...
১.
বিসিএস এর প্রথম পরীক্ষা শেষে রাস্তায় নেমেছি। নিজেকে একই সাথে ক্লান্ত এবং আবেগশূন্য মনে হচ্ছে । যদিও আমি এর আগে কখনো ধর্ষিত হই নি তবুও কেনো জানি মনে হচ্ছে ধর্ষন শেষে মনের অবস্থা এই রকমই হয়। আমি ক্লান্ত পায়ে বাসের জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।
ঢাকা কলেজের এখানে ইন্টারের ছেলেদের সিট পড়েছে।
তারাও পরীক্ষা শেষে বের হয়ে এসেছে। বেশ মোটাসোটা একটা ডিজুস ছেলে হঠাৎ চিৎকার দিল- আরে তুই এইখানে?
একটা সমবয়েসী মেয়ের উদ্দেশ্যে এই চিৎকার। কাছাকাছি হতেই মেয়েটার উদ্দেশ্যে ছেলেটা হাই ফাইভের জন্য হাত উপরে তুলল।
-আরো একটা পরীক্ষা শেষ। হুরররররেরেরের......
মেয়েটা আর ছেলেটা হাই ফাইভ শেষ করেই যার যার পথে এগিয়ে গেল।
আর আমি ক্লান্ত মনে এইটাই ভেবে ভেব পাচ্ছিলাম না, আমারো ত একটা পরীক্ষা শেষ হলো। আমার ওদের মত এত ফুর্তি এলো না কেন?
ডিজুস তারুন্যকে মনে হয় সেইদিনই প্রথম হিংসা করা শুরু করি।
২.
ঢাকার বাস সার্ভিসের এখন একটা সিস্টেম হলো- নির্দিষ্ট একটা স্টেশনে মালিক পক্ষের লোক থাকে। বাসগুলা একটা ক্লিপ বোর্ড সাথে রাখে। হেল্পার সেই বোর্ড নিয়ে দৌড়ে গিয়ে সই করিয়ে আনে।
মালিক পক্ষের লোক সে বোর্ডে লাগানো শিডিউলে সই করে দেয় আর সীটে কতজন লোক থাকে সেটার নাম্বার লিখে দেয়। চৌদ্দ নাম্বার ( অধুনা ১ই) বাসের করে বাসায় আসছি। আজিজের কাছাকাছির কাউন্টারে চশমা পড়া এক অল্প বয়স্ক ডিজুস ছেলে সীটে কতজন আছি গুনা শুরু করল। তার চশমা দেখে সন্দেহ হলো ছাত্র। হাতে বালা ( ব্রেসলেট)এবং কানে দুল ।
তবে পড়ে আছে বেশ ময়লা টি-শার্ট। এইছেলে যখন সই করার জন্য পকেট থেকে জেল কলম বের করল তখনি আমি শিওর হলাম ছাত্র। আর যাই হোক, বাসের নিয়মিত স্টাফরা চার-পাচ টাকা দামের চেয়ে বেশি কলম ব্যবহার করবে না। ইন্টার পরীক্ষা শেষে সে এই কাজ করতে পারে, (মেট্রিক পরীক্ষার শেষও হতে পারে , আজকাল বুড়া ধামসি হয়ে পুলাপাইন এসএসসি দেয়)। যে ডিজুস জেনারেশন পার্ট টাইম কাজ হিসাবে এটা বেছে নিতে পারে- তাদের কিছু বলার আগে সাবধানে বলা উচিত।
০৩.
ডিজুস পাবলিক চেনার অনেক উপায় আছে। এরা ভুল ইংরেজিতে কথা বলে এবং হিন্দীতে পরস্পরকে এসএমএস পাঠায়। এদের পোষাকে পাশ্চাত্যের ছাপ কিন্তু অনুকরন করে বলিউডকে। হায়! ডিজুস বাংলা উচ্চারন নিয়ে কত হাসাহাসিই না হয়ে গেছে ব্লগের পাতায় পাতায়।
ডিজুস তরুনদের আমি কিছু কারনে আর হাসাহাসির যোগ্য বলে মনে করতে পারছি না।
আমি যখন কোন তরুনকে গালি দেই বা হাস্যকর মনে করি- সেই মুহুর্তেই হয়ত আমি বুড়াদের দলে পড়ে যাই।
ডিজুসদের কি কি দোষ?
ভুল বাংলা বলে? র এর উচ্চারন ঠিক মত করতে পারে না? বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলে?
