মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
রাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী। দুটি নাম। দুজন বিপ্লবীর নাম। নাম দুটি শুনলেই চেতনার আয়নায় ভেসে উঠে একটি ফাসিঁর দৃশ্য ও একটি রিভলভার দিয়ে মাথায় গুলি ছোড়ার দৃশ্য ও শব্দ।
কিছুক্ষণের জন্য হলেও চেতনা অসাড় হয়ে যায়। সমস্ত শরীর-মন শিহরণে কেঁপে উঠে। এ এক অদ্ভুদ ক্ষোভ আর গর্বের অনুভূতি। কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরেই আমরা সব ভুলে যায়। ফিরে চলি সাম্রাজ্যবাদী চেতনায়।
তখন আমাদের সামনে দেশপ্রেমের চেয়ে নিজস্বার্থ বড় হয়ে দাড়ায়। কোনো ত্যাগ নয়, ভোগই মূল দর্শন। যার কারণে আজকে কাউকে বিপ্লবী বললে সন্দেহ চলে আসে। এবং যারা সন্দেহ করে তারা এই বৃত্তের বাইরে আসতে সক্ষম হয় নি। আপনি আমি সকলে একই।
প্রফুল্ল চাকী ক্ষুদিরামের তিন মাস দশ দিন পূর্বে নিজের রিভলবারের গুলিতে মোকামঘাট রেলস্টেশনে জীবন বিসর্জন দেন। ব্রিটিশ বুনো জানোয়ারের হাতে মরবে না বলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
১৯০৮ সালে এমনি আরো অনেক বিপ্লবীকে ইংরেজের ফাসিঁ কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিল কানাইলাল, সত্যেন বসু, গোপাল সেনসহ আরো অনেককে।
ক্ষুদিরামের বাবা- ত্রৈলক্যনাথ, মা- লক্ষ্ণী দেবী। অপরূপা, সরোজিনী, ননীবালা তিন বোনের নাম।
ক্ষুদিরামের জন্মের পূর্বে দুই ভাই মারা যায়। ছেলে সন্তান না বাঁচার কারণে লক্ষ্ণী দেবী ক্ষুদিরামের জন্মের পর তাকেঁ তিন মুঠো চালের ক্ষুদের বদলে অন্যের কাছে ঠেলে দেন।
বাবা মারা যায় ক্ষুদিরামের বয়স যখন সাত বছর। মা মারা যান তার ছমাস পরে।
দুর সম্পর্কের এক দাদা ও বৌদির কাছে কতটুকু আর স্নেহ-ভালবাসা পাওয়া যায়।
শুধু কাজ আর অত্যাচার। অশান্তিতে ভরা মন। সঙ্গী হল দুঃখ আর একাকীত্ব। তবু পেটের দায় ৮/৯ বছরের ছেলেকে সবই সইতে হতো। এ সকল কারণে পড়াশোনায় তার মন আর বসলো না।
কিন্তু ফাঁক পেলেই খেলাধুলা, ব্যায়াম, এ্যাডভেঞ্চার জাতীয় কোনো কাজে প্রচুর আকর্ষন ছিল তার।
দাদা-বৌদির দিনের পর দিন অমানবিক আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন ক্ষুদিরাম। বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লেন একদিন। বোনের বাসায় যাবেন কিনা ভাবতে ভাবতে মেদিনীপুরে এসে পৌছলেন। ক্ষুদিরাম বোনের বাসা চিনতেন এবং তাকে ভগ্নীপতির বাড়িতে পৌছে দিলেন।
সেখানে থেকে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হলেন।
ক্লাস ফাকিঁ দেয়া ও পড়াশোনা না পারার জন্য তাকে স্কুলের মাস্টার মহাশয় সকল প্রকারের শাস্তি দিতেন। তার উপর বখাটেদের ওস্তাদ বলেও গালি দিতে বাদ দিতেন না কখনো। ক্ষুদিরাম তার মতো বাউণ্ডুলে স্বভাব ছেলেদের নিয়ে ভুত ধরা এবং তাড়ানোর দল গড়লেন। তখনকার দিনের কুসংস্কার তাকে মোটেও স্পর্শ করতে পারেনি।
তাই সমাজের মানুষের মধ্য থেকে কুসংস্কার দুর করার জন্য এই প্রচেষ্টা। এজন্যও তাকে অনেকের বকাবকি খেতে হয়েছে। এক পর্যয়ে স্কুলটা ছেড়ে দিলেন। স্কুলের অদুরে ভবানী মন্দির প্রাঙ্গনে গিয়ে সময় কাটাতেন। সেখানে স্বাক্ষাৎ হলো সত্যেন বসুর সাথে।
১৯০৩ সালে ক্ষুদিরাম তাঁর কাছে গুপ্ত সমিতির (সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন) মন্ত্র শিষ্য হিসেবে দীক্ষা গ্রহণ করলেন।
