আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিধবা ও বহুবিবাহে বিদ্যাসাগরের অবদান

কেউ কেউ একা

বিদ্যাসাগরের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ত্রিবেদী তাঁর লিখিত ভাষণের সূচনা করেছিলেন এই বলে, ''রত্নাকরের রাম নাম উচ্চারণের অধিকার ছিল না। অগত্যা 'মরা' 'মরা' বলিয়া তাহাকে উদ্ধার লাভ করিতে হইয়াছিল। এই পুরাতন পৌরাণিক নজিরের দোহাই দিয়া আমাদিগকেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম কীর্তনে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। নতুবা অই নাম গ্রহণ করিতে আমাদের অনুরূপ অধিকার আছে কি-না এ বিষয়ে ঘোর সংশয় আরম্ভেই উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। '' ত্রিবেদীর উক্তি কলকাতার লেখক ও পাঠকদের প্রতি কটাক্ষ উক্তি।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, উনবিংশ শতাব্দীর এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি আপন প্রতিভায়, আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বিচিত্র গুণাবলীর সমন্বয়ে তাঁর জীবন পূর্ণ। অথচ আজ আমাদের সমাজ তাঁকে ভুলতে বসেছে।

যাঁর কর্মকাণ্ড এক সময় মানুষের মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না আজ সভ্য সমাজের অনেকেরই তাঁর সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন ধারণা নেই। তৎকালীন সমাজের নানা অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল। তার মধ্যে সমাজ সংস্কার একটি। সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগরের পরিচিতি ও মূল্যায়ন ব্যাপক। বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বহুবিবাহ রোধ এর মধ্যে অন্যতম।

তবে বিধবাবিবাহ প্রচলনের ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের আগে যে কেউ এগিয়ে আসেনি তা নয়। মহারাজ রাজবল্লভের নাম এখানে উল্লেখ করা যায়। বিধবাবিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করেন কোটার রাজাও। মতিলাল শীল ঘোষণা করেন, যিনি বিধবাবিবাহ করবেন তাঁকে বিশ হাজার টাকা পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে। (উৎস : নরেন্দ্রনাথ লাহা : সুবর্ণবণিক কথাও কীর্তি প্রথম খণ্ড, কলকাতা, ১৪৪০, পৃষ্টা ২৬) শুধু তাই নয়, বিধবাবিবাহের পক্ষে বিভিন্ন কাগজে প্রবন্ধ প্রকাশের খবরও জানা যায়।

কিন্তু তখনকার সমাজ ব্যবস্থা এতটাই রক্ষণশীল ছিল যে, কোনভাবেই কোন কাজ হয়নি। কেবল বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত বিধবাবিবাহ আইনের জন্ম হয়। পরিশ্রম, সহিষ্ণুতা নিয়ে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্র ঘেঁটে তিনি রচনা করেন 'বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' গ্রন্থ। প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে। গ্রন্থটি দেখতে দেখতে বাজারে বিক্রি হয়ে যায়।

সবার মুখে মুখে শুধু বিধবাবিবাহ। এর পক্ষে বিপক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। বিপক্ষে অবস্থানকারীরাও বই লেখেন। চলতে থাকে তর্ক-বিতর্ক। একই সালের অক্টোবর মাসে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ সম্পর্কিত আরও একটি গ্রন্থ প্রকাশ পায়।

গ্রন্থটির নাম 'বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব। দ্বিতীয় পুস্তক। ' বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ১৮৫৫ সালের অক্টোবরে ৯৮৬ জন লোকের স্বাক্ষর করা একটি আবেদনপত্র বিদ্যাসাগর ভারত সরকারের কাছে পাঠান। বিধবাবিবাহ বিলের খসড়া কাউন্সিলে প্রথমবারের মত উত্থাপন করা হয় ১৮৫৫ সালের ১৭ নভেম্বর।

দ্বিতীয়বার উত্থাপন করা হয় ১৮৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, বিধবাবিবাহ আইন পাশের বিরুদ্ধে সমাজে জনমত গড়ে ওঠে। ভারত সরকারের কাছে বিধবাবিবাহ আইন পাশের বিরুদ্ধে ১৮৫৬ সালের ১৭ মার্চ একটা আবেদনপত্র যায়। তাতে ৩৩,০০০ জন লোকের স্বাক্ষর পড়ে। শুধু তাই নয়, বিধবাবিবাহের পক্ষে বিপক্ষে সরকারের কাছে হাজার হাজার আবেদন আসতে থাকে।

