সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!
বহুদিন যাবৎ এ লেখকের মনে হত যা মানুষকে তৃপ্তি দেয় তাই সুখ। সুখ সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণাও সম্ভবতো এটা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এবং বাস্তব দর্শণের আলোকে সুখের এ সংজ্ঞাটা এখন আর তাঁকে তৃপ্তি অর্থাৎ সুখ দিতে পারে না। এ বিষয়ে লেখকের বর্তমানের বোধ হচ্ছে ব্যক্তি বিশেষের তৃপ্তি সুখের একটি খন্ডচিত্র মাত্র। এটা কোন প্রকারেই সর্বজনীন সুখ হতে পারেনা।
প্রাত্যহিক জীবনের নানান অভিজ্ঞতা থেকেই আপনি এর সততা উপলব্ধি করতে পারেন।
একজন অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ী যখন বিশেষ আর্থিক সুবিধা লাভ করেন তখন তিনি তৃপ্ত অর্থাৎ সুখী হন। কিন্তু মুনাফালাভের অবলম্বন হিসেবে তিনি যে মানুষটিকে বা খদ্দেরকে ঠকালেন তিনি কি সুখী হলেন? অবধারিতভাবেই এর উত্তর হবে, না। তেমনি আমাদের সমাজে এমনও মানুষ আছেন যিনি মানুষ খুন করে বা খুনের সংখ্যা বাড়িয়ে তৃপ্তি পান। এটা হয়তো সেই নৃশংস খুনীকে তৃপ্তি বা সুখ দিতে পারে।
কিন্তু যে মানুষটি খুন হল সে বা তাঁর পরিবার কি সুখী হল? অবশ্যই না। কর্মক্ষেত্রে আপনি এমনও মানুষ পাবেন যে প্রতিদিন ঘুষ বা অবৈধ উপায়ে কিছু না কিছু না পাওয়া পর্যন্ত অস্বস্তিতে ভোগেন। কাংখিত বস্তুটি পাওয়ার সে সুখী হয়। এ অবৈধ অর্থ উপার্জন হয়তো তাঁকে তাৎক্ষণিক সুখ দেয়। কিন্তু যে লোকটি নিতান্তই নিরুপায় হয়ে তাঁকে এ অর্থ প্রদানে বাধ্য হল সে কি সুখী হল? এবারও উত্তর, না।
এই লেখক একটি হালকা উদাহরণের মাধ্যমে ব্যক্তির তৃপ্তি যে খন্ডিত সুখ তা বুঝানোর প্রচেষ্টা নিতে পারে। সে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সমর্থক। ব্রাজিল জিতলে সে আপ্লুত হয়, হেরে গেলে কষ্ট পায়। কিন্তু এ প্রতিক্রিয়া সর্বজনীন নয়। প্রতিপক্ষ সমর্থকরা এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং বিপরীতার্থক কষ্ট বা সুখ লাভ করে।
কাজেই ব্যক্তির ব্যক্তিগত তৃপ্তি কখনই সর্বজননীন সুখ বা সুখের মাধ্যম হতে পারে না।
এ বিশ্লেষণের আলোকে সাময়িকভাবে এ সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, ব্যক্তির ব্যক্তিগত তৃপ্তি যা অন্যকে কোনরূপ কষ্ট বা নাখোশ করে না তাই সুখ। সাময়িক বলা হল এ কারণে যে, সুখের এ সংজ্ঞাটিও পরিপূর্ণ বা অবিনশ্বর নয়। ব্যক্তির নিষ্কন্টক তৃপ্তি কেবল তাঁকে সাময়িক সুখী করতে পারে। কিন্ত এ তৃপ্তির যখন অবসান হয় বা এতে যখন ছেদ পড়ে তখন সে অতিমাত্রায় কষ্ট পায় যা পূর্বের সুখের চেয়ে মাত্রায় অনেক বেশি।
সৎ উপায়ে অর্জিত ধন বা জৌলুস ব্যক্তিকে তৃপ্তি দেয়। কিন্তু সম্পদ হারানোর বেদনা এর চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ দেয়। প্রেমিক যুগলের অনাবিল ভালবাসা তাদের নির্মল আনন্দ দেয়। কিন্তু পরস্পরের বিচ্ছেদের কষ্ট পূর্বের সুখকে অতি সহজেই অতিক্রম করে। কাজেই দেখা যায় ব্যক্তির নিষ্কন্টক তৃপ্তিও সর্বজনীন বা নিরবিচ্ছিন্ন সুখ নয়।
ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত সত্যিকার সুখের সন্ধান পেতে লেখককে ফিরে যেতে হয় মহামতি বুদ্ধের দর্শণের কাছে। ভগবান বুদ্ধের মতে নির্বাণই পরম সুখ, নির্বাণই পরম শান্তি। নির্বাণ লাভের উপায় হচ্ছে ইচ্ছার দাসত্ব থেকে মুক্তি বা ইচ্ছাকে নিজের নিয়ণ্ত্রণাধীন করা। এ বিষয়ে লেখকের কোন সন্দেহ নেই যে ইচ্ছার দাসত্ব থেকে মুক্তিই মানুষকে প্রকৃত সুখ দিতে পারে। কিন্তু দাসত্বের এই শৃংখল থেকে মুক্তি কি এতোই সহজ? বুদ্ধ জগৎজয়ী মানুষ।
তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ সন্মান রেখেই একটা প্রশ্ন ওঠতে পারে যে যে, তিনি যেভাবে মুক্তির কথা বলেছেন বা নিজের ব্যক্তিজীবনে যে চর্চা এবং অবলম্বনের মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছেন তা লেখকের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষ্যে প্রতিপালন করা কতোটা সম্ভব? লেখক সংসারী মানুষ। সে ছাড়া তাঁর বাবা-মাকে দেখার কেউ নেই। বুদ্ধচর্চিত ত্যাগ হয়তো তাঁকে মুক্তি দেবে। কিন্তু তাঁর বাবা-মাকে কে দেখে রাখবে? কাজেই ভগবান বুদ্ধের প্রদর্শিত পথে নির্বাণ লাভও তাঁর ভাগ্যে নেই।
তাহলে কি একজন সাধারণের পক্ষ্যে স্থায়ী সুখ পাওয়া সম্ভব নয়? একজন কঠোর অনুসন্ধানী হিসেবে লেখক দমবার পাত্র নন এবং এ গুণের কারণে তিনি আপাতত এ প্রশ্নের একটি সমাধানও খুঁজে পেয়েছেন।
সমাধানের উৎস মহাভারতে বর্ণিত পঞ্চপান্ডবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি কাহিনী।
বার বৎসরের বনবাস অবস্থায় পাঁচপান্ডবের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সহদেব এক সরোবরে পানি পান করতে গেলেন। এক অদৃশ্য আওয়াজ নিজেকে সরোবরের মালিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে পানি খাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে তাঁর কিছু প্রশ্নের জবাব দেবার অনুরোধ করেন। সাথে সাথে এটাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যদি উত্তর না দিয়ে তিনি পানি পান করেন তবে তৎক্ষণাৎ মারা যাবেন। সহদেব এ কথার তোয়াক্কা না করে পানি পান করলেন এবং সত্যি সত্যি মারা গেলেন।
পরবর্তীতে নকুল পানি পান করতে গেলেন। অদৃশ্য আওয়াজ পূর্বের মতোই তাঁর কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে পানি পান করার অনুরোধ করেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন যদি এর ব্যত্য় ঘটে তবে তার পরিনতিও তার অনুজের মতো হবে। নকুল এ কথাকে পাত্তা দিলেন না। তিনি পানি পান করলেন এবং যথারীতি মারা গেলেন। পরবর্তীতে অর্জুন ও ভীমেরও একই পরিনতি হল।
সবশেষে এলেন যুধিষ্ঠির। প্রিয় অনুজদের এ অবস্থা দেখে তিনি হতবিহবল হয়ে গেলেন। ভাবলেন মামা শকুনী হয়তো ষড়যন্ত্র করে সরোবরের পানিতে বিষ মিশিয়েছেন। পানিতে বিষ আছে কিনা পরীক্ষার জন্য পানিতে হাত দেয়া মাত্র অদৃশ্য আওয়াজ যুধিষ্ঠিরকে তাঁর ভাইদের এ পরিনতির কারণ বর্ণনা করলেন এবং স্মরণ করিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরও যদি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পানি পান করেন তবে তার পরিনতিও ভাইদের মতো হবে। যুধিষ্ঠির বিনয়ের সাথে বললেন যে, তিনি সদুত্তর দিতে চেষ্টা করবেন।
