ছেলেটির নাম রাজীব। বাচ্চা মেয়েটি তার বোন। শাবানা। এরা যে মুলুকে থাকে, সেটি নিতান্তই ইট-কাঠ বর্জিত সভ্যতা। সেখানে বাতাসে পাক খায় ধুলো।
ধুলোর গায়ে তাপ। খর রৌদ্রের তাপ। সেই রোদ ঠিকরে আসে খটখটে নীল আকাশ থেকে। নীল আকাশে ছায়ার খোঁজে ভেসে বেড়ায় শুকনো মুখের, ফর্সা পেঁজাতুলো মেঘ। সন্ধেয় তারা ঘুমোতে যায় ঢেউ খেলানো দিগন্তের দিকে।
এক দিকে সোনাতলা। অন্য দিকে বোয়ালিয়া। মাঝখানে কু-উ উ ঝিক ঝিক। আব্দুলপুর রেল স্টেশন।
সেই স্টেশনে কিছু মানুষ অবশ্য নেমে থাকেন।
পাশের অরণ্যে ঢুঁ মারতে গাড়ি মেলে বেশ সস্তায়। যারা নামেন সেখানে, তাঁরাই দেখতে পান এই ভাইবোনটিকে। প্ল্যাটফর্মের শান ফুঁড়ে উঠেছে যে ঝাঁকড়া পিপুল, তারই ছায়ায় ঠাঁই নিয়েছে দু’জন। যদিও শীতের সূর্য, তবু পিপুলের পাতা সূর্যের ওমটুকু গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেয় নীচে,এই দু’জনের লাউডগা শরীরে। সেই ছায়াতেই দিব্যি খেলাধুলো, আর পানির দরকার হলে, ওই যে, একটু দূরেই প্ল্যাটফর্মের পাশে মান্ধাতা আমলের টিউবওয়েল।
তার গ্রানাইট বেসিনের গায়ে বড় বড় করে লেখা, ‘আশ্রিত কিংবা ভিক্ষুকদের জন্য’!
দুটি গোত্রের অংশ নয়, তবুও নির্বিবাদে সেই টিউবওয়েল ব্যবহার করে ওরা। পান থেকে স্নান পর্যন্ত নানাবিধ কাজে। আমি যখন রাজীবকে দেখলাম, সে খুব মন দিয়ে তার পায়ে একটুকরো পাথর ঘষছিল। ফুটিফাটা পায়ে যেন শতাব্দীর ধুলো। পাথর ছাড়া কে-ই বা দূর করবে সেই মালিন্য? রাজীবের কচি পায়ে পাথরখণ্ড ওঠানামা করে।
পানি নেওয়ার মগ নেই, কিন্তু তাতে কী? একটা আধপোড়া প্লাষ্টিকের টিফিনবাটি, ওটাই দিব্যি মগের কাজ চালিয়ে দিচ্ছে। দেখতে দেখতে প্রথমে বিস্ময় খাই, অতঃপর মনের মধ্যে আচমকা জেগে ওঠে মধ্যবিত্ত মায়া। আহা, এরা কি কখনও সাবান পায়নি? ব্যাগের পকেটে থাকা একটুকরো সাবান দেই ওকে। সঙ্গে একটা শিশিতে একটু অলিভ ওয়েল। আর, ডিটারজেন্ট-এর কয়েকটি মিনিপ্যাক।
সেই সম্পদ হাতে পেয়ে রাজীব বেশ খানিকটা হতভম্ব। এ তো ভারি রঙ্গ জাদু! এ সব দিয়ে যে কী হবে, সেই কথা তার মাথার মধ্যেই আসে না। রাজীবের সাবান কেনার পয়সা নেই, কথাটি সত্য। আসলে, অর্ধেক সত্য। রাজীব কখনও সাবান চোখেই দেখেনি।
তার বোনের অবশ্য এই সংকট নেই। কচি শিশু,মুখে এখনো কথা ফোটেনি। সে ভাইয়ের পাশেই বসে ছিল, দেখামাত্র থপথপিয়ে এগিয়ে এলো। তারপর, সাবানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, আর আরাম করে সাবানের টুকরোটা চেটে দেখে, স্বাদটা কী রকম!