এতো দিন পর ক্ষুদিরাম মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারলেন। মনে ইচ্ছা মতো পড়াশোনা, খেলাধুলাসহ নানা কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকতেন। বিপ্লবীদের আদর-স্নেহ-ভালবাসায় সিক্ত করলেন নিজেকে। রাজনৈতিক পড়াশোনা ক্রমান্বয়ে বাড়াতে থাকলেন।
শপথ গ্রহণ করলেন দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। পুলিন দাস, অশ্বিনী কুমার দত্ত, মুকুন্দ দাস দারুণ দেশপ্রেমের উন্মাদনা সৃষ্টি করলেন তরুণ সমাজের মধ্যে।
১৯০৬ সালে কথা প্রসঙ্গে সত্যেন বসু বললেন, হঠ্যাৎ দেশটা বেশী রকম কালীভক্ত হয়ে উঠছে। তাঁর কথার জবাবে ক্ষুদিরাম বলে উঠলেন, আর যাই হোক কালীর কৃপায় পাঠা খেতে মিলে আর সেই পাঠার লোভে ভক্তও জোটে। সত্যিকার অর্থে এমন সময়টাই তখন চলছিল।
দেশপ্রেমের একটা ছোট বই ছাঁপা হয়েছে, এগুলো বিক্রির জন্য তরুণদের উপর দায়িত্ব পড়ল। ক্ষুদিরাম তাদের মধ্যে অন্যতম।
মেদিনীপুর মারাঠা কেল্লায় প্রবেশ দ্বারে দাড়িয়ে ক্ষুদিরাম বই হাতে বলছেন- আসুন পড়ুন। দেশের দুর্দশার খবর জানুন। অত্যাচারী রাজশক্তির নির্মমতার নজির – এই বই আপনাদের জন্য।
হঠ্যাৎ এ্যাই কেয়া করত্যা হ্যায়। চুপ বই। একজন হাবিলদার ক্ষুদিরামের হাত চেপে ধরল। শক্তি ও বয়সে তার চেয়ে অনেক বেশি। তবুও ক্ষুদিরামের কাছে-কুছ পরোয়া নেহি।
হাবিলদারের মুখের মধ্যে এক বকসিং মেরে দিলেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। তৎক্ষনাৎ নাক ফেঁটে রক্ত বেরুলো। সত্যেন বসু ঠিক ওই সময় এসে হাজির হলেন। দেখলেন বিষয়টি। সান্তনা দিলেন হাবিলদারকে।
ক্ষুদিরাম মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া। কয়েকদিন আত্নীয়ের বাড়িতে আত্নগোপন করে রইলেন। তাতে কি আর একজন দেশপ্রেমিক শান্তি পায়? দেশ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে জড়িয়ে আছে দেশমাতৃকার কাজে। পুলিশে ধরার ভয়ে আর কত দিন পালিয়ে থাকা যায়।
মনস্থির করলেন পুলিশের কাছে ধরা দেবেন। তাই আলীগঞ্জের তাঁতশালায় চলে এসে ধরা দিলেন। পুলিশ মারা ও নিষিদ্ধ বই বিলির অপরাধে ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামালা করা হল। বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষ এই প্রথম ক্ষুদিরামকে চিনলো। ১৩ এপ্রিল ক্ষুদিরাম মুক্তি পেল।
খানিকটা শাস্তি পেলেন সত্যেন বসু। ক্ষুদিরাম এবার গুপ্ত সমিতির কাজে আরো উঠে পড়ে লাগলেন।
ইতোমধ্যে বিলেতী পণ্য বর্জনের পালা শুরু হলো। বিলেতী পণ্য নৌকায় দেখলে ক্ষুদিরামসহ বাংলার অসংখ্য ক্ষুদিরাম বাহিনী তা ডুবিয়ে দিত।
১৯০৭ সালের শেষের দিকে ক্ষুদিরাম তার দিদির সাথে কালী পুঁজা দেখতে যান।
কালী পুঁজার সময় একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে ডাকহরকরাকে ছুরি মেরে গুপ্ত সমিতির জন্য টাকা সংগ্রহ করে আনেন।
সারাদেশে শুরু হলো ব্রিটিশ শাসক আর সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংঘর্ষ। ধড়পাকড় আর নির্যাতন। বিপ্লবীরাও সুযোগ বুঝে গুম করে দেয় ব্রিটিশ শকুনদের। ব্রিটিশ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধিয়েঁ দিল।
এক্ষেত্রে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর যথেষ্ট উস্কানি ছিল। তিনি ছিলেন হিন্দু বিদ্বেষী।