অদৃশ্য আওয়াজ তখন যুধিষ্ঠিরকে ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, নীতি, সংস্কৃতি, জীবনাচারণ ইত্যাদি সম্পর্কিত অনেকগুলো প্রশ্ন করেন। এগুলোর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল- এ পৃথিবীতে কে সবচেয়ে সুখী? যুধিষ্ঠির উত্তরে বলেছিলেন, "যার কোন ঋণ নাই আর যে দিনশেষে শাকভাত খায়"। বলাবাহুল্য এ উত্তরসহ বাকি সবগুলো উত্তরই অদৃশ্য আওয়াজ অর্থাৎ প্রশ্নকর্তাকে সন্তুষ্ট করেছিল। তিনি খুশি হয়ে যুধিষ্ঠিরকে তাঁর চার ভাইয়ের মধ্যে একজনকে পুনরায় জীবিত করার অধিকার দিলেন। যুধিষ্ঠির নকুলকে বাঁচাতে চাইলেন।
ভীম ও অর্জুনের মতো বিখ্যাত যোদ্ধাদের বাদ দিয়ে নকুলকে বাঁচাতে চাওয়াটা প্রশ্নকর্তাকে অবাক করল। তিনি যুধিষ্ঠিরের এ অভিনব সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চাইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন আমার দুই মা, কুন্তী এবং মাধবী। আমরা বড় তিন ভাই বড়মা কুন্তীর গর্ভের। নকুল ও সহদেব ছোটমা মাধবীর গর্ভের।
যদি বড়মা কুন্তীর গর্ভের বড় সন্তান অর্থাৎ আমি (যুধিষ্ঠির) জীবিত থাকি তবে ছোটমা মাধবীর বড় সন্তান নকুলেরও বাচার অধিকার আছে। অদৃশ্য আওয়াজ পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, যদি আরেক ভাইকে বাচানোর সুযোগ দেয়া হয় তবে তিনি কাকে বাচাতে চাইবেন? যুধিষ্ঠির নিঃসংকোচে জানালেন যে তিনি সহদেবকে বাচাতে চান। সে সবার ছোট এবং এ কারণে তার বাচার অধিকার অন্যদের চেয়ে বেশি। অদৃশ্য আওয়াজ যুধিষ্ঠিরের আচরণে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হলেন। তিনি তাকে তার সব ভাইদের জীবিত করার অধিকার দিলেন।
ভাইদের নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ে যুধিষ্ঠির বিনয়ের সাথে প্রশ্নকর্তার পরিচয় জানতে চাইলেন। প্রশ্নকর্তা জানালেন তিনি যক্ষ। যুধিষ্ঠির বললেন যে আত্মা এতো দয়াবান তিনি কখনও যক্ষ হতে পারেনা, আপনি অন্য কেউ। অদৃশ্য আওয়াজ তার দর্শণ দিয়ে জানালেন যে তিনি ধর্মরাজ।
যক্ষরূপী ধর্মরাজের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে দেয়া যুধিষ্ঠিরের সেই উত্তর অর্থাৎ "যার কোন ঋণ নাই আর যে দিনশেষে শাকভাত খায়"- এই উপলব্ধিটাই লেখকের কাছে আপাতত সর্বজনীন সুখী হওয়ার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম বলে মনে হয়।
একজন সাধারণ মানুষ কেবলমাত্র তার উপর অবস্থানের উপর সন্তুষ্ট থেকে এবং নিজেকে অন্যের গলগ্রহ মুক্ত করে সুখী হতে পারে। তবে অবস্থা এবং ঘটনার প্রেক্ষিতে সুখের মাত্রা যেমন ওঠানামা করে তেমনি লেখকের মনোজাগতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে যে সুখ সম্পর্কে তার বর্তমান উপলব্ধির কোন পরিবর্তন ঘটবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।