অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
আনোয়ার সিদ্দিকী বেশ নামকরা সাংবাদিক। ‘৭৪ সালের শুরু থেকে ‘৭৫ এর শেষ ভাগ পর্যন্ত সাপ্তাহিক হলিডে পাঠকরা নিশ্চয়ই ভোলেননি তার ক্ষুরধার লেখনীর কথা। অবশ্য এটাই তার একমাত্র নাম নয়। আমিনুল ইসলাম এবং রফিকুল ইসলামও তার বহুল ব্যবহৃত নাম। তার সঙ্গীদের অন্যতম জামালউদ্দিন ওরফে হামিদ ওরফে আবদুল হামিদ্ ওরফে নজরুল ইসলাম ওরফে খসরু।
শেষ নামটা জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক ও কবি হুমায়ুন কবিরের মৃত্যুর সঙ্গেও। পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম সিরাজ শিকদারের ঘনিষ্ঠ কমরেড ছিলেন হুমায়ুন। কাকতালীয়ভাবে তার হত্যাকারীর নামও খসরু, যিনি কাজী জাফরের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ট ছিলেন।
এতগুলো নামধারী এই ব্যক্তির জাতীয়তা জেনে ভিমড়ি খাবেন অনেকেই। যখন পাসপোর্টে দেখবেন তার আসল নাম- পিটার জোসেফ হুয়ান মারিয়া কাস্টার্স।
এবং আরেকটি নাম আছে, রেভো কন্টি। মূলত হল্যান্ডের নাগরিক। একদম হালনাগাদ হোয়ারএবাউট জানতে চাইলে জানতে পারবেন উনি ডক্টরেটধারী। একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার সংস্থার কর্ণধার। বাংলাদেশের ওপর প্রচুর বই লিখেছেন।
মওলানা ভাসানীর সেইরকম ফ্যান। একটি ওয়েবসাইটও আছে তার , যেখানে পরিচয় দেওয়া আছে ক্যম্পেইনার অ্যান্ড থিওরেশিয়ান হিসেবে। এবার যদি ব্যাকডেটে যান, তাহলে অপেক্ষা করছে বিস্ময়ের আরো উপাদান। থিওরেশিয়ান অর্থাৎ তাত্বিক হিসেবে তিনি সিরাজুল আলম খান ওরফে দাদারও গুরু লাগেন। জাতীয় সমাজতন্ত্রিক দলের প্রস্তাবিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মূল থিসিসটা তারই মাথা থেকে বেরিয়েছে।
তার চেয়ে চমকপ্রদ যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৪ বছর কারাদন্ডাদেশ পাওয়া প্রথম এবং একমাত্র বিদেশী তিনি। যদিও একদিনও সেই সাজা ভোগ করতে হয়নি তাকে।
সিরাজ শিকদারের ওপর আমার সাম্প্রতিক সিরিজটা যার অনুপ্রেরণায়। সেই কমরেড রোকনের অসমাপ্ত পান্ডুলিপির একটা লাইনই আজকের এই পোস্টের উৎস। সেটার ভূমিকাতেই লেখা ছিলো তার কথা।
লেখা ছিলো- উত্তর ইউরোপ থেকে আসা বিপ্লবী পিটার কাস্টার্স খুব চেষ্টা করেছিলেন চরমপন্থীদের সর্বহারা ঐক্য আন্দোলনের ব্যানারে একাট্টা করতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। এটা ছিলো ক্লু। এরপর ভাসানী বিষয়ে তার একটা লেখার শুরুতেই পেলাম এই কথাগুলো : Let me initiate this tribute to Maulana Bhasani by recalling how I was personally introduced to him now 34 years ago. It was September 1973, when as a young journalist and activist I was taken to Santosh in Tangail by Nasu Bhai, my first political friend in Bangladesh, who had close connections with the underground Sharbahara Party.I had entered the country just a few days before then, determined that I was going to work for revolutionary change here in Bangladesh, following the great example of the Latin American revolutionary Che Guevara, whose exploits as guerrilla leader in Cuba and Bolivia I had heard of during my student days. ( SECULAR DEMOCRACY, SOCIALISM AND BHASHANI)
এরপর কর্ণেল তাহের নিয়ে একটি লেখায় : On the morning of August the 15th, I happened to be a silent witness to a confrontation which took place at the Dhaka radio, between Colonel Taher and Mustaque Ahmed, leader of the pro-American wing of the Awami League. (COLONEL TAHER’S UNIQUE LEGACY- THE 1975 SOLDIERS’ UPRISING IN A COMPARATIVE HISTORICAL PERSPECTIVE). একজন বিদেশীকে স্বাক্ষী রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে সংঘাতে উপনীত হয়েছেন কর্ণেল তাহের! বাংলাদেশ বেতারের মতো সংবেদনশীল জায়গায়! নড়েচড়ে বসতেই হয়। চালাও শাবল, খোড়ো ইতিহাস।
১৯৭৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয় পিটার কাস্টার্সসহ ৭ জনকে ১৪ বছর কারাদন্ডাদেশের সংবাদ। অভিযোগ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র। ১৯৭৫ সালের ৮ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় তাকে এবং বাংলাদেশ পেনাল কোডের ১২১ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। তার পরিচয় ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ২২ সেপ্টেম্বর ‘৭৬ দ্য বাংলাদেশ অবজারভারে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে বলা হয় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে আসেন কাস্টার্স।