- যে বাংলায় আমরা কথা বলি এখন, এই বাংলা দুইশ বছর আগেও এমন ছিল না। দুইশ বছর পড়েও বাংলা এমন থাকবে না। আমাদের ভিতর কয়জন আছে যে , পাঠ্য বইয়ে নাই ,শুধু নিজের আগ্রহে বঙ্কিমের একটা উপন্যাস পড়ে শেষ করেছে? অথচ বঙ্কিম বাংলা আধুনিক গদ্যের প্রান পুরুষদের একজন। এমনিই ত হয়।
আজকের ডিজুস যদি হুমায়ুন এর বেশি বাংলা সাহিত্যের কোন খোজখবর রাখতে না চায়- অন্তত আমি ত মনে করি আমাদের অভিযোগ জানানোর কিছু নাই। বাংলা কারো পাহারায় আজকের এই জায়গায় আসে নাই, কেউ পাহারা দিয়ে এই ভাষার পবিত্রতা রক্ষারও প্রয়োজন নাই। বাংলা যদি টিকে থাকে নিজের কারনেই টিকবে, আর যদি না টিকে থাকে তবে বোবা না থেকে নতুনকে বরন করে নেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
- ডিজুসের হিন্দি প্রীতি নিয়েও বলি। আমার মা বোন হিন্দী সিরিয়াল না খেয়ে রাতে ঘুমাতে পারে না।
কিন্তু তাতে ত আমার মা বোন ডিজুস হয়ে যায় নাই। হিন্দী পছন্দ করা দোষের হলে- ইংরেজি পছন্দ করাও দোষের হওয়া উচিত। অন্যদের কথা জানি না, ফ্রেন্ডস , বিগ ব্যাং থিওরীর মত হাসির সিরিয়ালের বেশির ভাগ ডায়ালোগ আমার মুখস্থ এবং অফিসে কানে হেডফোন দিয়ে আমি শুধু এদের অডিও শুনি আর হাসি। আমি ত নিজেকে একবিন্দু কম বাঙ্গালি ভাবি না। সুতরাং কেউ যদি হিন্দী নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, আমি কিভাবে তাকে বলতে পারি, তুমি বাঙ্গালি সংস্কৃতির অংশ না?
আধুনিকতা ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়।
কোন পোশাক আধুনিক আর কোনটা শুধু অশ্লীল সেটা আগে থেকে আচ করা সম্ভব না।
উদাহরন দেই। শাড়ি বাঙ্গালির চিরন্তন পোশাক। অথচ এমন কোন নারী এখন পাওয়া যাবে না, যে চিরন্তন বাংলার পাছা পাড় শাড়ি ব্লাউজ ছাড়া পড়ে ঘুরে বেড়াতে রাজি হবে। পাছা থেকে পাড় পায়ের কাছে নেমে এসেছে খুব বেশিদিন হয় নাই।
পাছার উপর জোর দেয়া (highlighted) একটা পোশাক যদি এখন আচলের উপর জোর দেয়া পোশাকে পালটে যায় তবে সালোয়ার কামিজ থেকে মেয়েদের পোশাক টি-শার্ট আর জিন্সে চলে আসলে কি খুব অসুবিধা হবে?
ডিজুস ছেলেদের কানের রিং বহু আগে থেকেই বাঙ্গালি পুরুষ পরে আসছে। এক্ষেত্রে আসলে তাদের পুরাতনপন্থীই বলা ভালো।
অনুকরনের একটা প্রশ্ন এখানে এসে যায়। এরা ত নিজেদের স্টাইল (ফ্যাশন নয়) নিজেরা খুজে বের করছে না। অনুকরন করছে।
উনিশ শতকের শুরুতে কোন শিক্ষিত বাঙ্গালি পাশ্চাত্যের অনুকরন করে নি? রবীন্দ্রনাথের মত সৃজনশীল মানুষ অনুসরন করেছেন পাশ্চাত্যের- আর ডিজুস করলে দোষ? আমি তাদের গালি না দিয়ে বরং এই আশাই করব যে ডিজুস জেনারেশন একদিন তাদের টোন খুজে বের করে ফেলবে।
ডিজুসদের বেলেল্লাপনা নিয়ে অনেক বাক্য খরচ করা যায়। আমার কাছে কিন্তু মনে হয়, এই ধরনের কাজ বাঙ্গালিরা অতীতেও করেছে এখনো করে। সেক্স আগে গোপন ছিল একটু প্রকাশ্যে এসেছে। কখনো খারাপ লাগে আবার কখনো কখনো কিন্তু ভালোই লাগে।
ধানমন্ডির রাস্তায় ল্যাম্পের আলোয় জড়াজড়ি করে পরস্পরকে চুমু খাওয়া দুই ডিজুসকে দেখে আমার কাছে কিন্তু ভালোই লেগেছে। তবে কিছু বাজে ব্যাপার ঘটছে। আগে হয়ত গোপন ক্যামেরায় ভিডিও হত না, এখন হয়। এরবেশি কিছু না।
আসল কথা হলো ডিজুসরা একেবারেই তরুন।
ডিজুস নিয়ম ভাংগবে। এই নিয়ম ভাংগতে গিয়ে এরা ভালো কিছু ভেঙ্গে ফেলবে , খারাপ কিছুও ভাংগবে। তরুন বলেই এরা ভুল করবে আবার সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিবে। আর শুধুমাত্র তরুন বলেই আমি ঠিক করেছি, আমি তাদের উপর আমার আস্থা রাখব , আমি তাদের উপর আমার বিশ্বাস স্থাপন করব। আমি তাদের পক্ষে কথা বলব।
ডিজুসদের নিয়ে এই ব্লগটা অনেক আগেই লিখব ভেবেছিলাম। কিন্তু আলস্য, ১৮+ এর প্রতি আসক্তি, রম্য রচনায় অতিরিক্ত আগ্রহ- নানাবিধ কারনে সময়মত লিখতে পারি নি। আবার যখন লিখলাম তখন আবার তাড়াহুড়ো করে লিখে ফেললাম। আরেকটু সময় নিয়ে যুক্তিগুলো আরো ঘুছিয়ে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তবুও মনের ভিতর একটা সান্ত্বনা আছে- ডিজুসের মতই আউলা-ঝাউলা লিখলাম- অন্তত থিম ত ঠিক আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।