যা হল তা ওর স্কুল নিয়ে। কলেজ ছাড়া পুরোটা সময় সে তার স্কুলে দেয়। স্কুলটাই ওর ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেছে।
দু’বছর ধরে স্কুলটা বেশ নামও করেছে। এখন সে গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করার কথা ভাবছে। আরো কিছু পরিকল্পনা আছে। এর জন্য বেশ কিছু টাকা দরকার।
স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রধান হলেন অদিতিরই কলেজের প্রিন্সিপাল লায়লা খানম।
তিনি অদিতিকে সাহায্য করতে চাইলেন। লায়লা খানমের ছোট বোন শায়লার হবু বর, রঞ্জন একজন নামজাদা ডাক্তার। রঞ্জনের বাবা নাকি বিভিন্ন এনজিও-তে টাকা ডোনেট করেন। আজ সন্ধ্যায় লায়লা খানের মেয়ের জন্মদিনে তিনি রঞ্জনের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেন। কোন অনুষ্ঠানে অদিতি সচারচর যায় না।
কিন্তু আজ গেল কারণ স্কুলটাকে নিয়ে ওর অনেক স্বপ্ন! কিন্তু বাস্তবের মাটিতে, যেখানে ঈশ্বরের স্বর্গীয় কল্পনা পর্যন্ত প্রতি পদে পদে বাধা পাচ্ছে, সেখানে অদিতির মত একটা মানুষের কল্পনা যে বাধা পাবে, তাতে আর বিচিত্র কী! তবু অদিতির জেদ চেপে গেছে। তাই বেশি না ভেবে চলে এল সে। তবে নিজের মনের বিরুদ্ধে যাওয়ার পরিণতি অদিতির পক্ষে খুব একটা সুখকর হয় না কখনোই। এবারও তাই হল।
অক্ষরজ্ঞানের সাথে ভদ্রতা, সামাজিক এটিকেট বা রুচিজ্ঞানের যে কোন সম্পর্ক নেই, আজ তার সে বিশ্বাস দৃঢ় হল।
তাই যদি না হবে তবে ঐ ডাক্তার ভদ্রলোক, রঞ্জন কীভাবে তাকে দুম করে বলে বসতে পারে, “আপনার একাডেমিক রেজাল্ট তো খুবই ব্রাইট ছিল। তাহলে দর্শনের মত একটা ওয়ার্থলেস সাবজেক্ট-এ অনার্স করলেন কেন?”
রাগে অদিতির গা জ্বালা করছিল। জিজ্ঞেস করল, “কেন, ওয়ার্থলেস কেন?”
“ওয়ার্থলেস নয়? কী বলছেন? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এটাই তো সবচেয়ে বড় সমস্যা। এমন সব সাবজেক্ট পড়ানো হয় যার সাথে পেশাগত জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন এইসব সাবজেক্টে অনার্স/মাস্টার্স করার মানেটা কী?”
“দেখুন, আপনার কথাটা মানতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তুলে দিয়ে সবকটাকে কারিগরী মহাবিদ্যালয় বানিয়ে ফেলতে হয়।
আর সেখানে যার যার পছন্দের পেশা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো তাদেরকে মুখস্থ করিয়ে চাকরির বাজারে ছেড়ে দিতে হবে! উচ্চ শিক্ষা বলতে আপনি তাহলে এই বোঝেন!” অনিচ্ছাসত্ত্বেও গলায় একটু ঝাঁজ এসে গেল অদিতির।
“কি আশ্চর্য! আপনি কি রেগে যাচ্ছেন!” রঞ্জন একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে বলল।
“না, এখনো রাগিনি। তবে আর কিছুক্ষণ কথা চলতে থাকলে রেগে যে যাব না সেটা নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি না। ”
“ আপনি কিন্তু over-react করছেন! বিরুদ্ধ মত মানার শক্তি আপনার একেবারেই নেই দেখছি।
”
অদিতি হয়তো এবার আরো শক্ত করে উত্তর দিত কিন্তু শায়লার মুখের ভাব দেখে নিজেকে সামলে নিল। আশেপাশের পরিবেশটাও কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠেছে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এসে এরকম তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়ে ভীষণ বোকা বোকা লাগল তার। মুখে একটু হাসি টেনে এনে অদিতি বলল,
“তাই নাহয় হল। এ নিয়ে অন্য সময় কথা হবে বরং।
”
রঞ্জন আবারো বিজ্ঞের মত একটা হাসি দিয়ে বলল, “সেই ভাল। মেয়েরা আবার যুক্তিতে না পারলে ঝগড়া করতে শুরু করে দেয়। ”
রাগে অদিতির গা জ্বলে গেল। কিন্তু সেটা চেপে মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ তার মানে মেয়েদের সাথে ঝগড়া করার যথেষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে আপনার। ” কথাটা বলে ফেলেই মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করল তার।
ছি ছি! শায়লার সামনে এটা কি বলে ফেলল সে!
রঞ্জন একটু হতবুদ্ধি মুখে উত্তর দিল, “ঝগড়ার অভিজ্ঞতা আছে একথা কখন বললাম, আশ্চর্য!”
“তাহলে তো বলতে হয়, আপনি ঠিকমত না জেনেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লেন। তাই কি?” খোঁচা দেবার এই প্রলোভনটা এবার ইচ্ছে করেই দমন করল না সে।
রঞ্জন এবার একটু নিভে গেল।
অদিতিও আর কথা না বাড়িয়ে লায়লা আপার মেয়েটাকে নিয়ে অন্যদিকে সরে গেল।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।