তবে বিধবাবিবাহের আইন পাশের পক্ষে যত আবেদন আসে তার চেয়ে বিপক্ষে আবেদন আসে বেশি। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৮৫৬ সালের ১৯ জুলাইয়ে তৃতীয় বারেরর মত উত্থাপিত হয় বিধবাবিবাহ আইন পাস করার জন্য। একই সালের ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়। ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। ১২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটে রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রথম বিধবাবিবাহ হয় শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারতœ ও কালীমতী দেবীর সাথে।

বিয়ের যাবতীয় অর্থ বিদ্যাসাগরই দেন। এমনিভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হতে থাকে। অর্থ জোগান দেন বিদ্যাসাগর। এক সময় তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে চারদিক থেকে বিধবাবিবাহ নিয়ে নানা রকম হুমকি আসতে থাকে।

এমনকি গুণ্ডাপাণ্ডাও তাঁর পেছনে লেলিয়ে দেয়া হয়। কোন কিছুতেই তিনি না দমে বিধবাবিবাহ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৮৭০ সালের ১১ আগস্ট নিজের ২২ বছরের ছেলে নারায়ণ বন্দোপাধ্যায়কে ১৪ বছর বয়সী বিধাবা ভবসুন্দরী দেবীর সাথে বিয়ে দেন। বিধবাবিবাহ হলে সমাজের মঙ্গল হবে। নারীর দুঃখ ঘুঁচবে এমনটিই আশা করেছিলেন বিদ্যাসাগর।

কিন্তু বিধবাবিবাহের নামে সমাজে নতুন একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় বহুবিবাহ। যা কারোরই কাম্য ছিল না। বিদ্যসাগর ধর্ম শাস্ত্র ঘেঁটে বহুবিবাহ নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেন। জানেন অনেক কিছু।

বহুবিবাহ বলতে সনাতন ধর্মে কিছু নেই। বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে। তাদের মধ্যে ছেলের বড় অভাব ছিল। কুলীন ছাড়া অন্য জাতির সাথে কুলীন ব্রাহ্মণদের মেয়ে বিয়ে দিলে তাকে আর ব্রাহ্মণ সমাজে স্থান দেয়া হত না। সমাজের এ দিকটাও ছিল কুসংস্কারে ভরা।

১৮৫৫ সালে বহুবিবাহ বন্ধের প্রথম আবেদন করে সুহৃদ সমিতি। এরপর রাজা দেব নারায়ণ সিংহ, রমাপ্রসাদ রায়, প্রাণনাথ চট্টপাধ্যায়, রাজা রাধাকান্তদেব এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বর্ধমানের মহারাজ, নদীয়ার মহারাজ, দিনাজপুরের রাজাসহ বিভিন্ন জেলার আবেদন সরকারের কাছে জমা পড়ে। পাশাপাশি বহুবিবাহের বিপক্ষেও জমা পড়ে আবেদন। বহুবিবাহ রহিত করতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগার প্রথম আবেদনপত্র পাঠান ১৮৫৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর।

রাজবিদ্রোহের কারণে তাঁর আবেদনপত্র টেবিলেই পড়ে থাকে। নিরাশ না হয়ে তিনি আবার আবেদনপত্র পাঠান ১৮৫৬ সালের ১ ফেব্রয়ারিতে। বহুবিবাহ সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যায়, তিন'শ স্বাক্ষর বিশিষ্ট একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে ১৮৬৬ সালের ২৪ মে জমা পড়ে। এ আবেদনপত্রে বহুবিবাহ রহিত আইন প্রণয়নের পাশাপাশি পণপ্রথা উচ্ছেদেরও দাবি জানানো হয়। সত্যিকার অর্থে বহুবিবাহ রহিত করার পাশাপাশি পণপ্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের এখান থেকেই শুরু হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে বহুবিবাহ রহিত করতে নানাবিধ কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। এরই মধ্যে বিদ্যাসাগরের ১৮৭১ সালে 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয় বিচার' নামক গ্রন্থ প্রকাশ পায়। এরপর আরও তিনখানা গ্রন্থ 'বহুবিবাহ রোধ' সম্পর্কিত প্রকাশ পায়। বহুবিবাহ রোধ করতে আইন পাশ করার দাবি নিয়ে বিদ্যাসাগর লেফটেন্যান্ট গভর্ণর বিডন সাহেবের সাথে দেখাও করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বহুবিবাহ রহিত আইন পাস করে যেতে পারেননি।

সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগর ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। সমাজের নানা অসঙ্গতি তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের মঙ্গলার্থে। দয়া দাক্ষিণ্যেও তিনি ছিলেন উদার। তাঁকে যেমন বলা হত বিদ্যার সাগর তেমনি বলা হত দয়ার সাগর। বর্তমান সমাজের কাছে তাঁর কর্মময় বিচিত্র জীবন সত্যি বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

তাঁর কর্মকাণ্ড হতে পারে নতুন প্রজন্মের দিক নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.