স্বাধীনতাকামী বিপ্লববাদী দলগুলোকো দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রুজু করে শারিরীক নির্যাতন, আন্দামান,আলীপুরসহ বিভিন্ন জেলে যাবতজীবন কারাদণ্ড দিয়ে পাঠানো শুরু করলো। ব্রিটিশ বিচারক ছিলেন কিংসফোর্ট।
এক নিষ্ঠুর বিচারক। ১৩ বছরের ছেলে সুশীল সেন। পুলিশ সার্জেন্টকে ঘুসি মেরে নাক ফাঁটিয়ে দেয়। সুশীল সেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হলো। কিংসফোর্ট বিচারক।
বিচারে ১৫ টি বেত্রাঘাত মারার হুকুম দিল। রক্তাক্ত হলো সুশীল সেন। দুঃসহ যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়লো। খবরটি দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়লো। সকল তরুণ বিপ্লবী এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজকে বিতাড়িত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো।
বিপ্লববাদী দলের সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত, বারীন ঘোষ ও অরবিন্দ সিদ্বান্ত নিলেন কিংসফোর্টকে হত্যা করার। মিটিংয়ে প্রশ্ন উঠলো একাজের দায়িত্ব কাকে দেব? আড়াল থেকে মিটিংয়ের কথা শুনে প্রফুল্লচাকী বললেন-আমি প্রস্তুত। বলুন কি করতে হবে আমাকে। কিন্তু সবাই ভাবলেন একাজের জন্য আরো একজন দরকার। ভেবেচিন্তে ক্ষুদিরাম বসুর নাম ঠিক হলো।
ক্ষুদিরামের অবিভাবক সত্যেন বসুর কাছে চিঠি লিখে পাঠানো হলো। চিঠি অনুযায়ী ১৯০৮ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষুদিরাম কোলকাতায় এসে পৌছালেন। গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বসেই হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর শক্তিশালী book bomb তৈরী করলেন। এ বোম বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত।
বেশ কৌশলে একটি বই কিংসফোর্টের কাছে পাঠানো হলো। কিন্তু কিংসফোর্ট বই না খোলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন। আবার নতুন প্রস্তুতি। কোলকাতার নবকৃষ্ণ ষ্ট্রীটের ৩৮/৫ এর বাড়ি। বারীন ঘোষের মাধ্যমে কিংসফোর্টকে মারার বোমা পৌছে গেল প্রফুল্লচাকী ও ক্ষুদিরামের কাছে।
রিভলবার কেনার জন্য টাকা ও মজঃফরপুরে যাওয়ার মানচিত্র দেয়া হলো তাদেরকে। এই প্রথম দুজন একত্রিত হলো রেলস্টেশনে । এর আগে কেউ কাউকে চিনতো না। কথা হলো। সিদ্বান্ত নিলো কিংসফোর্টকে হত্যা করার।
পাঁচ পাঁচটা দিন চলে গেল। ক্লাব হাউজ থেকে সন্ধার পর সাদা ফিটন গাড়িতে নিয়মিত ফিরে আসেন কিংসফোর্ট। ৩০ এপ্রিল। ছায়াঘন পিছঢালা পথ দিয়ে সাদা ফিটন গাড়ি আসতে ছিলো। গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলো লড়াকু সৈনিকরা।
কিন্তু ওই গাড়িতে কিংসফোর্ট ছিলো না। ছিলো দু’জন বিদেশী। তারা মারা গেল। তাৎক্ষনিক ওই স্থান থেকে চলে গেলেন উভয়ে। কিন্তু এক পর্যায়ে ধরা পড়লো ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্লচাকী।
প্রফুল্ল ধরা পড়ার সাথে সাথে নিজের মাথায় রিভলবারের গুলি ছুড়ে মারা যান। প্রায় তিন মাস দশ দিন পর ১১ আগষ্ট ১৯০৮ সাল। ক্ষুদিরামের সকল বিষয় জানা ছিলো। হাঁসতে হাঁসতে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভারতমাতার জয়—একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি...........
লেখাটি ছোট ভাই কল্লোল কর্মকারের সামহোয়ারইনব্লগে ১১ আগষ্ট প্রকাশিত হয়।
শেখ রাফিক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।