১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ভোর পাঁচটায় ব্রিটিশ সরকার ১৮ বছরের এক তরতাজা যুবককে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করাল। কারাফটকের বাইরে তখন হাজারো জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান। ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে কারা কর্তৃপক্ষ যুবকটির কাছে জানতে চাইল, মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা কী? যুবকটি এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করেই নিঃশঙ্কচিত্তে বলে উঠলেন, ‘আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই। ’ উপস্থিত কারা কর্তৃপক্ষ সেদিন বিস্মিত হলো যুবকটির মানসিক দৃঢ়তা আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ উপলব্ধি করে। সেদিনের সেই যুবকই হচ্ছেন অগ্নিযুগের মহান বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম বসু (জন্ম ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯, মৃত্যু ১১ আগস্ট ১৯০৮)।
১৯০৬ সালের দিকে দেশপ্রেমের একটা ছোট বই ছাপা হয়েছে, এগুলো বিক্রির জন্য তরুণদের উপর দায়িত্ব পড়ল। ক্ষুদিরাম তাদের মধ্যে অন্যতম। মেদিনীপুর মারাঠা কেল্লায় প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে ক্ষুদিরাম বই হাতে বলছেন- 'আসুন পড়ুন। দেশের দুর্দশার খবর জানুন। অত্যাচারী রাজশক্তির নির্মমতার নজির - এই বই আপনাদের জন্য'।
এমন সময় একজন হাবিলদার এসে ক্ষুদিরামের হাত চেপে ধরল। শক্তি ও বয়সে তার চেয়ে অনেক বেশি। তবুও ক্ষুদিরামের কাছে-কুছ পরোয়া নেহি। হাবিলদারের মুখের মধ্যে এক ঘুষি মেরে দিলেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। তৎক্ষনাৎ নাক ফেঁটে রক্ত বেরুলো।
সত্যেন বসু ঠিক ওই সময় এসে হাজির হলেন। দেখলেন বিষয়টি। সান্ত্বনা দিলেন হাবিলদারকে। ক্ষুদিরাম মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া। কয়েকদিন আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে রইলেন।
তাতে কি আর একজন দেশপ্রেমিক শান্তি পায়? দেশ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে জড়িয়ে আছে দেশমাতৃকার কাজে।
ক্ষুদিরাম বসু ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকের সর্বকনিষ্ঠ এক বিপ্লবী। ফাঁসি মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর, ৭ মাস ১১ দিন। তিন কন্যার পর তিনি তার মায়ের চতুর্থ সন্তান।
ক্ষুদিরাম বসু পরবর্তিতে তার বড় বোনের কাছেই বড় হন। ক্ষুদিরাম বসু তার প্রাপ্তবয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই একজন ডানপিটে, বাউণ্ন্ডুলে, রোমাঞ্চপ্রিয় হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদিরাম তার বোন অপরূপার স্বামী অম্রিতার সাথে তামলুক শহর থেকে মেদিনীপুরে চলে আসেন। সেখানে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এখানেই তার বিপ্লবী জীবনের অভিষেক।
ক্ষুদিরাম বসু তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বোস এবং ভগদেব গীতা পড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বিপ্লবী রাজনৈতিক দল "যুগান্তর" এ যোগ দেন। ১৬ বছর বয়েসে ক্ষুদিরাম পুলিশ স্টেশনের কাছে বোমা পুঁতে রাখেন এবং ইংরেজ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করেন। একের পর এক বোমা হামলার দায়ে ৩ বছর পর তাকে আটক করা হয়। যে বোমা হামলার জন্য তাকে মৃত্যদণ্ড দেয়া হয় সেটায় ৩জন মানুষ মারা গিয়েছিলো।
সারা ভারতের মানুষের হূদয়ে ক্ষুদিরাম যে স্বাধীনতার অগ্নিমশাল প্রজ্বালন করেছিলেন, শত চেষ্টা করেও ব্রিটিশ সরকার তা নেভাতে পারেনি। এখানেই ক্ষুদিরামের সার্থকতা। তাঁর মৃত্যুর এত বছর পর এসেও যখন হাটে-মাঠে-ঘাটে পথ চলতে প্রায়ই বাউল, সাধক ও কবিয়ালদের কণ্ঠে আচমকা শুনতে পাই, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’, তখন মনে হয়, দেশের জন্য ক্ষুদিরামের এ আত্মদান বৃথা যায়নি। তাঁর মতো ক্ষুদিরামদের কারণেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ একদিন ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। তাঁর মতো লাখো ক্ষুদিরামের জীবনের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
সে জন্য ক্ষুদিরামের মৃত্যু নেই। দেশের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের হূদয়ে ক্ষুদিরাম তাই বেঁচে থাকবেন অনাদিকাল। ১৯০৭ সালে ক্ষুদিরাম হাটগাছায় ডাক বিভাগের থলি লুট করেন। এ ঘটনায় তাঁর অসীম সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। বিপ্লবী কবি সুকান্তের সেই অমর কবিতা,আঠারো বছর বয়সের জ্বলন্ত উদাহরণ এই বীরযোদ্ধা।
বঙ্গভঙ্গ তাকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করে। বিলাতি দ্রব্য বর্জন, বিলাতি লবণের নৌকা ডোবানো প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। একবার বিপ্লবী দল কর্তৃক কলকাতার তদানীন্তন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংস ফোর্ডকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর দায়িত্ব পড়ে ক্ষুদিরাম বুস আর প্রফুল্ল চাকির ওপর। ক্ষুদিরামের আত্মদান নিয়ে বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস রচনা করেন অমর গণসংগীত ‘একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।
’ সরল লৌকিক ঝুমুর বাউল সুরে গীত গানটি তখন সারা বাংলায় মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বজন গ্রাহ্যতা লাভ করে। নাগরিক জীবন থেকে গ্রামীণ জীবন পর্যন্ত গানটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় যার বাণী ও সুর আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। মর্মস্পর্শী এই দেশাত্মবোধক গানটি এক গণসংগীতের মর্যাদা লাভ করেছে। গানটি হলো-
‘একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংল্যান্ডবাসী।
শনিবার বেলা দশটার পরে
জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো
হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি
দশ মাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো
তখন যদি না চিনতে পারিস দেখবি গলায় ফাঁসি’
ক্ষুদিরামের বয়স যখন সাত বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার ছমাস পরে তাঁর মা মারা যান। এরপর তাঁর আশ্রয় হয় দুর সম্পর্কের এক দাদা ও বৌদির কাছে। কিন্তু সেখানে তাঁকে অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়।
অশান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠে। সঙ্গী হয় দুঃখ আর একাকীত্ব। তবু পেটের দায়ে ৮/৯ বছরের এই ছেলেটিকে সবই সহ্য করতে হতো। এ সকল কারণে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। তবে সুযোগ পেলেই খেলাধুলা আর ব্যায়াম করতেন।
এ্যাডভেঞ্চার জাতীয় কাজের প্রতি তাঁর প্রচুর আকর্ষণ ছিল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।