নিজেকে পরিচয় দেন ফ্রিল্যান্স রিলিফ কর্মী হিসেবে। বাংলাদেশে থাকার সময় তখন নিষিদ্ধ হওয়া জাসদ ও গণবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার উৎথাত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্যই তিনি জাসদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন।
রিপোর্টে আরো লেখা হয়- ‘সর্বহারা ঐক্য আন্দোলন’ নামে একটা গোপন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন কাস্টার্স, যার সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় পরিষদের নাম দেওয়া হয় ‘কেন্দ্রীয় বিকাশ গ্রুপ’। পরিকল্পিত বিপ্লব সংঘটনের জন্য সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টির সঙ্গে জাসদের গণবাহিনীর সমন্বয় করার চেষ্টা করেন তিনি।
এজন্য ঢাকায় তিনটি বাড়ি ভাড়া করেন এবং নিবন্ধিত সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আর এ সবই করা হয় বাংলাদেশ ব্যবহারিক শিক্ষা নামে একটি এনজিওর আড়ালে। সারা দেশজুড়ে কর্মী সংগ্রহ ও তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন কাস্টার্স। এরপর বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে অনুদান সংগ্রহ করেন তিনি এবং কর্মীদের নির্দেশ দেন দেশের মধ্যে থেকে অস্ত্র সংগ্রহের (থানা ও পুলিশ ফাড়ি দখল করে)। সরকার এই অভিযোগে ব্যবহারিক শিক্ষার নামে ব্যাঙ্ক একাউন্টে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৬ টাকা ৪৮ পয়সা বাজেয়াপ্ত করেন।
মামলার রায় বের হওয়ার পরদিনই মার্কিন ও হল্যান্ড দুতাবাসের চাপে কাস্টার্সকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তবে এর আগে ২৪ আগস্ট ‘৭৬ নিউইয়র্ক টাইমসে তার গ্রেপ্তার ও বিচার নিয়ে একটি খবর ছাপা হয়। তিনদিন পর একই পত্রিকায় এর ফলোআপ ছাপা হয়। এবং দু জায়গাতেই তার পরিচিতি ছাপা হয় সাংবাদিক হিসেবে।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ দুতাবাসের স্টেটমেন্ট দিয়ে বলা হয় : পিটার কাস্টার্স পক্ষপাতহীন এবং ন্যায় বিচার পাবেন। ২৩ সেপ্টেম্বর দন্ডাদেশের খবর ছাপে তারা যাতে বলা হয় হল্যান্ড সরকার পিটারকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর তারা নিশ্চিত করে যে পিটারকে হল্যান্ড পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মিডিয়ায় এই খবরটি চেপে যাওয়া হয়
আরো চমকপ্রদ হচ্ছে গ্রেপ্তারের পর কাস্টার্সকে রাখা হয় ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীর একটি দোতলা বাড়ীর ছাদে এক কামরার কক্ষে। এর মধ্যে লাফিয়ে পালাতে গিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে ধরাও পড়েন কাস্টার্স।
মাস তিনেক পর প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট এ আর মজুমদারের কাছে জবানবন্দী দেন তিনি। দীর্ঘ জবানবন্দীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টির জন্য সিরাজুল আলম খানের পরিকল্পনা যাতে জাসদকে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় (নভেম্বর, ১৯৭৪), জাসদের থিসিসের খসড়া নিয়ে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আলোচনা (ঐ), আর্মস ক্যাডারদের প্রশিক্ষণের জন্য কর্ণেল তাহেরের ৫০ হাজার ডলার দাবী এবং এই বাবদ কিস্তিতে বাহার ও আনোয়ারের (তাহেরের ভাই) মাধ্যমে ৬০ হাজার টাকা প্রদান। প্রফেসর আনোয়ার তাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে ৬০ হাজার টাকা রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ এবং রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহার করা হবে। ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ এলিফ্যান্ট রোডে ভাই আবু ইউসুফের বাসায় তাহের নিশ্চয়তা দেন যে শিগগিরি ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছেন তারা।
যা হোক।
এসবই ইতিহাস। হয়তো বাংলাদেশপ্রেমী একজন বিদেশীকে কলঙ্কিত করতে তখনকার সরকারের মনগড়া তথ্য যা তাদের তাবেদার সংবাদপত্রগুলো ছাপিয়েছে। কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধে একজন ওডারল্যান্ড পেয়েছি, বাংলা ব্লগে একজন আরিল পেয়েছি, তেমনি হয়তো পিটার কাস্টার্সও একজন। চারু মজুমদার বলেছিলেন বিপ্লবীদের অতিকথনে দোষ নেই। হয়তো কাস্টার্স প্রতিবিপ্লবীদের অতিকথনের শিকার।
কিন্তু মার্কসবাদ-লেনিলবাদ ও মাওবাদে নিজের দীক্ষা ও বিশেষত্বের কথা নিজেই স্বীকার করেছেন।
হয়তো বাংলার প্রলেতারিয়তদের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন তার ছিলো চে গুয়েভারার স্টাইলে। এজন্য অবলম্বন করেছিলেন মাওয়ের বাণী চিরন্তনী- বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। কিন্তু বাংলার মানুষ এই থিওরি জেনেছে আড়াইশো বছরেরও বেশী আগে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৌজন্যে।
এরপর স্বাধীনদেশে এতগুলো বছর সেনা শাসন। জিয়া-এরশাদ-মইন। নাহ, কেউই মাওবাদী ছিলেন না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।