ক্রমে আলো আসে। রাজীবের মাথায়।
যে মুহূর্তে সে বোঝে, এই বস্তুটি দিয়ে ময়লা-টয়লা দূর করা যায়, তৎক্ষনাৎ সে নিজের পা-টা ধুয়ে ফেলে। টিফিনবাটিটা মাজাঘষা করে নেয় একটু। তখনই গোসলটাও সেরে নিতে পারত। কিন্তু, তা করে না। বরং, দৌড়ে গিয়ে বোনটাকে টেনে আনে কলের কাছে।
জামাকাপড় ছাড়িয়ে দেয়। তারপর, সারা গা ভাল করে সাবান দিয়ে ঘষে দেয়। ভয় ছিল, পাছে নিজের গোসলটা সারতে গিয়ে ওইটুকু সাবান ফুরিয়ে যায়। তাই, বিরল বস্তুটি থাকতে থাকতে বোনটাকে আগে গোসল করিয়ে দেয়। প্রথমে তো সেই মেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা।
তারপর, টু শব্দটি করে না। বেশ আরামই লাগে হয়তো, তাই দিব্যি উপভোগ করে এই-সাবান গোসল বিলাস। অবশ্য, একসময় চোখে ফেনা ঢুকতেই কান্না। পানি ঢেলে চোখটা ধুইয়ে দেওয়ার পরে ফের ঠাণ্ডা।
তখন কোত্থেকে তার ভাই হাজির করে তোবড়ানো এক বাক্স।
তার থেকে বেরোয় ভাঙা একটা লিপস্টিক। একটুখানি রাঙা আভা জাগে ছোট্ট মেয়ের ঠোঁটে আর গালে। গায়ে একটা অন্য জামাও ওঠে। যদিও আগেরটার মতো সেটাও শতচ্ছিন্ন। শেষটায় অভিভাবকের দায়িত্ব-টায়িত্ব পালনের পর রাজী্ব তার নিজের শরীরে মন দেয়।
গোসল সেরে রাজীব তার একমাত্র পরিষ্কার জামা-প্যান্টটাই পরে ফেলে। কোনও দাতা দিয়েছেন নিশ্চয়ই। হলুদ একটা শার্ট, তাতে দুটো বোতাম নেই। সঙ্গে, ধূসর রঙের প্যান্ট। সেজেগুজে তার মন যায় আমার ক্যামেরাটার দিকে।
জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, আমি যদি প্ল্যাটফর্মের ওই দণ্ডটা বেয়ে উঠে একটু খেলা দেখাই, তুমি আমার ছবি তুলবে?
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এক্ষনি গোসল সেরে আবারো ধুলো ঘাঁটা ! কথাটা মনে করিয়ে দিই ওকে। ধৃষ্ঠতার লজ্জা পায় রাজীব। যেন একটা গর্হিত কথা বলে ফেলেছে, এমনই একটা অপরাধীর মতো ভাব ফুটে ওঠে তার মুখে। সেই ভাবটা কাটাতেই বোধহয় হাত ছড়িয়ে গোল হয়ে দৌড়তে থাকে বোনের চারধারে।
স্নানের পরে নরম সূর্যের আলোটা তার বেশ ভালই লাগে ! রাজীব আমাকে দেখায়, এখনও একটু সাবান হাতে আছে। বেশ হিসেব করে সপ্তাহে যদি একটা করে দিন গোসল করা যায়, তা হলে ওইটুকু সাবানেই আরও মাসখানেক চলে যাবে!
ওইটুকু সাবান দিয়ে আরও এক মাস! আমার চোয়াল ঝুলে পড়ে! তারপর, কেনই বা বিস্মিত হলাম, ভেবে ফের আর এক প্রস্থ বিস্ময় জাগে! এ রকমই তো হওয়ার কথা ছিল ! আমিই বুঝতে পারিনি।
বোধহয়, আমরা বুঝতে পারিও না। বিজয়-দিবসের দিন বাতাসে ছুটির গন্ধ। তাতে অবশ্য আব্দুলপুর প্ল্যাটফর্মের ধারে পিপুল গাছটার কিছু যায়-আসে না।
ওদেরও কি যায় আসে কিছু? ওই যে,রাজীব আর শাবানার! দিব্যি থাকে ভাইবোন। অস্তিত্বের সংকট এবং তার নানাবিধ প্রভাব ওদের চোখের মোটেই কোলে কালি হয়ে জমে না! বরং, প্ল্যাটফর্মেই বেঁচেবর্তে থাকে ওরা। হিসেব করে, ঠিক কতটুকু করে মাখলে সাবানটা আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকবে! সেইটুকু আনন্দেই ওদের মুখচোখ কেমন ঝকঝক করে ওঠে। আর, আমি বা আমরা ; পকেট ভর্তি কাগজের সুখ নিয়েও কালিমুখে ওদের সুখের সন্ধান করি !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।